মাত্র তিন মাস আগে ইসরায়েল ও ইরানের ১২ দিনের যুদ্ধে পুরো মধ্যপ্রাচ্য কেঁপে ওঠে। দুই দিক থেকেই ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছোড়া হয়।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় খুব দ্রুতই ইসরায়েল ইরানের আকাশসীমায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং ইরানের বিভিন্ন পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় বারবার আঘাত হানে। ইরানের ৩০ জন সামরিক কমান্ডার ও ১৯ জন পারমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করে। ইরানের পাল্টা হামলা ভবিষ্যতে ইসরায়েলকে নিরুৎসাহিত করার মতো ফল আনতে পারেনি।
ইসরায়েল-ইরানের মধ্যে আবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা কম। যদিও ধারণা করা হয় যে ইরানের কাছে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত আছে এবং সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতা আবারও চালু করার সক্ষমতাও আছে। কিন্তু ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ বোমাবর্ষণের কারণে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রকল্প কয়েক বছর পিছিয়ে গেছে।
ইরানের অভ্যন্তরে সরাসরি হামলাকে ইসরায়েল স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করেছে এবং ইরানের শাসকগোষ্ঠীর বড় ধরনের ক্ষতি করার সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। ইরান যদি তার পারমাণু কর্মসূচি আবার চালু করে, তাহলে ইসরায়েল ‘নির্দিষ্ট লক্ষ্যে’ সীমিত ধরনের অভিযান চালাতে পারে। ইরানের প্রতিরক্ষাকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার ও বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় হামলা চালাতে পারে।
ইরান আরেকটা যুদ্ধ সামলানোর অবস্থায় নেই। ইসরায়েল আবার হামলা চালালে ইরান পাল্টা আঘাত হানবে বটে, তবে সেই প্রতিক্রিয়া হবে খুব হিসাবি, যাতে সংঘাত বিপজ্জনক মাত্রায় না পৌঁছায়, কেননা বড় সংঘাত ইরানের পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন।
১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান অনেক ঝড় সামলেছে। হয়তো সামনে দেশটি আরও ঝড় সামলাতে পারবে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের পর টিকে থাকাকেই বিজয় হিসেবে দেখাতে জোর চেষ্টা করেছে তেহরান। কিন্তু ইরানের সংকট বেড়েই চলেছে।
ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত একটি অ্যাম্বুলেন্সের পাশে ইরানের পতাকা ধরে আছেন এক ব্যক্তি। তেহরান, ইরান, ২৩ জুন
ভূরাজনীতির দিক থেকে ইরান এখন ৭ অক্টোবরের ( ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস–ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু) আগের সময়ের তুলনায় অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মিত্রদের বড় একটা অংশকে ইরান হারিয়েছে। হামাস থেকে হিজবুল্লাহ ও সিরিয়ায় বাশার আল–আসাদ থেকে ইসরায়েলকে ঠেকাতে এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার করতে ইরান দীর্ঘদিন এই মিত্রদের ওপর নির্ভর করত।
এখন ইরান সরকার স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। পানি ও জ্বালানিসংকট নিয়ে কিছু বিক্ষোভ দেখা দিলেও যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর দমননীতি নতুন আন্দোলনের বিস্তার ঠেকিয়ে রেখেছে। ২০২২ সালে নারী, জীবন ও স্বাধীনতার মতো আন্দোলন ইরানকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। বড় কোনো যুদ্ধ আবার শুরু হলে ইরানের ওপর দেশটির শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
ইরান যদি আরেকটি যুদ্ধ এড়াতেও পারে, তবু অর্থনীতি নিয়ে দেশটির শাসকেরা নতুন চাপে পড়তে যাচ্ছেন। জাতিসংঘ খুব শিগগির ইরানের ওপর স্থগিত রাখা নিষেধাজ্ঞা চালু করতে চলেছে। আগস্টের শেষ দিকে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি—জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে। এই তিন ইউরোপীয় দেশ ২০১৫ সালের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি বিস্তার রোধের চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। কেননা ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচিতে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের পরিদর্শন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কোনো অপ্রত্যাশিত কূটনৈতিক অগ্রগতি না ঘটলে আগামী ১৮ অক্টোবর থেকে ইরানের ওপর জাতিসংঘের এই নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল হবে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ইরানের তেল ও খনিশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ইরানের বাণিজ্যিক লেনদেনে মার্কিন ডলার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর মধ্যে সহিংস উপায়ে বিক্ষোভ দমন এবং ইউক্রেনযুদ্ধে রাশিয়াকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার কারণে ইরানের ওপর বাড়তি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা হবে আরও ব্যাপক। এটি ইরানের তেল বিক্রি থেকে আয়ে বড় ধরনের পতন ঘটাবে। অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে।
ইরান ট্রাম্প প্রশাসনকে ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। কিন্তু হোয়াইট হাউসের আচরণে মনে হচ্ছে, নতুন করে সমঝোতা শুরু হওয়ার আগেই তারা তেহরানের ওপর আরও চাপ বাড়াতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অবস্থান হলো, ইরানকে আগে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ছাড় দিতে হবে। কিন্তু এমন পিছু হটার সম্ভাবনা ইরানের কম। এর মধ্যে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাকে হুমকি হিসেবে কাজে লাগিয়ে ইরানের শাসকদের আরও কোণঠাসা করে ফেলতে পারে।