শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ছিল বহুল আলোচিত বিষয়। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ও সরকারি বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালান।

মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এ কারণে ট্রাইব্যুনালের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে স্পর্শকাতরও বটে। সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যাতে চলমান বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

২.

গত ৩০ আগস্ট রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে সরকারের গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন এবং জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) যৌথভাবে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। সেই বৈঠকে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আগামী নির্বাচিত সরকার জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত অপরাধ এবং গুম-খুনসহ আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে অগ্রসর হবে কি না, সে জন্য তাড়াহুড়া করতে হচ্ছে। ফলে যতটা নিখুঁতভাবে এই কাজটা করা দরকার ছিল, তা কিন্তু আমি হয়তো করতে পারব না। অনেক বেশি রাশ (তাড়াহুড়া) করতে হচ্ছে।’ (মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে তাড়াহুড়া করতে হচ্ছে: চিফ প্রসিকিউটর, সমকাল অনলাইন, ৩১ আগস্ট ২০২৫)

তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘নতুন বাস্তবতায় আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে, এই চিন্তাগুলো যদি আমাদের করতে না হতো, তাহলে খুব ভালো হতো। সেটা হচ্ছে যে ফেব্রুয়ারিতে ইলেকশন (নির্বাচন) হবে, নির্বাচিত সরকার আসবে, তারা যদি এই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে অগ্রসর না হয়। কেন এই চিন্তাটা আমাদের করতে হচ্ছে?...আমরা ধরে নিচ্ছি ফেব্রুয়ারিতে নতুন গভর্নমেন্ট (সরকার) এলে এই প্রসিকিউশন টিম বা এই বিচারব্যবস্থা নিয়ে অগ্রসর হবে না।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ৩০ আগস্ট ২০২৫)

তাজুল ইসলামের উপরোক্ত বক্তব্যের দুটি দিক আছে। প্রথমত, তিনি তাঁর বক্তব্যে স্বীকার করেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে তাড়াহুড়া করা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, তাড়াহুড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাজুল ইসলাম বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে নতুন সরকার আসবে এবং নতুন সরকার বর্তমান প্রসিকিউশন টিম বা এই বিচারব্যবস্থা নিয়ে অগ্রসর হবে না।

৩.

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের তাড়াহুড়া করা এবং সেই কারণে নিখুঁত না হওয়ার সম্ভাবনা খুবই গুরুতর বিষয়। চিফ প্রসিকিউটর নিজেই এ বিষয় স্বীকার করায় আসামি পক্ষ তা থেকে নানাভাবে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তে সংক্ষুদ্ধ হলে চিফ প্রসিকউটরের বক্তব্যের সূত্র ধরে আসামি পক্ষ এমনটা বলতেই পারে, প্রসিকিউশনের তাড়াহুড়ার কারণে আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ পাওয়া যায়নি এবং অস্বাভাবিক দ্রুততায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাজা দেওয়া হয়েছে। আর প্রসিকিউশনের কাজ নিখুঁত না হলে বা তাতে খুঁত থাকলে, আসামিপক্ষই যে লাভবান হবে, সেটা বলা বাহুল্য।

বিচারপ্রক্রিয়ায় তাড়াহুড়া করা নিয়ে চিফ প্রসিকিউটর যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত? তাঁর বক্তব্য অনুসারে, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে প্রসিকিউশন টিম পুর্নগঠন করা হতে পারে এবং সেই কারণে তিনি তাড়াহুড়া করছেন। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে, তিনি কেন মনে করছেন, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে বর্তমান প্রসিকিউশন টিমকে বাদ দিয়ে নতুন প্রসিকিউশন টিম নেওয়া হবে? আর নির্বাচিত সরকার যদি পরবর্তী সময় সে রকম কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকে, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? তিনি কেন নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না?

ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে একটি সম্পাদকীয় লিখেছে। সেখানে তাঁর বক্তব্যকে ‘ইমম্যাচিওরড’ (অকালপক্ব) এবং ‘অ্যালার্মিং’ (আতঙ্কজনক) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে ‘তাড়াহুড়া’ করার বিষয়টিকে ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলা হয়েছে।

৪.

৩০ আগস্ট আরেকটি অনুষ্ঠানে চিফ প্রসিকিউটর মানবতাবিরোধী কয়েকটি মামলার বিচার কবে সম্পন্ন হবে, তা নিয়ে মন্তব্য করেন। ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকস (দায়রা) আয়োজিত বেঙ্গল ডেলটা কনফারেন্স ২০২৫-এর দ্বিতীয় দিনে প্যানেল আলোচক হিসেবে তিনি বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার ২৩ সদস্য যাঁরা আগে কখনো মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত করেননি, তাঁদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বর্তমানে তদন্ত সম্পন্ন করা হচ্ছে। এখন বিচারকাজের গতি যেভাবে চলছে, তাতে বলা যায়, আগামী ফেব্রুয়ারিতে ৮ থেকে ১০টি মামলার বিচার সম্পন্ন সম্ভব।’ (ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৮ থেকে ১০টি মানবতাবিরোধী মামলার বিচার শেষ হবে: চিফ প্রসিকিউটর, টিবিএস বাংলা, ৩০ আগস্ট ২০২৫)

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কোন মামলার বিচার কখন সম্পন্ন হবে, তা নিয়ে চিফ প্রসিকিউটরের মন্তব্য করা কতটা বিবেচনাপ্রসূত? এটা ভুলে গেলে চলবে না, এসব মামলার বিচার করবে ট্রাইব্যুনাল বা আদালত এবং বিচারের জন্যে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া (যেমন তদন্ত, সাক্ষ্য গ্রহণ, যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন) অনুসরণ করতে হবে। এসব প্রক্রিয়া কখন শেষ হবে, সেটা আগে থেকে বলে দেওয়া বা খুব সহজে অনুমান করা যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো নির্ভর করে উদ্ভূত পরিস্থিতির ওপর। সাধারণভাবে বাংলাদেশে বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে।

‘তাড়াহুড়া’ করা এবং ‘খুঁত থেকে যাওয়ার আশঙ্কা’ নিয়ে চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের পর জনমনে এমন প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কি নিখুঁতভাবে চলছে, নাকি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠবে? বিচারপ্রক্রিয়ায় খুঁত থাকার কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধীরা কোনোভাবে ছাড় পাবেন না তো? বিচারকে কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডার সঙ্গে যুক্ত করার কোনো চেষ্টা হচ্ছে কি?

লক্ষণীয় হলো, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা মামলাগুলোর মধ্যে তিন থেকে চারটির রায় অক্টোবরের মধ্যে হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। (তিন থেকে চারটি মামলার রায় অক্টোবরের মধ্যে, আশা আইন উপদেষ্টার, প্রথম আলো অনলাইন, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) আইন উপদেষ্টার ওই বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার বলেছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্বাধীন। কারও ধার ধারে না। আমরা কারও কথাও শুনব না। এ ধরনের বক্তব্য বিচার নিয়ে বিরূপ ধারণা তৈরি করবে।’ (আসিফ নজরুলের বক্তব্যে ট্রাইব্যুনালের অসন্তোষ প্রকাশ, চ্যানেল টুয়েন্টিফোর অনলাইন, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)

কোনো মামলার বিচার সম্পন্ন হওয়া বা রায় দেওয়ার সময়সীমা আগে থেকে অনুমান করা যায় না বলে তা নিয়ে কারও মন্তব্য করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি তেমনটা করে থাকেন, তাহলে ‘আইনের নিজস্ব গতি’ বা আদালতের কার্যধারাকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে, এমনটা প্রতীয়মান হতে পারে। এ কারণেই চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে লেখা ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে:

‘ফেব্রুয়ারি মাসে নির্ধারিত নির্বাচনের আগে হাতে এখনো ছয় মাসের কম সময় বাকি। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই একটি “রোডম্যাপ” ঘোষণা করেছে, যেখানে ওই মাসের প্রথমার্ধে ভোট আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতিমূলক ধাপ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু বিচার কার্যক্রমকে কোনো সময়সীমার মধ্যে বেঁধে দেওয়া যায় না, কারণ, এতে তার সঠিকতা ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। জুলাই মাসের গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধের বিচার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত গুমের মামলাগুলো দ্রুত শেষ করার জন্য জনমতের চাপ স্পষ্ট থাকলেও প্রসিকিউটরদের জন্য অত্যন্ত জরুরি হলো এই চাপের প্রভাবে প্রভাবিত না হওয়া। শুধু তখনই এসব বিচার ভুক্তভোগী এবং অভিযুক্ত উভয়ের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবে। অন্যথায়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিচার প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাবে।’ (জুলাই ট্রায়ালস মাস্ট নেভার বি কম্প্রোমাইজড: কনসার্নস রেইজড বাই আইসিটি চিফ প্রসিকিউটর ওয়ারেন্ট স্ক্রুটিনি, দ্য ডেইলি স্টার, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫)

৫.

‘তাড়াহুড়া’ করা এবং ‘খুঁত থেকে যাওয়ার আশঙ্কা’ নিয়ে চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের পর জনমনে এমন প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কি নিখুঁতভাবে চলছে, নাকি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠবে? বিচারপ্রক্রিয়ায় খুঁত থাকার কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধীরা কোনোভাবে ছাড় পাবেন না তো? বিচারকে কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডার সঙ্গে যুক্ত করার কোনো চেষ্টা হচ্ছে কি?

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব নেন তাজুল ইসলাম। এর আগপর্যন্ত তিনি ছিলেন এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক। এ কারণে তাঁর বক্ত্যবে যে কেউ রাজনীতির সংযোগ খুঁজে পেতে পারেন। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, বাংলাদেশে আইন-আদালত-বিচার অনেক সময়ই রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থাকতে পারেনি।

অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে। ঘোষিত সময়ে নির্বাচন হওয়া বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে বিগত সরকারের আমলে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়াও সচ্ছতার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই বিচার এবং নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর সুযোগ নেই।

সূত্র, প্রথম আলো