জুলাই সনদের হালচাল দেখে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতার পঙ্ক্তি মনে পড়ে, ‘সত্য যে কঠিন/ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।’ কিন্তু সম্ভাব্য জুলাই সনদকে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা ভালোবেসেছে এবং কতটা আগামী নির্বাচনে ভোটের হিসাব–নিকাশ করেছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
বর্তমানে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা সব দলের উদ্দেশ্য যদি হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়া, তাহলে নির্বাচনের বিকল্প নেই। প্রশ্ন হলো সেই নির্বাচনটি কীভাবে হবে? কেউ বলছেন সংবিধান অনুযায়ী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনই হবে। আবার কেউ বলছেন স্বৈরতন্ত্রের পুনরাবির্ভাব ঠেকাতে গণপরিষদ গঠন করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। আবার কারও মতে, সংবিধানের মূলনীতি বদলাতে হবে। মূলনীতির মধ্যেই নাকি স্বৈরতন্ত্রের বীজ বপিত আছে।
স্বাধীনতার পর ৫৪ বছরে কোনো সরকারই গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা করেনি। এ জন্য রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে নেওয়া ‘গণতন্ত্র’ বাতিল হতে পারে না। এ কথা ঠিক যে বাহাত্তরের সংবিধানে জাতীয়তাবাদের নামে বাঙালি জাতিসত্তার বাইরে কাউকে জাতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি। এটা আমাদের সংবিধানের বড় দুর্বলতা। একইভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ স্থাপন করা হয়েছে, তার মধ্যে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে বলেও অভিযোগ আছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রাম তথা একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশের মানুষ যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, সাম্প্রদায়িকতা তার ভিত্তি হতে পারে না।
সংবিধান সংস্কার কমিশন অবশ্য বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখা ও মৌলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। এটা তাদের আপসকামিতাই বটে। নারী আসনের বিষয়েও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আপস করেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন যেখানে ১০০ আসনে সরাসরি ভোটে নারী প্রতিনিধি নির্বাচনের কথা বলেছিল, সেখানে ঐকমত্য কমিশন বড় দলের আপত্তির মুখে সেই প্রক্রিয়া থেকে সরে এসেছে। প্রার্থী মনোনয়নে প্রতি নির্বাচনে ৫ শতাংশ হারে নারী প্রতিনিধি বাড়ানোর সম্মতি দেওয়া শুভংকরের ফাঁকি ছাড়া কিছু নয়।
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে যত ভিন্নমত পোষণ করুন না কেন, চীনের আমন্ত্রণ গ্রহণে কেউ অস্বীকৃতি জানাননি। কেউ এ কথাও বলেননি যে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করার আগে বিদেশ সফরে গেলে গণতন্ত্রের সমূহ ক্ষতি হবে। এমনকি সিলেটে পাথর লুটের ঘটনায় এসব দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের পরস্পর সহযোগী ও সম্পূরক শক্তি হিসেবে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে জুলাই সনদ নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা করেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ দূর করতে পারেনি। ফলে জুলাইয়ে জুলাই সনদ সই করা সম্ভব হয়নি, আগস্টেও হচ্ছে না। সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ নাগাদ কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে সমঝোতা না হলে কী হবে?
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বা সরকারের যত সদিচ্ছাই থাকুক, রাজনৈতিক দলগুলো একমত না হলে নির্বাচনের প্রশ্নে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে। ইতিমধ্যে তার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের বর্ষপূর্তিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর বিভিন্ন মহল থেকে ভোটের রোডম্যাপ ঘোষণার চাপ ছিল নির্বাচন কমিশনের ওপর। গত বৃহস্পতিবার সেই বহু প্রতীক্ষিত ঘোষণা এলেও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। বিএনপি একে স্বাগত জানিয়েছে। জামায়াত বলেছে, অস্পষ্ট। আর ছাত্রদের নিয়ে গঠিত নতুন দল এনসিপি বলেছে, এটি সরকারের ওয়াদাভঙ্গের শামিল।
সংস্কার প্রস্তাবের বাস্তবায়ন ও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলো একমত নয়। বিএনপির অবস্থান হলো আইনবিধিসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে। আর সংবিধানসংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে আগামী জাতীয় সংসদে। জামায়াতে ইসলামী চায় গণভোট বা রাষ্ট্রপতির প্রক্লেমেশনের (ঘোষণা) মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন করা হোক। গণপরিষদ গঠন করে সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
জুলাই সনদকে সংবিধানের উর্ধ্বে স্থান দেওয়া কিংবা আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না বলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে প্রস্তাব করেছে, তা কতটা যৌক্তিক প্রশ্ন তুলেছেন আইনবিশেষজ্ঞরা। দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান। এর ওপরে কোনো আইনকে স্থান দেওয়া হলে সংবিধানের কার্যকারিতা থাকে না।
অনেকে নতুন সংবিধানের দাবি তুলেছেন। সেটি তাঁরা করতেই পারেন; কিন্তু তাঁদের মনে রাখতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকারও গঠিত হয়েছে এই সংবিধানের ভিত্তিতে। সংবিধান বাতিল হলে সরকারের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির মাধ্যমে গণপরিষদ ও আইনসভা নির্বাচন চায় তাঁর দল। যদি গণপরিষদ গঠিত না হয়, তাহলে কি তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেন না? দলের কোনো কোনো নেতা সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপর স্থান দেওয়া কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁর মতে, নির্বাচনবিরোধী কথা যাঁরাই বলুন, তাঁরা রাজনীতির মাঠ থেকে মাইনাস হয়ে যাবেন। কোনো দল নির্বাচনে অংশ না নিলে তা তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার অংশ। তবে যারা অযৌক্তিকভাবে বর্জনের সুযোগ খুঁজবে, তারা ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে নিজেরাই পিছিয়ে যাবে।
জুলাই সনদ বিতর্কের মধ্যেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে পাঁচ দিনের সফরে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ এনসিপির আট নেতা চীন গেছেন। এর আগে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিল। বিএনপির সঙ্গে চীনের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দুই দেশের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় (যদিও খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় সরকারের সময় সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দেয় ঢাকায় তাইওয়ানের বাণিজ্য মিশন খোলা নিয়ে)।
অন্যদিকে জুলাই অভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে যে ছাত্রনেতৃত্ব, তাঁদের নিয়ে গঠিত এনসিপির সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক থাকাও অস্বাভাবিক নয়। দলটি নিজেদের মধ্যপন্থী বলেও দাবি করে। কিন্তু যে দলটি মানে জামায়াতে ইসলামী কমিউনিস্ট ব্যবস্থাকে ইসলামবিরোধী বলে দাবি করে, সেই দলের নেতারা চীন থেকে কী ধরনের গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সবক নিয়েছেন, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে যত ভিন্নমত পোষণ করুন না কেন, চীনের আমন্ত্রণ গ্রহণে কেউ অস্বীকৃতি জানাননি। কেউ এ কথাও বলেননি যে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করার আগে বিদেশ সফরে গেলে গণতন্ত্রের সমূহ ক্ষতি হবে। এমনকি সিলেটে পাথর লুটের ঘটনায় এসব দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের পরস্পর সহযোগী ও সম্পূরক শক্তি হিসেবে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে।
তাহলে জুলাই সনদ কিংবা আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের মতভেদ এতটা প্রবল কেন? এর পেছনে নীতি-আদর্শের বিরোধের চেয়ে ভোটের হিসাব-নিকাশটাই বড় বলে মনে করি।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি