মুক্তচিন্তার অভিভাবক কাজী মোতাহার হোসেনের অনেকগুলো পরিচয়। তিনি পরিসংখ্যানবিদ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক এবং একজন খ্যাতিমান দাবাড়ু। আজ ৯ অক্টোবর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনটিকে স্মরণ করে প্রকাশ করা হলো তাঁরই কন্যা সন্‌জীদা খাতুনের স্মৃতিচারণ। সন্‌জীদা খাতুনও আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি মারা গেছেন চলতি বছরেরই ২৫ মার্চ। এই লেখাটি প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘আমার আব্বু’ থেকে নেওয়া।

কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭—৯ অক্টোবর ১৯৮১)ছবি: নাসির আলী মামুন/ ফটোজিয়াম

বোধশোধ জাগবার পরে মায়ের চেয়ে আব্বুকেই পেয়েছিলাম বেশি আপন করে। মায়ের হাতে সময় ছিল কম। চাচা-ফুফু সবাই এবং তারপরে আমাকে নিয়ে আধ ডজন সন্তানের সুবিশাল সংসারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপরে।

সংসারে বাবার কাজের মধ্যে, মাসের বাজারের ফর্দটি হাতে নিয়ে ‘হাট’ করে আনা। বস্তায় বস্তায় চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ; ওদিকে তেল, গুড় ইত্যাদি ইত্যাদি। তা-ও কত দিন পথের মধ্যে কোথাও দাবার ছক পাতা দেখলে সাইকেল থেকে নেমে পড়ে বিশ্বসংসার ভুলে গেছেন। অসময়ে অবেলায় শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে বেচারা-মুখ করে আম্মুর বকুনি শুনে অস্বস্তি ঢাকবার জন্য বারবার করে নাকের ঘাম মুছতে লেগেছেন।

সাইকেলখানা ছিল তাঁর জীবনের দীর্ঘকালীন সঙ্গী। পুরোনো দিনের মানুষেরা তাঁর সাইকেল-আরোহী রূপটিই দেখেছেন। মধ্যবয়স পার হয়ে অবসরজীবনে প্রবেশ করেও বহুদিন ওই সাইকেলই ছিল তাঁর বাহন। হাঁটতেও কোনো ক্লান্তি ছিল না, গ্রামের ছেলে যে! শুনেছি কয়েক ক্রোশ হেঁটে স্কুলে যাওয়া-আসা করেছেন অক্লেশে। স্বাস্থ্য ভালো ছিল, জোর ছিল গায়ে। কুস্তির অভ্যাসও ছিল, বলতেন ‘মালাম ধরতাম’। কাজেই শারীরিক কাঠামো একেবারে মজবুত।

বাড়ির কেলেকিষ্টি মেয়েটির দিকে তাঁর খুব নজর ছিল। পাছে রংচেহারা নিয়ে মনে কষ্ট পাই, তাই বেশি বেশি আদর দিতেন। মুখখানা মলিন দেখলেই কোলে তুলে জিজ্ঞেস করতেন—কী হয়েছে মা? ভাইবোনদের কেউ কিছু করেছে শুনলে জোর হাঁক দিতেন, ‘কে রে’! এই পর্যন্ত। মারধর করেছেন এমন স্মৃতি নেই ছেলেবেলার। আম্মু কড়া মানুষ। পাছে রোদে রোদে ঘুরে বেড়াই, তাই দুপুরবেলায় ছোট্ট চিমটে হাতে ধরিয়ে বলতেন, ‘খাড়া খাড়া পাকা চুলগুলো তোলো।’ ব্যস, বন্দী! নড়বার উপায় থাকত না।

আমাদের বাড়িতে ওস্তাদজি আসতেন সপ্তাহে দুদিন। বড় দিদি কিছু রাগ-রাগিণী আর গজল শিখতেন। তা ছাড়া রেকর্ড থেকে তুলতেন নানা গান। কিছু রবীন্দ্রসংগীত আর সন্তোষ সেনগুপ্তের গাওয়া আধুনিক গান। ‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা/ মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল’—বড় প্রিয় গান ছিল তাঁর।

বড়দির সূত্রে নজরুলের কথা এসে যায়। আমি তাঁকে বাড়িতে দেখিনি। কিন্তু বড়দির গলায় অজস্র নজরুলগীতি শুনেছি আশৈশব। আম্মু বলতেন, পাঁচ বছরের নাজুকে কোলে বসিয়ে ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল’ গাইয়েছিলেন এক আসরে নজরুল ইসলাম। নজরুলকে আম্মু খুব ভয় পেতেন। বলতেন, ‘ওই বড় বড় চোখ, ওরে বাবা! গায়ের মধ্যে কাঁটা দেয়!’

