কোনো কোনো মৃত্যু নিছক সংখ্যার হিসাব ছাপিয়ে একটি জাতির রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরের রাজপথে আবু সাঈদের বুলেটের সামনে বুক পেতে দেওয়ার ঘটনা সম্ভবত তেমনই একটি ঘটনা।
এই মৃত্যু কেবল একজন তরুণের জীবনাবসান ছিল না; একে বলা যায় রাষ্ট্র, ক্ষমতা এবং ব্যক্তির নৈতিক অবস্থানের মধ্যকার জটিল সম্পর্ককে উন্মোচিত করার মুহূর্ত। আবু সাঈদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার মনে হয়েছে, তাঁর এই আত্মত্যাগকে আবেগময় বীরত্বগাথার ঊর্ধ্বে উঠে একটি সমাজ, রাজনৈতিক ও তাত্ত্বিক কাঠামোতে বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য।
আবু সাঈদের মৃত্যুকে প্রচলিত বিক্ষোভের অন্যান্য হতাহতের ঘটনা থেকে যা পৃথক করে, তা হলো এর পারিপার্শ্বিকতা এবং তাঁর নিজের ভূমিকা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত, বিশেষত দৃক পিকচার লাইব্রেরি এবং ফরেনসিক আর্কিটেকচারের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, আবু সাঈদ বিশৃঙ্খল ভিড়ের অংশ হিসেবে নয়, বরং সেখান থেকে সচেতনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। প্রসারিত দুই হাত এবং উন্মুক্ত বুক নিয়ে তাঁর স্থির দাঁড়িয়ে থাকা একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল না, বরং এটি ছিল একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ।
তদন্তে উঠে এসেছে, পুলিশ তাঁকে প্রায় ১৪ মিটার দূর থেকে শটগান দিয়ে গুলি করে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, এই দূরত্বে থাকা কোনো ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য তাৎক্ষণিক হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন না। এ তথ্য প্রমাণ করে যে আবু সাঈদ কোনো সহিংস প্রতিরোধে লিপ্ত ছিলেন না। তাঁর এই স্থিরতা তাই কেবল সাহস নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি এক সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতিভাত হয়।
কাতারভিত্তিক আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট (আই-ইউনিট)-এর অনুসন্ধানী ভিডিও প্রতিবেদনে (হাসিনা: থার্টি সিক্স ডেজ ইন জুলাই) খেয়াল করলেও খুব গভীরভাবে বোঝা যায় যে সাহসিকতার কতটা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন আবু সাঈদ এবং সেটি খুব সচেতনভাবেই।
আবু সাঈদের এই কর্মকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া একই ধরনের প্রতিবাদী ঘটনা সামনে বসিয়ে দেখা যেতে পারে।
তিয়েন আনমেন স্কয়ারের ‘ট্যাংক ম্যান’ (১৯৮৯): চীনের সামরিক ট্যাংকের সারির সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকা সেই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির ছবিটি অহিংস প্রতিরোধের এক শক্তিশালী প্রতীক। তিনি যেমন রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের বিপুল শক্তিকে তাঁর একক মানবশরীর দিয়ে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন, আবু সাঈদের মধ্যেও সেই একই প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, যেখানে নৈতিক শক্তি যান্ত্রিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে।
মোহাম্মদ বুয়াজিজি (২০১০): তিউনিসিয়ার এই ফল বিক্রেতার আত্মাহুতি ছিল আরব বসন্তের অনুঘটক। প্রতিবাদের সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে নিজের শরীরকে রাজনৈতিক বিবৃতির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার এক চরম উদাহরণ তিনি। আবু সাঈদের কর্মেও এই দর্শনের অনুরণন পাওয়া যায়, যেখানে শরীরই হয়ে ওঠে প্রতিবাদের চূড়ান্ত মাধ্যম।
আবু সাঈদকে কেবল একজন শহীদ হিসেবে স্মরণ করা তাঁর কর্মের প্রতি সুবিচার করে না। তাঁর আত্মত্যাগ ছিল একটি অত্যন্ত শক্তিশালী রাজনৈতিক কৌশল, যা ক্ষমতার প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। তিনি দেখিয়েছেন, চূড়ান্ত দমন-পীড়নের মুখে একটি নিরস্ত্র শরীরের নৈতিক প্রতিরোধ কীভাবে একটি গণ-অভ্যুত্থানের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে এবং একটি আপাত অজেয় সরকারকেও পতনের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
হেক্টর পিটারসন (১৯৭৬): দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়েটোতে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে নিহত ১২ বছর বয়সী হেক্টর পিটারসনের মৃত্যু বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। তাঁর মৃত্যু যেমন একটি গণজাগরণের স্ফুলিঙ্গ ছিল, আবু সাঈদের মৃত্যুও তেমনি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে একটি গণ-অভ্যুত্থানের দিকে চালিত করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।
এই প্রতিটি ঘটনার মতোই আবু সাঈদের আত্মত্যাগ প্রমাণ করে যে একজন ব্যক্তির নৈতিক দৃঢ়তা ও প্রতীকী কর্ম পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে নাড়িয়ে দিতে পারে।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দমন-পীড়নকে ব্যাখ্যা করার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘বায়োনেট সিনড্রোম’ ধারণাটি ব্যবহৃত হয়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, অস্ত্রধারী সদস্যরা প্রতিপক্ষকে শত্রু বা মানবতাহীন হিসেবে দেখতে শুরু করলে সহিংসতা প্রয়োগে দ্বিধা বোধ করে না। এটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করে।
আবু সাঈদের কর্মকে এই বায়োনেট সিনড্রোমের একটি প্রায়োগিক প্রতিষেধক বা পাল্টা তত্ত্ব হিসেবে দেখা যেতে পারে। যখন একজন নিরস্ত্র ব্যক্তি স্বেচ্ছায় সহিংসতার মুখোমুখি হন, তখন ক্ষমতার মনস্তাত্ত্বিক সমীকরণটি জটিল হয়ে পড়ে। সহিংসতা তার লক্ষ্য অর্জন করে ভয় সৃষ্টির মাধ্যমে।
কিন্তু যখন কোনো ব্যক্তি মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে তাকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত থাকে, তখন সহিংসতা তার কার্যকারিতা হারায়। আবু সাঈদের স্থিরতা ছিল রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতার প্রতি এক নীরব প্রশ্ন, যা প্রমাণ করে শরীরকে ধ্বংস করা গেলেও আদর্শকে পরাস্ত করা যায় না।
এই ধরনের প্রতিরোধে প্রতিবাদকারীর শরীর নিজেই একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বয়ানে পরিণত হয়। আবু সাঈদের উন্মুক্ত বুক কেবল একটি অরক্ষিত শরীর ছিল না, তা হয়ে উঠেছিল লাখো তরুণের বঞ্চনা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীকী উপস্থাপনা। ফলে আবু সাঈদের মতো দুই হাত প্রসারিত করে ছাত্র-জনতার অনেককে স্বৈরাচারের ঘাতক বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে যেতে দেখা গেল।
একটি অস্ত্রধারী বাহিনীর সামনে একজন নিরস্ত্র ব্যক্তির স্থির হয়ে দাঁড়ানোর দৃশ্য জনমনে গভীর নৈতিক আবেদন তৈরি করে। এটি শাসকগোষ্ঠীকে নৈতিকভাবে একঘরে করে দেয় এবং নিপীড়িতের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন গড়ে তোলে। আবু সাঈদের মৃত্যুর দৃশ্য গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তা আন্দোলনের জন্য একটি নির্ণায়ক মুহূর্ত বা ‘টিপিং পয়েন্ট’ তৈরি করে।
আবু সাঈদকে কেবল একজন শহীদ হিসেবে স্মরণ করা তাঁর কর্মের প্রতি সুবিচার করে না। তাঁর আত্মত্যাগ ছিল একটি অত্যন্ত শক্তিশালী রাজনৈতিক কৌশল, যা ক্ষমতার প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। তিনি দেখিয়েছেন, চূড়ান্ত দমন-পীড়নের মুখে একটি নিরস্ত্র শরীরের নৈতিক প্রতিরোধ কীভাবে একটি গণ-অভ্যুত্থানের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে এবং একটি আপাত অজেয় সরকারকেও পতনের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
তাঁর এই কর্ম নিছক বীরত্বপূর্ণ ছিল না, এটি ছিল সুচিন্তিত ও প্রতীকী অর্থে পরিপূর্ণ। এ কারণেই সামনের দিনে আবু সাঈদের আত্মত্যাগ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে এবং বিশ্বজুড়ে অহিংস প্রতিরোধের অধ্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হিসেবে বিবেচিত হবে।
● আরিফ রহমান গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী