প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে যেসব রাজনীতিক জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গেছেন, তাঁদের কেউ কেউ হেনস্তার শিকার হয়েছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্যসচিব আখতার হোসেনের গায়ে ডিম ছুড়ে মারা হয়েছে। তাঁর হোটেলের লবিতেও আক্রমণের চেষ্টা হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও এনসিপি নেত্রী তাসনিম জারার উদ্দেশে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। আমরা তীব্র ভাষায় এর নিন্দা জানাই।
অতীতে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সরকারপ্রধানের যোগদান নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ঘটনা ঘটেছে। এক পক্ষ নিন্দাবাদ দিয়েছে, আরেক পক্ষ জিন্দাবাদ দিয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে কারও ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। এর মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তলানিতে এসে ঠেকল।
প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিস ও দূতাবাস কর্মকর্তাদেরও দায় ছিল। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, তারা প্রধান উপদেষ্টার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করবে। এই প্রেক্ষাপটে অতিথিদের যে ধরনের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেটা হলো না কেন? সরকার যতই ব্যাখ্যা দিক বা দুঃখ প্রকাশ করুক, এ প্রশ্ন থেকেই যাবে।
অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার বিরাট লটবহর নিয়ে জাতিসংঘে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সরকারি নথি অনুযায়ী, নিরাপত্তা দল, কর্মকর্তাসহ এবার তাঁর সফরসঙ্গীর তালিকায় রয়েছেন ১০৪ জন। তবে সফরসংক্রান্ত পুস্তিকা অনুযায়ী এ সংখ্যা ৬২। বাকিরা কি সরকারের বাইরের কেউ?
রাজনৈতিক সরকারগুলোর সময়ে সাধারণত এ ধরনের সফরে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও পছন্দের লোকজন যেতেন। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরাও নিজ খরচে সফরে যুক্ত হতেন। প্রধান উপদেষ্টাও সেই ধারা ফিরিয়ে আনলেন? গত বছর যেখানে তাঁর প্রতিনিধিদলে ৫৭ জন ছিলেন, সেখানে এবার প্রায় দ্বিগুণ করার কী কারণ থাকতে পারে? প্রধান উপদেষ্টার প্রেস টিমেরই পাঁচজন সদস্য নিউইয়র্কে গেছেন। এ নিয়ে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে তাঁরা ক্ষুব্ধ হন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিরাট লটবহরের সমালোচনা করে বলেন, ‘পতিত কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে শতাধিক প্রতিনিধি পাঠানোর সংস্কৃতি দেখা গেছে। কখনো কখনো সে সংখ্যা দুই শতাধিক ছাড়িয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, রক্তক্ষয়ী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত সরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পথে হাঁটবে; কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমান সরকারও সেই পুরোনো পথই অনুসরণ করছে।’ টিআইবির মতে, বিরাট প্রতিনিধিদল নেওয়ার উদ্দেশ্য কূটনৈতিক প্রয়োজন নয়, বরং ‘ভ্রমণবিলাস’।
গণ-অভ্যুত্থানের পর যে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন নিয়ে গঠিত হয়েছে, সেই সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন দেখাতে নেতাদের সাত সমুদ্রের ওপারে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। দেশের ভেতরেই আলোচনা করে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করা যেত। কিন্তু বহু আলোচনা ও বৈঠকের পরও যে কাজটি হয়নি, তার কারণ সরকারের দোদুল্যমানতা ও অস্থিরতা।
ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রশ্ন তোলেন, জনগণের করের টাকায় এই ব্যয়ের যৌক্তিকতা কী? এসব প্রশ্নের জবাব রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের অবশ্যই দেওয়া উচিত।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের নির্ধারিত বক্তৃতার সময় সফরসঙ্গীদের মধ্যে কয়েকজনের উপস্থিতির সুযোগ থাকে। তাহলে অন্যরা কেন গেলেন?
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, অতীতে রাজনৈতিক সরকারের আমলে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষে ১৫০ থেকে ২০০ জন প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়েছেন। ২০১৪ সালে ১৮০ জন সফরসঙ্গী নিয়ে নিউইয়র্কে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৯ সালে ২৯২ জন সফরসঙ্গী নিয়ে নিউইয়র্কে যান তিনি। তবে ২০০৭-০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সফরসঙ্গীর কলেবর ছোট ছিল। প্রথমে জানানো হয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টা মাত্র ১৪–১৫ জন প্রতিনিধি নিয়ে জাতিসংঘে যাবেন। সেটি সম্ভব হয়নি। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানালেন, নিরাপত্তাসহ কিছু বিষয় আছে, চাইলেও তা এড়ানো যায় না।
তিনটি দলের ছয় নেতাকে সফরসঙ্গী করার বিষয়টি নিয়েও বিতর্ক কম নয়। নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে সরকার ৩০টির মতো দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তাহলে কোন মাপকাঠিতে তিনটি দলকে বেছে নেওয়া হলো? বাদ পড়া বেশ কটি দলের নেতারা এ নিয়ে উষ্মা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানদের ভাষণ একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। যখন যে দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান বক্তৃতা দেন, সেই দেশের বাইরের প্রতিনিধি তেমন থাকেন না। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। উদ্বোধনী অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষণের সময় কক্ষ প্রায় পূর্ণ ছিল। অতীতে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো, লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি কিংবা রাশিয়া ও চীনের প্রতিনিধিদলের নেতার ভাষণের সময় অনেক দেশের প্রতিনিধি থাকতেন। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নেতা সে রকম চমক দেখাতে পারেননি। তবে বিরাট লটবহর নিয়ে জাতিসংঘে যাওয়ার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে চলেছেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, পাকিস্তান, ফিনল্যান্ড ও কসোভোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের কাছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর তথা আগামী নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে কথা বলেছেন। ট্রাম্পের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও থাকবেন। কিন্তু ওভাল হাউসে দক্ষিণ এশিয়ার যে নেতা মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সুযোগ পেয়েছেন, তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। সম্প্রতি বেইজিংয়ে চীন, রাশিয়া ও ভারতের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে যে শীর্ষ বৈঠক হলো; পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক সম্ভবত তারই জবাব।
যেকোনো দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে কিছু অর্জন তো আছেই। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আমরা বাণিজ্য শুল্ক কমাতে পেরেছি, এটাও সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু চীন, ভারত ও রাশিয়ার ত্রিপক্ষীয় মৈত্রীর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ততটা বন্ধু ভাবেনি, যতটা ভেবেছে পাকিস্তানকে। ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধেও ট্রাম্প সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটে একটি কথাও বলেননি। বরং মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ওপর যে বিধিনিষেধ ছিল, তা শিথিল করেছেন। রোহিঙ্গা সংকটে আমরা চীন বা ভারতকে পাশে পাাইনি। পশ্চিমা সমর্থনও কমে যাচ্ছে। এই হলো বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্যের গল্প!
প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে দ্বিতীয়বার যে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার বৈঠক করলেন, সেটি হলো পাকিস্তান। তাঁরা সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলেছেন। দেশটির দুজন মন্ত্রীও কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন; কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশ গঠনে রাজনৈতিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ রয়েছে, আন্তর্জাতিক মহলে এমন বার্তা দিতে চেয়েছে সরকার। প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ বিবিসিকে বলেছেন, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দলীয় প্রভাব এবং দলীয় সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই প্রতিনিধি ঠিক করা হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের পর যে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন নিয়ে গঠিত হয়েছে, সেই সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন দেখাতে নেতাদের সাত সমুদ্রের ওপারে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। দেশের ভেতরেই আলোচনা করে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করা যেত। কিন্তু বহু আলোচনা ও বৈঠকের পরও যে কাজটি হয়নি, তার কারণ সরকারের দোদুল্যমানতা ও অস্থিরতা।
● সোহরাব হাসান সাংবাদিক ও কবি