তখন আব্বুরা বর্ধমান হাউসে থাকেন। আমার জন্মই হয়নি। ত্রিশ-একত্রিশ সালের কথা বোধকরি। বর্ধমান হাউসটা ছিল ছাত্রাবাস। আব্বু ছিলেন ছাত্রদের তদারকিতে। পুরোনো বাড়িটার পূর্ব দিকটায় হাউস টিউটরের বাস। পূর্ব-দক্ষিণ কোণের ঘরটায় ছিলেন নজরুল। সেটা ছিল আব্বু-আম্মুর শোবার ঘর। আম্মুকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে ওই ঘরটাতে আব্বু থাকতেন নজরুলের সঙ্গে।

আম্মুকে কিছুতেই নজরুলের সামনে বার করা যায় না। একদিন কায়দা করে আম্মুকে আব্বু নিয়ে এসেছেন বাইরের ঘরে, কিছুক্ষণ পরে নজরুল নিরীহ মুখে এসে ঢুকেছেন বাইরে থেকে। আম্মু একছুটে পালান আরকি। আব্বুও অমনি হাত চেপে ধরেছেন। নজরুল নাকি একবার চেয়ে দেখে ধীরে চোখ নামিয়ে নিয়েছিলেন। তারপরে আম্মু ছাড়া পেয়ে ভেতরে চলে যেতেই হা হা অট্টহাসি তাঁর। নজরুল এলেই আব্বুর ঘর থেকে আম্মুর নির্বাসন হতো বলে নজরুল আম্মুকে ‘সতিন’ বলতেন।

আমার জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার আগে সেগুনবাগিচার বাড়িতেও নজরুল এসেছেন শুনেছি। এ বাড়িতে কবি জসীমউদ্দীনও আসতেন। ঢাকায় দিলীপ রায় এলে এ বাড়ি থেকেই বড়দিদের সাজিয়ে-গুজিয়ে গান শুনতে নিয়ে যেতেন আব্বু। একবার আমি, রীনা আর সেজদিও গিয়েছিলাম আবছা মনে পড়ে।

আব্বাসউদ্দীন সাহেব এসেছেন, মনে পড়ে। এসেছেন সেই জাদুকর গায়ক কে. মল্লিক। তখন কিন্তু আব্বু ঠিকঠাক সৌজন্য করতেন সবার সঙ্গে। তারপরে যতই লেখাপড়া আর দাবাতে ডুবতে লাগলেন, ততই ভোলাভুলি বেড়ে চলল।

কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭—৯ অক্টোবর ১৯৮১)।

কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭—৯ অক্টোবর ১৯৮১)।ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম

আমার উন্নতদর্শন সুপুরুষ আব্বু তাঁর এই মেয়েটিকে বড় ভালোবাসতেন। বাল্যের স্মৃতি মনে ভাসে—সেগুনবাগানের বাড়ির দক্ষিণ বারান্দায় আমাকে কোলে করে গান গাইছেন আর পায়চারি করছেন, আমি তাঁর বুকের সঙ্গে মিশে থেকে কান পেতে শুনছি সেই গান। সেকালের চলিত গান ‘যখন সঘন গগন গরজে/ বরিষে কড়কা ধারা’ (দ্বিজেন্দ্রলাল) কিংবা ‘জেনেছি জেনেছি মা তারা, তুমি জানো ভোজের বাজি’ (রামদুলাল নন্দী) কেমন গান গাইতেন, সে তখন আমার বিচারের বিষয় ছিল না। আব্বুর গান—এই মাত্র ছিল বোধ। সারা দিনের কর্মব্যস্ততার শেষে ঘরে ফিরে দুবাহু বাড়িয়ে আমাকে কোলে আসবার জন্য আদুরে ভাষায় ডাকতেন, ‘কে রে? কে রে? কে রে? সোনালি নাকি রে!’ কালো বলবেন না, তাই ‘সোনালি’ বিশেষণ!

