ঈদের পর উপাচার্যবিহীন কুয়েট খুললেও শুরু হয়নি ক্লাস। হলে অবস্থানরত অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। ১৫ জুন ঈদের পর উপাচার্যবিহীন কুয়েট খুললেও শুরু হয়নি ক্লাস। হলে অবস্থানরত অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। ১৫ জুনছবি: সাদ্দাম হোসেন প্রায় চার মাস অচল খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা চাইলেও তাঁরা ক্লাসে ফিরছেন না। পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে না পারলেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝেমধ্যে আমরা তা দেখতে পাই। শিক্ষকদের দাবি পূরণ না হওয়ায় বন্ধ থাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমকে সচল করার উদ্যোগ কার্যত সরকার নিতে পারেনি। এ কারণে শিক্ষকদের কাছেই এখন অসহায় হাজারো শিক্ষার্থী। গণমাধ্যমের খবর বলছে, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এর পক্ষে–বিপক্ষে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে কয়েকজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ ওঠার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক কার্যক্রম ও হল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ৪ মে থেকে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। শুধু তা–ই নয়, নতুন শিক্ষাবর্ষের অর্ধেক সময় পার হয়ে গেলেও তাঁদেরও ক্লাস শুরু হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি সম্প্রতি এক সভা শেষে দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ এবং শিক্ষক লাঞ্ছনায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি না হলে ক্লাসে না–ফেরার কথা আবার জানিয়ে দিয়েছে (সূত্র-সমকাল)। প্রশ্ন হলো, এসব শিক্ষকের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করার এখতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন আইনে দেওয়া হলো? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ যেখানে শিক্ষার্থী, সেখানে তাঁদের জিম্মি করে ‘নিজেদের বিচার’ চাওয়া কেবল অনৈতিক নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী বটে। তাহলে প্রশ্ন হলো, শিক্ষক লাঞ্ছনার বিচার হবে না? জড়িত ব্যক্তিরা শাস্তি পাবে না? শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেওয়ার বিধান দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার আইনের ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গ’ দায়ে কীভাবে শাস্তি প্রদান করা যাবে, তার একটি ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। সেই আইনের আলোকে বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে সেটি করতে গিয়ে দিনের পর দিন ক্লাস-পরীক্ষা ফেলে রাখা কখনোই ‘শিক্ষকসুলভ’ আচরণের মধ্যে পড়ে না। এটা নিছক জেদাজেদি অথবা ইগোজিম, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা যায় না। গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে। কোথাও শিক্ষক লাঞ্ছনা হয়েছে, অপহৃত হয়েছেন আবার কোথাও কোথাও জোরজবরদস্তি করে শিক্ষকদের পদচ্যুত করার ঘটনা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এসেছে। যা শুধু ঘৃণ্য অপরাধই নয়, এটা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্কের ব্যাপক অবনমন ঘটিয়েছে, যা সেরে তোলা সময়সাপেক্ষ বিষয়। এসব ঘটনার ভিড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নতুন উপাচার্য এসেছেন, অনেকটাই পুরোনো ঘরানার মডেল অনুসরণ করে। রাজনৈতিক পছন্দের ব্যক্তিদের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পরও কুয়েটই একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে নিয়োগের কয়েক মাস পরই উপাচার্যকে অব্যাহতি দিতে হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য এসেও টিকতে পারেননি। এমন এক পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বিপরীত দিকে অবস্থান কখনোই শিক্ষার স্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে না। এর একটি সুষ্ঠু সমাধান যেমন প্রয়োজন, তেমনি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আস্থার জায়গাও তৈরি করতে হবে। যেভাবে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের ফেলে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অচল করে রেখেছেন, তা কখনোই কাম্য নয়। কাজটি শিক্ষার্থীরা করলেও এর মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, তবে শিক্ষকদের অবশ্যই সহনীয় আচরণের মধ্যে থাকা জরুরি। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তাঁদের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই শিক্ষার্থীদের জন্য। তবে শিক্ষকদের শারীরিক লাঞ্ছনা করে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে বা যাঁরা শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করেছেন, তাঁদের ক্ষমতার দাপট কয়েক দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চিত্রায়িত হয়েছে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন–পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এমন দস্যিপনার কোনো সুযোগ নেই। যে কারণে আমরা শুরু থেকে দাবি করে আসছিলাম, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে তিলে তিলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গেছে, তার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ‘লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিতে’ জড়িয়ে পড়া, তা যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। এই মৌলিক দাবি যখন কুয়েটের শিক্ষার্থীরা করেছিলেন, তখন তাঁদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে, যা কেবল অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, ঘৃণিত বটে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মাইটোকন্ডিয়ার মতো আচরণ করা ছাত্রসংগঠনগুলোর ভয়ানক ক্ষতিকর দিকগুলো শিক্ষাঙ্গনকে মুষড়ে দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের সুযোগ আমাদের হাতে মিললেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটল সংঘর্ষের ঘটনা, শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, যা বছরের অর্ধেক সময় পার হয়ে গেলেও সচল করার কোনো উদ্যোগ নেই। শুধু তা–ই নয়, শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পদচ্যুত করার ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত শিক্ষকেরা অনেকটাই অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন। ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির জের ধরে ‘শিক্ষার মানোন্নয়ন’ ঠিক কতটা করা সম্ভব, তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এরপরও শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে শিক্ষকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। কোনো অবস্থায় শিক্ষকদের সম্মানহানি হয়, এমন কর্মকাণ্ড থেকে সরকারেরও বিরত থাকা প্রয়োজন। কুয়েটের সমস্যা দূর করতে সরকার, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যৌথ প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসতে হবে। যদিও গণমাধ্যমের খবরগুলো বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। আমি নিশ্চিত নই, সেই ক্ষমা তাঁরা মৌখিক বা লিখিতভাবে চেয়েছেন কি না। তবে একাডেমিক শৃঙ্খলা কমিটি যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রয়েছে, সেহেতু তাঁরা (শিক্ষকেরা) সেখানেও ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করতে পারতেন। কিন্তু এখন যে পর্যায়ে তাঁরা বিষয়টিকে নিয়ে গেছেন, সেখানে সাত হাজার শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন নিয়ন্ত্রণ করার মতো কেউ থাকছে না। অথচ তাঁরা ক্লাস-পরীক্ষা সচল রেখেই নিজেদের দাবিগুলো জিইয়ে রাখতে পারতেন। সরকারের উচিত হবে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সচল করা। শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আলোচনার ব্যবস্থা করা। রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে যোগ্য ব্যক্তিদের বিশ্ববিদালয়ের প্রচলিত আইনের সীমারেখার চর্চার মধ্যে রেখেই উপাচার্য নিয়োগ প্রদান করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা। মনে রাখতে হবে, শিক্ষকদের হেয় করে কখনোই শিক্ষার সিঁড়ি তৈরি করা যায় না। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসার মধ্য দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন সম্ভব। আশা করি, সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে কুয়েটের অচল অবস্থা নিরসন করবে। নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

সূত্র, প্রথম আলো