ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে যাবার পর ৮ আগস্ট ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। অন্তর্বর্তী সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুগত নয়। এ সরকারের দৃশত কোনো রাজনৈতিক এজেণ্ডা নেই। তাই বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের প্রয়োজন নেই। তাদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে সুষ্ঠু এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করা। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে বিগত সরকার আমলে যে ক্ষতি সাধন করা হয়েছে তার পুন:নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অনেকেই বলছেন, সংস্কার কার্যক্রম সরকারের দায়িত্ব নয়। এটা করবে রাজনৈতিক সরকার। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিগত ৫৩ বছরে রাজনৈতিক সরকারগুলো কেনো দেশটাকে গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত করতে পারলো না? তারা কেনো দেশটাকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের মতো ব্যবহার করেছে? কিছু কিছু সংস্কার কার্যক্রম আছে যা অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে সম্পন্ন করতে হবে। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো এসব সংস্কার কার্যক্রম সাধনে মোটেও আগ্রহী হবে না। বিশেষ করে এমন একটি নির্বাচন পদ্ধতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন যাতে কোনো সরকারই জনগণের ক্ষমতাকে অস্বীকার করতে না পারে। ভোটাধিকারকে কলুষিত করতে না পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির দাবি সর্বপ্রথম উত্থাপন করেছিল জামায়াতে ইসলামী। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এবং পরবর্তীতে বিএনপিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশে যে ক’টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সবগুলোই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু সে তত্ত্বাবাধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে কিভাবে কলুষিত করা হয় এবং এক পর্যায়ে কোর্টের রায়কে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে বাদ দেয়া হয় তা সবাই প্রত্যক্ষ করেছে। আগামীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে পুনরায় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। একই সঙ্গে এমন একটি বিধান সংবিধানে রাখা যেতে পারে যে, কোনো সরকার ইচ্ছা করলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করতে পারবে না। গণভোট আয়োজন করা ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা যাবে না।
যখন বিএনপি-জামায়াত জোট রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলীয়করণের অভিযোগ উত্থাপন করা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের সাড়ে ১৫ বছরের অবৈধ শাসনামলে তারা দেখিয়ে দিয়েছে দলীয়করণ-আত্মীয়করণ কাকে বলে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে দলীয় সমর্থন এবং পরিবারের লোকজনকে অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয় এবং পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কিভাবে অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছে তার কিছু চিত্র বর্তমান সরকারের উদ্যোগে গঠিত শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। শ্বেতপত্র কমিটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এটা অবৈধ অর্থ উপার্জনের সামান্য চিত্রমাত্র। পাচারকৃত অর্থ ছাড়াও আরো অনেকগুন বেশি অর্থ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরেই বৈধতা দেয়া হয়েছে। মানি লন্ডারিং এবং অর্থ পাচার নিয়ে কোনো কোনো মহলে কিছুটা বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই মনে করেন, অর্থ পাচার এবং মানি লন্ডারিং একই বিষয়। আসলে তা নয়। অর্থ পাচার হচ্ছে বৈধ এবং অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহার না করতে পারার কারণে বিদেশে স্থানান্তরের একটি প্রক্রিয়া। অর্থ পাচার মানি লন্ডারিংয়ের একটি কৌশল। কিন্তু তাই বলে মানি লন্ডারিং এবং অর্থ পাচার এক জিনিস নয়। অর্থ পাচার দু’টি দেশের মধ্যে সংঘঠিত হয়। আর মানি লন্ডারিং দেশের অভ্যন্তরেও হতে পারে। শ্বেতপত্র কমিটি অর্থ পাচারের যে পরিসংখ্যান প্রদান করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ পাচার হয়েছে বলে ধারণা করার যৌক্তিক কারণ আছে। যারা বিদেশে অর্থ পাচার করে অথবা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অবৈধ অর্থকে বৈধতা দান করে তারা কখনোই তাদের উপার্জিত অর্থের সূত্র এবং পরিমাণ কারো নিকট উল্লেখ করে না।
বিগত সাড়ে ১৫ বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেভাবে দেশের সম্পদ লুন্ঠন করেছে অতীতে আর কোনো সরকারের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের গুণকীর্তন করে থাকে। কিন্তু ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামল কেমন ছিল, কতটা জনকল্যাণমূলক ছিল তা নিয়ে কখনোই কোনো কথা বলে না। ঠিক তেমনিভাবে আগামীতে এমন দিন আসবে যখন ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দু:শাসনের কথা কেউ উচ্চারণ করবে না। একটি পরিবার কতটা অর্থলোভী হতে পারে তা আমরা বিগত দিনে প্রত্যক্ষ করেছি। অনেকেই বলতে চান, বিগত সরকার আমলে অবকাঠামোগত খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু উন্নয়নের নামে কী পরিমাণ অর্থ লুট করা হয়েছে তা কি আমরা ভুলে যাবো? ভারতে এক কিলোমিটার ফোর লেন রাস্তা নির্মাণ করতে যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হয় বাংলাদেশে তা নির্মাণ করতে চারগুণ বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে। অর্থ উপার্জনের সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছিল অবকাঠামোগত উন্নয়নের নামে। বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করে সে ঋণের অর্থ দিয়ে রাস্তা-ঘাট নির্মাণের নামে লুটপাট করা হয়েছে। বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে বড় বড় দুর্নীতির উদ্দেশ্যে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যগণ বড় প্রকল্প থেকে কমিশন গ্রহণ করতেন বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