এই আদরের জন্য দুবছরের বড় রীনার খুব হিংসে হতো। কিন্তু তাতে আমার আদরের কোনোই কমতি হয়নি। ছুটির দিনে দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পরে আমাকে তাঁর পেটের ওপরে মাথা রেখে শুতে বলতেন। নিজে হয়তো কোনো বই পড়ছেন। বলতেন, ‘শোনো তো ওরা কী বলছে পেটের ভিতরে।’ ভাবখানা যেন কিছু কথাবার্তা চলছে, তাই শুনে তাঁকে বলতে হবে। গভীর মনোযোগের সঙ্গে চোঁ চোঁ কুড়ুৎ কুড়ুৎ শুনে বলতাম, ‘কই, কোনো কথা তো বলছে না!’

ক্লাস থ্রিতে পড়বার সময়ে প্রথম কবিতা লিখি। গুরুগম্ভীর সেই ঈশ্বরভক্তির কবিতা দেখে খুশি হয়েছিলেন কি? কে জানে। তবে মনে করতেন, আমি লেখাটেখা বুঝি। আমি বেশ ছোট থাকতেই তাঁর প্রথম লেখা বই সঞ্চরণ উপহার দিয়েছিলেন আমাকে আর সেজদিকে। বাড়িতে এত ভাইবোন থাকতে কেন যে শুধু আমাদের দুজনকেই বই দেওয়া! সেজদি খুব পড়ুয়া ছিলেন তো।

সবার সঙ্গে তত কথাবার্তা না বললেও কে কী করে, সবই খেয়াল করতেন আব্বু। এমনিতে বকতেন না আমাদের। কিন্তু অঙ্ক শিখতে হলেই হতো মুশকিল। বাইরের এত লোককে পরম ধৈর্যের সঙ্গে অঙ্ক করিয়েছেন, আর আমাদের বেলায় একেবারে ধৈর্য মানতে পারতেন না। কিছুক্ষণ বোঝাবার চেষ্টা করে আমাদের ঘোলা চোখ দেখে বলে বসতেন, ‘ইয়ে টিয়ে করে কিচ্ছু হবে না। গা-ধা!’ আর একটা গালি ছিল, ‘শ্ শ্ শ্ শ্ শুয়ার।’ এটা বলতেন ভয়ানক রাগলে। ওঁর ছেলেদের অঙ্কের মাথা ভালোই ছিল। বড়দি আর সেজদি ছাড়া আমরা কয়েক বোন খানিকটা গবেটই ছিলাম অঙ্কের বুদ্ধিতে। তার ওপর আব্বু অঙ্ক নিয়ে বসলেই মাথা আরও গুলিয়ে যেত।

কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭—৯ অক্টোবর ১৯৮১) ফটোজিয়াম; বর্ধমান হাউস, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, মে ১৯৭৮

কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭—৯ অক্টোবর ১৯৮১) ফটোজিয়াম; বর্ধমান হাউস, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, মে ১৯৭৮ছবি: নাসির আলী মামুন

একবার বিকেলের দিকে পুরান ঢাকাতে কাদের বাড়ি গিয়ে যেন আব্বু বসেছেন দাবা খেলতে। আর তো হুঁশ নেই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি, তারপর রাত্রিও পুইয়ে গেল। বড়দি খিদের চোটে অবসন্ন হয়ে এক সময়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। সকাল হতেই ঘোর ভেঙে আব্বু তাড়াতাড়ি বড়দিকে টেনে তুলে রাস্তার কল থেকে চোখে-মুখে পানি দিয়ে নিয়ে গেলেন মিষ্টির দোকানে, ‘কী খাবি খা। তোর আম্মুকে কিন্তু কিচ্ছু বলিস না।’

ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা একাই দাবা খেলতেন। কখনো বই দেখে দেখে, কখনো হাতে একখানা পোস্টকার্ড নিয়ে ছকের ওপর দাবার ঘুঁটি সাজিয়ে।

