জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনাপ্রবাহ জনমানসে একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন জাগিয়েছে; এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিটি খাতে অগ্রগতি, ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হবে। এই রূপান্তরের পটভূমি স্বাস্থ্য খাত ও এর পেশাজীবীদের ভূমিকা নতুনভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখছে।
একটি মৌলিক প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে, যাঁরা জীবন রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন, সেই চিকিৎসকেরা কি তাঁদের পেশার মর্যাদা, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ অক্ষুণ্ন রাখতে পারছেন? নাকি রাজনীতির ক্রমবর্ধমান প্রভাব তাঁদের এই দায়িত্ব পালনে একটি অদৃশ্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে?
২.
চিকিৎসা পেশা কেবল একটি পেশা বা আয়ের উৎস নয়, এটি মানবিকতার একটি জ্বলন্ত প্রতীক। একজন চিকিৎসকের কাছে রোগীর জীবন সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। তাঁর দায়িত্ব শুধু রোগ নিরাময় নয়, বরং আস্থা, সহানুভূতি ও আশার বাতিঘর হয়ে ওঠা।
এই পেশার মর্যাদা এবং চিকিৎসকদের অধিকার রক্ষার জন্য গঠিত সংগঠনগুলোর উদ্দেশ্য ছিল পেশাগত কল্যাণ নিশ্চিত করা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই সংগঠনগুলো আজ রাজনৈতিক প্রভাবের কবলে পড়ে তাদের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), ড. অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টসহ (এনডিএফ) প্রায় সব চিকিৎসক সংগঠন কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িত। এ সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড এখন আর চিকিৎসকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নয়, বরং রাজনৈতিক দলের প্রভাব বিস্তার এবং কর্তৃত্ব ধরে রাখার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
এই রাজনৈতিক প্রভাব চিকিৎসকদের পেশাগত জীবনের প্রতিটি স্তরে গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে। পদায়ন, প্রমোশন (পদোন্নতি) ও বদলি, যা একজন চিকিৎসকের জন্য মেধা, অভিজ্ঞতা ও পেশাগত দক্ষতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়া উচিত, এখন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল। একজন চিকিৎসকের পেশাগত উন্নতি এখন তাঁর যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যের ওপর বেশি নির্ভর করে।
এই পরিস্থিতি একটি গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। স্বাচিপ নামের চিকিৎসকদের সংগঠন দীর্ঘ দেড় দশক ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় স্বাচিপ কি দলের ভাবমূর্তি উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে, নাকি এর বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতির অভিযোগ দলের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে?
একইভাবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত চিকিৎসকদের সংগঠনগুলো কি সত্যিই চিকিৎসক–সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছে, নাকি তারা দলীয় আনুগত্যের ‘অন্ধকারে’ তাদের স্বাধীনভাবে নেতৃত্বের দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে?
৩.
বাংলাদেশের চিকিৎসক–সমাজ দেশের সবচেয়ে মেধাবী ও সম্মানিত অংশের অন্যতম। তাঁদের জ্ঞান, দক্ষতা ও নিষ্ঠা স্বাস্থ্য খাতের মেরুদণ্ড। তাঁরা সমাজের সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্তে আশার আলো হয়ে ওঠেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিভাজন ও দলীয় কোন্দলের কারণে অনেক যোগ্য চিকিৎসক নেতৃত্বের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এই বিভাজন শুধু চিকিৎসকদের পেশাগত জীবনকে প্রভাবিত করছে না, বরং তাঁদের সামাজিক অবস্থানকেও দুর্বল করছে। স্বাস্থ্য খাতে সুশাসন ব্যাহত হচ্ছে এবং জনগণের মধ্যে চিকিৎসকদের প্রতি আস্থা ক্রমেই কমছে। একজন চিকিৎসকের ভাবমূর্তির অবনমন কেবল তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, এটি সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের জন্যও একটি রাজনৈতিক দায়ে পরিণত হয়েছে।
এই রাজনৈতিক প্রভাব শুধু চিকিৎসকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি পুরো স্বাস্থ্য খাতের ওপর একটি অন্ধকার ছায়া ফেলেছে। জনগণ এখন চিকিৎসকদের রোগীকেন্দ্রিক নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বলে মনে করছে। এ আস্থার সংকট বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। কারণ, বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা এমনিতেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার সীমিত অবকাঠামো, চিকিৎসক ও নার্সের ঘাটতি এবং চিকিৎসার উচ্চ ব্যয় ইতিমধ্যেই জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা অধিকারকে কঠিন করে তুলেছে। এর মধ্যে চিকিৎসকদের প্রতি আস্থার ক্ষয় স্বাস্থ্য খাতের জন্য আরও বড় সংকট সৃষ্টি করছে।
উপরন্তু মেধাভিত্তিক নেতৃত্বের অভাব স্বাস্থ্য খাতে উদ্ভাবন ও সংস্কারকে বাধাগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে বাড়ছে স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কার্যকর নীতি বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, যেমন বিএনপি, স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের জন্য উচ্চাভিলাষী প্রস্তাব দিয়েছে। বিএনপির ৩১ দফা পরিকল্পনা এর একটি উদাহরণ। কিন্তু এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি মৌলিক পূর্বশর্ত রয়েছে—জবাবদিহিমূলক, পেশাভিত্তিক ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ শর্ত পূরণ না হলে এই পরিকল্পনাগুলো কেবল কাগজে-কলমে থেকে যাবে।
৪.
এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী? চিকিৎসক–সমাজকে এখন আত্মমূল্যায়নের পথে হাঁটতে হবে। তাঁদের সংগঠনগুলো রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হতে পারে, কিন্তু তাদের প্রাথমিক আনুগত্য হতে হবে পেশার নৈতিকতা, স্বাধীনতা ও পেশাগত স্বার্থের প্রতি। এর জন্য প্রয়োজন গঠনমূলক সংলাপের একটি সংস্কৃতি।
চিকিৎসকদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত, যেখানে তাঁরা তাঁদের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করবেন এবং সমাধানের পথ খুঁজবেন। মনে রাখতে হবে, এ দেশের জনগণ চিকিৎসকদের রাজনীতি করাকে পছন্দ করে না, যা সম্প্রীতি বিবিএসের জরিপেও উঠে এসেছে। এই সংলাপের মাধ্যমে চিকিৎসক–সমাজ এই পেশার প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারে।
বাংলাদেশ যখন তার নতুন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে, চিকিৎসা পেশা একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এটি স্থবিরতার সময় নয়। এখন প্রয়োজন আত্মমূল্যায়ন, গঠনমূলক সংলাপ এবং সাহসী পদক্ষেপ। ন্যায়, জবাবদিহি ও মানবিকতার ভিত্তিতে গড়া একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন চিকিৎসা পেশার এই পুনর্জাগরণের ওপর নির্ভর করছে। এ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব এখন চিকিৎসক–সমাজের হাতে।
একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব গঠন। এমন নেতৃত্ব, যারা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হবে এবং পেশাদারত্ব ও মানবিকতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হবে। এই নেতৃত্ব স্বাস্থ্য খাতে একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে, নতুন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে, যেখানে রোগীদের সেবা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হলে চিকিৎসকেরা তাঁদের প্রকৃত ভূমিকা—নিরাময়কারী ও কল্যাণকামী হিসেবে—পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।
চিকিৎসা পেশাকে রাজনীতিমুক্ত করার বিষয়টির গুরুত্ব শুধু চিকিৎসা পেশার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি জাতীয় পর্যায়ে তাৎপর্যপূর্ণ। একটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা জাতীয় সুশাসনের মূল স্তম্ভ হতে পারে।
এটি প্রমাণ করবে যে বাংলাদেশ এমন প্রতিষ্ঠান গড়তে সক্ষম, যেগুলো রাজনৈতিক অভিজাতদের স্বার্থের পরিবর্তে জনগণের সেবায় নিয়োজিত। চিকিৎসকদের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ, তাঁদের ভূমিকা ও উত্তরাধিকারকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার। তাঁরা রাজনৈতিক খেলার পাশা নয়, বরং একটি স্বাস্থ্যকর, ন্যায়ভিত্তিক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক হতে পারেন।
বাংলাদেশ যখন তার নতুন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে, চিকিৎসা পেশা একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এটি স্থবিরতার সময় নয়। এখন প্রয়োজন আত্মমূল্যায়ন, গঠনমূলক সংলাপ এবং সাহসী পদক্ষেপ। ন্যায়, জবাবদিহি ও মানবিকতার ভিত্তিতে গড়া একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন চিকিৎসা পেশার এই পুনর্জাগরণের ওপর নির্ভর করছে। এ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব এখন চিকিৎসক–সমাজের হাতে।
৫.
প্রশ্ন হলো, এ বিষয়ে রাষ্ট্রের করণীয় কী? সংবিধানের ১৫ ও ১৮ অনুচ্ছেদে স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ফলে স্বাস্থ্য খাতে রাজনৈতিক প্রভাব বা দলীয় সম্পৃক্ততা যদি জনস্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তবে তা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার শামিল।
এ ক্ষেত্রে সরকার বিএমডিসির (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) সহযোগিতায় অনলাইন ভোটাভুটির মাধ্যমে চিকিৎসকেরা দলীয় রাজনীতি করা সমর্থন করেন কি না, তা যাচাই করতে পারে। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, সুবিধাভোগী বা সুবিধাপ্রত্যাশী মুষ্টিমেয় চিকিৎসক ছাড়া সবাই দলীয় রাজনীতির বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে চান।
তবে রাষ্ট্রের প্রধান করণীয় হলো আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা পেশায় দলীয় রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঠেকানো। ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সরকারি ও আধা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া আইনত নিষিদ্ধ।
এই বিধান স্বাস্থ্য খাতেও সমভাবে প্রযোজ্য এবং কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রকে একটি শক্ত অবস্থান নিতে হবে। বিশেষ করে, যাঁরা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত, তাঁদের বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা কোনো সরকারি ও সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের সুযোগ না দেওয়া রাষ্ট্রের নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব।
এ ছাড়া রাষ্ট্রকে একটি সমন্বিত ও সর্বদলীয় উদ্যোগ নিতে হবে, যেখানে সব রাজনৈতিক দল একটি অভিন্ন নীতিতে একমত হবে যে চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য খাতকে দলীয় রাজনীতিমুক্ত রাখা হবে। এই লক্ষ্যে রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্ব, বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা বা সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একটি বাস্তবসম্মত সংস্কার কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে।
জনস্বার্থে স্বাস্থ্য খাতে টেকসই সংস্কার নিশ্চিত করতে হলে দলীয় প্রভাবমুক্ত, পেশাগত স্বচ্ছতা ও সুশাসনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের নেতৃত্বে দৃঢ় পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং আহ্বায়ক, অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (এএইচআরবি)