বিগত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশে যেভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ লোপাট এবং বিদেশে পাচার করা হয়েছে তার নজীর তৃতীয় বিশ্বের আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। আগামীতে রাজনৈতিক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলে বিগত সরকার আমলে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য কতটা উদ্যোগ নেওয়া হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাই বর্তমান সরকারকেই এ ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার নানা রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে যতটা ব্যস্ত সময় পার করছেন বিদেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের ক্ষেত্রে ততটা আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের মতভেদ দেখা দিয়েছে আগাামী ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নিয়ে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু তিনি নির্বাচনের কোনো নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করছেন না। ফলে বিভ্রান্তি থেকেই যাচ্ছে। নির্বাচন ডিসেম্বর মাসে অথবা জুন মাসে অনুষ্ঠিত হোক তাতে সমস্যা নেই কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে অসুবিধা কোথায়? নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নানা ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে। তাই তারা যদি নির্বাচনের সুস্পষ্ট তারিখ জানতে পারে তাহলে সুবিধা হবে।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে রাজনীতি এখন অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে দ্রুত বিত্তবানে পরিণত হবার সবচেয়ে সহজ মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। যারা রাজনীতিতে যুুক্ত আছেন তারা জানেন যতই অত্যাচার-নির্যাতন করা হোক না কেনো একবার ক্ষমতায় যেতে পারলেই হলো। বিত্তের বেসাতি তাদের পদতলে এসে লুটাবে। রাজনীতিকে যদি অর্থের প্রভাবমুক্ত না করা যায় তাহলে দেশের অবস্থা কখনোই ভালো হবে না। বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার কাজটি অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়। যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশে এ নিয়ে যেসব লাবিং ফার্ম কাজ করছে তাদের সঙ্গে কমিশন ভিত্তিতে চুক্তি স্বাক্ষর করা যেতে পারে। তারা যে পরিমাণ অর্থ ফিরিয়ে দিতে পারবে তার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন পাবে। বাংলাদেশে অর্থ পাচার ও অবৈধ অর্থ উপার্জনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ জন্য নানা ধরনের আইন রয়েছে। তবে সেসব আইনের যথার্থ প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছি দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব আইন আছে তা মূলত বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। সরকার সমর্থক অপরাধী হলে তার সকল অপরাধের দায়মুক্তি দেয়া হয়। মানি লন্ডারিং এবং অর্থ পাচার আইনের ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। অর্থপাচার এবং মানি লন্ডারিং বন্ধ করতে হলে প্রথমেই অবৈধ অর্থ উপার্জনের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করতে হবে। কারণ অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকে বলেই মানি লন্ডারিং এবং অর্থ পাচারের মতো ঘটনাগুলো ঘটে থাকে।
জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্থ উপার্জনের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করার জন্য অবৈধ অর্থ উপার্জনকে ক্রিমিনাল অফেন্স হিসেবে ঘোষণা করে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। উপার্জিত অবৈধ অর্থের পরিমাণের ভিত্তিতে শাস্তির বিধান রাখতে হবে। যেমন কোনো ব্যক্তি যদি ১ কোটি টাকার অবৈধ সম্পত্তি অর্জন করে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া যেতে পারে। যারা ১ কোটির বেশি অবৈধ অর্থ বা সম্পদ অর্জন করবেন তাদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা যেতে পারে। অধিকাংশ আরব দেশে চুরি করলে হাত কাটার বিধান রয়েছে। এমন কঠোর শাস্তির ভয়ে সেখানে চুরির ঘটনা একেবারেই অনুপস্থিত। শাস্তি যদি কঠোর এবং প্রয়োগ যদি সঠিকভাবে হয় তাহলে অপরাধের মাত্রা এমনিতেই কমে আসবে। কারো বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্থ উপার্জনের অভিযোগ উত্থাপিত হলে সঙ্গে সঙ্গে তার সমুদয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দ করতে হবে। পরবর্তীতে তিনি যদি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন তাহলে জব্দকৃত সম্পদ ফিরিয়ে দেয়া হবে। আর যদি তা না পারেন তাহলে জব্ধকৃত সম্পদ বিক্রি করে অর্জিত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হবে। আমাদের দেশে সাধারণত কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অবৈধ অর্থ অর্জনের অভিযোগ উত্থাপিত হলে তাকে আটক করা হয়। কিন্তু জেলে আটকে রাখা কোনো শাস্তি নয় বরং অধিকাংশ সময়ই এ পদক্ষেপ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিরাপত্তা প্রদান করে। ক’দিন আগে প্রকাশিত খবরে দেখলাম, একটি বহুস্তর মার্কেটিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, যিনি হাজার হাজার কোটি টাকা সাধারণ মানুষের নিকট থেকে গ্রহণ করে আত্মসাৎ করেছেন তিনি জামিনে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। যিনি এতবড় দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি রাজনৈতিক দল করার সাহস পান কিভাবে?