দ্বিতীয় ব্যাপারটা হলো চিঠিতে দাবা খেলা। সমগ্র ভারতজুড়ে এই চিঠিতে খেলা চলত। এক একখানা পোস্টকার্ডের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকতেন, তারপর ছক সাজিয়ে সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠ চাল বার করে চিঠিতেই সে চাল পাঠিয়ে দিতেন লিখে। দক্ষিণ ভারতের কারও সঙ্গে খেলতেন মনে আছে। পরে সে নিয়ে এক গল্পও শুনেছিলাম এককালের ছাত্ররাজনীতির এক সংগঠকের কাছে।

প্রগতিবাদী ছাত্রদের এক অল ইন্ডিয়া কনফারেন্সে যাচ্ছিলেন সবাই দক্ষিণ ভারতের কোথাও। অবিভক্ত ভারতের সময়কার কথা। কাজী মোতাহার হোসেনের দেখাশোনা করার ভার ছিল নৃপেণ বন্দ্যােপাধ্যায়ের ওপর। কোনো একটা জায়গায় ট্রেন থেমেছে, সবে সকাল হয়েছে তখন। আব্বু নাকি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে স্টেশনের নামটা পড়ে কবার মাথা ঝাঁকালেন। ট্রেন ছেড়ে দেবার খানিকক্ষণ পরে দেখা গেল কাজী মোতাহার হোসেন নেই। মহাদুশ্চিন্তা! ওই আলাভোলা মানুষ কখন বুঝি নেমে পড়েছিলেন আর ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।

পরদিন কনফারেন্সের উদ্বোধন। অনুষ্ঠানের জায়গায় অস্থির পায়চারি করছেন নৃপেণ বাবুরা ‘কী হবে!’ বেলা দশটা নাগাদ একমুখ হাসি নিয়ে শ্মশ্রুমণ্ডিত কাজী সাহেব এসে নৃপেণ বাবুদের জানালেন, ‘চালটা দিয়ে এলাম।’ স্টেশনের নামটা চেনা দেখে নেমে পড়ে ঠিকানা খুঁজে পত্রদাবার এক খেলুড়ের বাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। চাল দেওয়া হয়ে গেলে আর এক ট্রেন ধরিয়ে দিয়েছেন সেই দাবাড়ু পত্রমিতা। দিব্যি সময়মতো পৌঁছে গেছেন। নৃপেণ বাবুদেরই জিজ্ঞেস করছেন, ‘কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’

এই দাবা নিয়ে বাড়িতে হুলুস্থুল লেগে থাকত। আম্মু রেগে বলতেন, ‘দেব সব গুটি আর বোর্ড পুড়িয়ে।’ অবস্থা বুঝে আব্বু কখনো ভেংচি করতেন, ‘হ্যাঁ...ঃ।’ আবার কখনো নাকের ডগা মুছতে মুছতে অপ্রস্ত্ততভাবে পালাতেন সামনে থেকে।

সবচেয়ে বিপদ হতো যখন কাউকে দাওয়াত করে এসেছেন আর আম্মুকে বলেননি কিছু। বেলা দুপুরে মেহমান এল। আব্বুও ঘরে নেই হয়তো। আম্মু বিস্মিত হলেও কথায় কথায় ব্যাপারটা বুঝে নিতেন। নিমন্ত্রিতরাও আব্বুর অনুপস্থিতি দেখে আসল বিষয় আঁচ করে ফেলতেন। তারা ‘আচ্ছা আজ চলি’ বলতে উদ্যত হলেই আম্মুকে বলতে হতো, ‘সেকি! খেয়েদেয়ে যাবেন, এখনই কী!’ ওদিকে ইশারায় রান্নাঘরে খবর হয়ে গেছে, একটু বেশি বেলা হয়ে গেলেও। আম্মু বলতেন ‘বাঙাল কোথাকার! হাড়-মাংস জ্বালিয়ে খেল।’

ভুলো স্বভাবের মজা দেখেছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। একদিন বিকেলে খুব হুড়োহুড়ি করে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেলেন কোনো সভাতে বক্তৃতা করতে। রাত্রে ফিরবার সময় কোমরের কাছটা বারবার টানছেন ওপর দিকে। বিষয় কী? আমার কন্যা ‘কী হয়েছে নানা?’ বলে কাছে গিয়ে দেখে তাড়াহুড়োতে লুঙ্গির নিচ দিয়ে পাজামাটা পরেছিলেন ঠিকঠাক, শুধু লুঙ্গিটা নামিয়ে রাখবার খেয়াল হয়নি! সভাস্থলে সারাক্ষণ নিশ্চয়ই লুঙ্গিটাকে টেনে টেনে কোমরের কাছে রাখতেই ব্যাপৃত থাকতে হয়েছিল!

