দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মঙ্গলবার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশমালা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেছে। এই সুপারিশমালা দেশের রাজনৈতিক সংস্কার ও স্থিতিশীলতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর জনগণের আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। কমিশন রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের সমন্বয়ে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশগুলো তৈরি করেছে, যা দেশের রাজনীতিতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তুলে ধরে।

বস্তুত এসব সুপারিশ কার্যকর করার মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পথ উন্মুক্ত হবে। সনদে সংবিধান ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব রয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য একটি জবাবদিহিমূলক, গণতান্ত্রিক ও জনমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে সংবিধান সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এতে রয়েছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি রচনা করবে। সুপারিশমালায় বলা হয়েছে, নির্বাচিত সংসদ-সদস্যরা প্রথম অধিবেশন শুরুর ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই সনদ অনুসারে সংবিধান সংশোধন করবেন। এই সময়ের মধ্যে তারা সংবিধান সংশোধনে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে। এরপর ৪৫ দিনের মধ্যে পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। সরকার গঠনের পর থেকে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়নে সময় লাগবে ৩১৫ দিন। সুপারিশে আরও বলা হয়, সনদ বাস্তবায়নে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে ভিত্তি ধরে সরকার একটি আদেশ জারি করবে, যার নাম হবে-‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’। সনদের চূড়ান্ত আইনি ভিত্তি দিতে গণভোট হবে। গণভোটের সময় সরকার নির্ধারণ করবে।

তবে এ প্রক্রিয়ায় চ্যালেঞ্জও কম নয়। সুপারিশে গণভোট আয়োজনের জন্য আইন প্রণয়নের প্রস্তাব রয়েছে, যা ইতোমধ্যে কিছু মহলে রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করছেন, এমন একটি সিদ্ধান্ত দেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাড়ছে। কিছু দল আবার স্বাক্ষরিত সনদের বাইরে সুপারিশে নতুন কিছু যুক্ত করার অভিযোগও তুলেছে। এ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য প্রয়োজন হবে অত্যন্ত ধৈর্য ও বিচক্ষণতা। তাদের নিশ্চিত করতে হবে যেন সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি সর্বজনীন হয় এবং কোনো পক্ষ যেন কোণঠাসা অনুভব না করে। ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়েছিল বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য, তাই সনদের বাস্তবায়ন যেন সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হয়।

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন কেবল একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়, এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুশাসনের প্রতি জাতির অঙ্গীকারের প্রতিফলন। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে কমিশনের সুপারিশগুলোকে জাতীয় স্বার্থ ও বৃহত্তর ঐকমত্যের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা এবং সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও স্থিতিশীল পথ বেছে নেওয়া। সংঘাত নয়, আলোচনার মাধ্যমেই এ দেশের রাজনীতিকে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। জাতি এখন তাকিয়ে আছে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের দিকে। এ সনদ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে তা একটি নতুন দিনের সূচনা করবে বলে আশা করা যায়।

সূত্র, যুগান্তর