নাতনিদের সঙ্গে ভাব ছিল জবর। মেজদির মেয়েরা চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে দিব্যি ক্লিপ দিয়ে চুলে ফিতে আটকে দিত। উনি নিরীহভাবে মাথা ঝুুঁকিয়ে সহ্য করতেন সব। আম্মু বলতেন, ‘সঙ!’ আমার দুই মেয়ের মধ্যে নানার নখ কেটে দেবার প্রতিযোগিতা চলত। দুজনের দাবি, তার নখ কাটাই সবচেয়ে ভালো, একটুও ব্যথা লাগে না। আব্বু বড় কাতরভাবে আমাকে চিঠি লিখেছিলেন একবার শান্তিনিকেতনে। ওই প্রতিযোগিতার জন্য ব্যথা-ট্যথা পেলেও আব্বু চুপ করে থাকতেন। লিখেছিলেন, ‘আমি আর রা করিনে।’

আমি খানিকটা বড় হয়ে যাবার পর আব্বু কোনো লেখা লিখলেই আমাকে দিয়ে বলতেন, ‘দ্যাখো তো ভুল-টুল আছে কি না?’ আমিও খুব গম্ভীরভাবে খুঁটিয়ে পড়ে লেখার বিষয়ে মতামত জাহির করতাম। এ কৌশলে আব্বু যে আমাকে গড়ে তুলছেন সে কথা ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি তখন। ওই কৌশলেই ভাইদের অঙ্কে আগ্রহ জাগিয়ে দিতেন।

তখনকার দিনের টেক্সট বুক কমিটি তাদের কাছে জমাপড়া বই বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন শ্রেষ্ঠ বই বেছে দেবার জন্য। অঙ্ক অ্যালজেবরা আর জ্যামিতির বইগুলো আব্বু নবাব-নূরুদের দেখতে দিতেন। ওরা ভালোমন্দ নিয়ে আব্বুর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করত। আমাকে দিতেন ব্যাকরণ আর রচনার বই।

মনে আছে, দুর্গাপূজা বিষয়ে হিন্দু লেখকের লেখাতে আনন্দের সুরের সঙ্গে নিজের পুরো সম্পৃক্তি অনুভব করা যেত। আর ঈদ উৎসব বিষয়ে লিখতে গিয়ে ‘মুসলমানেরা’ ‘ওদের’ ইত্যাদি পদ লিখতেন তাঁরা। আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম উভয় বিষয়ের লেখাতেই ‘আমরা’ ‘আমাদের’ লেখা উচিত। ‘হিন্দুদের’ বা ‘মুসলমানদের’ লিখলে সম্প্রদায়ভেদের কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আব্বুই নিশ্চয় এই বোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন আমার ভেতরে। খুব খুশিও হয়েছিলেন আমার ওই বিচারে।

আর এক বুদ্ধি করেছিলেন আব্বু পরীক্ষার খাতার নম্বর যোগে ভুল আছে কি না, যাচাই করার জন্য। ভুল বার করতে পারলে তার পুরস্কার এক পয়সা। শুনে তাচ্ছিল্য করবার কিছু নেই, সে আমলে এক পয়সাতে অনেক অনেক সওদা হতো। তবে এ পয়সা পেয়ে যাওয়া ছিল দুষ্কর। আব্বুর যোগের ভুল বার করা বলে কথা। অসাবধানতার ভুল একেবারেই হতো না এমনও নয় অবশ্য।

আব্বুতে-আম্মুতে কথা বন্ধ হতো মাঝে মাঝে। একবারের কাণ্ড রীনার মুখে খুব শোনা যায়। বেশ কয়েক দিন আড়ি চলবার পর আম্মু কোনো না কোনো ছুতোতে ভাব করে নিতেন। আম্মুর অভ্যাস ছিল দুবেলা খাওয়া-দাওয়ার পরে বড় এলাচ খাওয়া। একবার বারান্দায় মাদুর পেতে বাতি জ্বেলে বসে আব্বু লেখাপড়া করছিলেন। আম্মু তখন খেয়ে উঠে দূরে মোড়ায় বসে এলাচ খাচ্ছেন। হঠাৎ কী একটা মাদুরের ওপরে ছিটকে পড়তেই আব্বু চট করে তুলে মুখে পুরে চিবিয়ে ফেললেন। তাই দেখে আম্মু হো হো করে হেসে উঠেছেন। মুখে পুরেছেন গুবরেপোকা! ভেবেছিলেন আম্মু বুঝি এলাচ ছাড়িয়ে ছুড়ে দিয়েছেন ভাব করবার জন্য। এতেও অবশ্য ভাব হয়েই গেল, তবু হেনস্তাও হলো আব্বুর!!

জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে বড়দি ছিলেন আব্বুর অত্যধিক প্রিয়। আম্মু বাপের বাড়ি গেলে বড়দির পড়াশোনার সুবিধার জন্য অনেক সময় বড়দিকে আব্বুর কাছে রেখে যেতেন। আব্বুও তাকে সাইকেলের সামনে রডে বসিয়ে এখানে-ওখানে নিয়ে যেতেন। মুখে মুখে নানা জ্ঞানের কথা শোনাতেন।

বড়দির কাছে শোনা গল্প। একবার বিকেলের দিকে পুরান ঢাকাতে কাদের বাড়ি গিয়ে যেন আব্বু বসেছেন দাবা খেলতে। আর তো হুঁশ নেই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি, তারপর রাত্রিও পুইয়ে গেল। বড়দি খিদের চোটে অবসন্ন হয়ে এক সময়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। সকাল হতেই ঘোর ভেঙে আব্বু তাড়াতাড়ি বড়দিকে টেনে তুলে রাস্তার কল থেকে চোখে-মুখে পানি দিয়ে নিয়ে গেলেন মিষ্টির দোকানে, ‘কী খাবি খা। তোর আম্মুকে কিন্তু কিচ্ছু বলিস না।’

মিষ্টি খাবার ওস্তাদ ছিলেন আব্বু। পুজোবাড়িতে গেলে বড় কাঁসার থালাতে চুড়ো করে মিষ্টি সাজিয়ে দিত। আব্বু নাকি টপাটপ খেতে খেতে শেষ করে ফেলতেন। মেজমামু একবার তাঁর সঙ্গে গিয়ে ওই খাওয়া দেখে হতভম্ব। ফিরে এসে বলেছিলেন, ‘বাঙাল খেতেও পারে।’ হুগলিনিবাসী আম্মুরা আব্বুকে কথায় কথায় ‘বাঙাল’ খোঁটা দিতেন। আব্বু কিছুই গায়ে মাখতেন না। তাস খেলতে ডেকে নিয়ে আব্বুকে ‘ব্রে’ করে হা হা করে হাসতেন। আব্বু তো আলসেদের মতন তাস খেলা দেখতেই পারতেন না।

ছায়ানটের সভাপতি সন্‌জীদা খাতুনের ৮৪তম জন্মদিনে বাবা কাজী মোতাহার হোসেনের ছবির সামনে দাঁড়ালেন তিন বোন: মাহমুদা খাতুন (বাঁ থেকে), সন্‌জীদা খাতুন ও ফাহ্‌মিদা খাতুন l

ছায়ানটের সভাপতি সন্‌জীদা খাতুনের ৮৪তম জন্মদিনে বাবা কাজী মোতাহার হোসেনের ছবির সামনে দাঁড়ালেন তিন বোন: মাহমুদা খাতুন (বাঁ থেকে), সন্‌জীদা খাতুন ও ফাহ্‌মিদা খাতুন lফাইল ছবি

বলতেন, ‘বুদ্ধির খেলায় এসো। দাবা খেলো।’ তাই কি আমার চৌকস মামুরা খেলেন! হেরে যাবেন, জানা কথা যে!

ছেলেদেরকে বেশ দাবা খেলা শিখিয়েছিলেন আব্বু। নবাব-নূরু ভালোই খেলত। আব্বু সন্ধ্যার দিকে ওদের দেখলে বলতেন, ‘খেলবি নাকি এক দান?’ আর দাবা তো কখনো এক দানে শেষ হয় না। যে হারে তার রোখ চেপে যায়। আর এক দান, আর এক দান, চলতেই থাকে। আম্মু তাই রেগে যেতেন, ‘এই তো শুরু হলো। লেখা নেই পড়া নেই। ঢং!’

এই ‘ঢং’ করতে গিয়েই তো স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে আব্বু করাচি গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন। আসলে, আলবদর বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত তাঁর এক প্রিয় ছাত্র জানতে পেরেছিলেন যে বুদ্ধিজীবী নিধনের তালিকাতে নাম আছে আব্বুর। তাই একটা ব্যবস্থা করে ইরানে দাবার টিম নিয়ে যাবার কথা বলে তাঁকে করাচিতে মেয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়ে মাহমুদা চাকরি করত সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে। সেখানে যাবার পরে পাকিস্তান দল তাঁকে আর ইরানে নিয়ে যায়নি। তবে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন এইভাবে। যুদ্ধ শেষে করাচিতে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর, সে কথা বলি।

বাংলাদেশে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের বিচার হবার কথা শুরু হলে করাচিতে এক রাতে মাহমুদার সরকারি আবাসনের ভেতরে এসে ঢুকল আর্মির জিপ। মাইকে ঘোষণা শোনা গেল ‘মাহমুদা খাতুন কে আছ বেরিয়ে এসো, না হলে বিপদ হবে।’ ভয়ে মুখ চুন করে আমাদের ছোট বোন এনু বেরিয়ে গেল, তার স্বামীও সঙ্গে সঙ্গে গেল। এক মেয়ে আর কোলের ছেলে রেখে মেয়েজামাই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আর আব্বু সারারাত্রি পথের দিকে চেয়ে চেয়ে কাটিয়ে দিলেন। মাঝে মাঝে ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন। কারণ, ঢাকা থেকে তিনি শুনে গেছেন বাসা থেকে যাদের এরা নিয়ে যায়, তারা ফিরে আসে না আর।

এই কি আমার সেই আব্বু, যিনি সেজদির লাশ বাসায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নিজের ক্লাসটি নিয়ে তারপরে এসে জানাজায় দাঁড়িয়েছিলেন। সেকালে পাকিস্তানিদের আচরণ মানুষকে তার সংযমে, তার ন্যায়নীতিতে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত থাকতে দেয়নি। আর দেশে ওই সময়ে আব্বুর পাকিস্তানে যাওয়া নিয়ে কত কথাই উঠেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের কাগজে পাকিস্তানিদের সহযোগী হিসেবেও তাঁর নাম ছাপা হয়েছিল। থাক সেসব কথা।

একাশি সালের সেপ্টেম্বরে এক সকালে বেলা সাড়ে আটটার দিকে নবাব ফোন করে জানাল রাতে আব্বু পড়ে গিয়েছিলেন। বিছানায় এনে শুইয়ে দেবার পরে এখনো ঘুমিয়েই আছেন। আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘ডাক্তার ডেকেছিস?’ ও বলল, ‘অত ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন? উনি তো ঘুমাচ্ছেন।’ বুঝলাম বৃদ্ধ বয়সে রাত্রিতে পড়ে যাবার পর বেশ বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকাটা যে সুস্থতার লক্ষণ নয়, সে কথা আমার রহস্য-উপন্যাসপটু ভাইটি জানে না।

ডাক্তার এসে দেখল একটি দিকে সাড় নেই তাঁর। পিজিতে নিয়ে যাবার পর ক্রমশ গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকলেন তিনি। হাসপাতালে প্রথম রাত্রিতে ঘুমের ভিতরেও বাম হাতটি তুলে আনছিলেন মুখের কাছে। বাম হাত দিয়ে দাড়ি আঁচড়ানো অভ্যাস ছিল, হাত দাড়ি পর্যন্ত পৌঁছুচ্ছিল না। সেই হাতখানি ধরে বসে রইলাম আমি। মৃত্যুর সঙ্গে বেশ যুঝেছেন। দিন ষোলো কেটেছিল ওই রকম। বুদ্ধির মুক্তি যাঁর আন্দোলনের বিষয় ছিল, কাল তাঁর সর্বচেতনা হরণ করল। সেই তো নিয়ম! আমরাও তো সেই পথেই যাব, ক্ষোভ করবার কিছু নেই

সূত্র, প্রথম আলো