আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসনামলের দ্বিতীয়ার্ধে মধ্যপ্রাচ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি বাজারে ব্যাপক ধস পরিলক্ষিত হয়। তখন তার কারণ অনুসন্ধানে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে বেশ কয়েকটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছিল।
আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসনামলের দ্বিতীয়ার্ধে মধ্যপ্রাচ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি বাজারে ব্যাপক ধস পরিলক্ষিত হয়। তখন তার কারণ অনুসন্ধানে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে বেশ কয়েকটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রী-সচিবরাও বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন এবং তারা সংশ্লিষ্ট সরকার ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে বাজার খুলে দেওয়ার মৌখিক প্রতিশ্রুতি পেলেও কার্যত এসব সফরের ফলাফল ছিল শূন্য। কোন কোন সমীক্ষক বলেছেন যে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে মন্দার সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রভাব সর্বত্র পড়েছে এবং এর ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের চাকরিদাতা সরকারি ও বেসরকারি এজেন্সিগুলো তাদের কাজকর্ম গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে এবং এর পরিণতি হিসেবে এসব দেশে বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ হয় বন্ধ হয়ে গেছে বা সাংঘাতিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা বিদ্যমান শ্রমিকদের ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে। আবার কোন কোন সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি উদ্যোগের অভাব, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহে আমাদের দূতাবাসগুলোর নিষ্ক্রিয়তা, তাদের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় রক্ষার অভাব, জনশক্তির চাহিদা নিরূপণ ও তার ভিত্তিতে বাংলাদেশের রফতানিকারক এজেন্সিগুলোকে তা পূরণের ব্যাপারে সহযোগিতা না করার দরুনই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এসব সমীক্ষায় আবার এও বলা হয়েছে যে, জনশক্তি রফতানির বাজার দেখাশোনার মুখ্য দায়িত্ব সরকারের হলেও এতোদিন যাবৎ বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ঐ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করে এসেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেসরকারি এজেন্সিগুলোর ওপর অলিখিত বেশ কিছু বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়। তারা কার্যত স্বাধীনভাবে কাজ করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেন। অনেকে চাঁদাবাজির শিকার হন। এতে করে বিদেশী নিয়োগদাতাদের কাছ থেকে জনশক্তির চাহিদা সংগ্রহ ও তার ভিত্তিতে তা সরবরাহের ব্যাপারে তারা অনেকটা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। আবার পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের বৃহত্তম জনশক্তি রফতানি বাজার সৌদি আরবের রাজ পরিবারের একজন সদস্য রূপালী ব্যাংক ক্রয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন এবং তিনি অগ্রীম অর্থও পরিশোধ করেছিলেন। কিন্তু হাসিনার সরকার কোন রকম কারণ প্রদর্শন ছাড়াই বিলম্বের অজুহাত তুলে একতরফাভাবে এ চুক্তি বাতিল করে দেন। ফলে সৌদি সরকার ক্ষুব্ধ হন। ফলে তারা সৌদি আরবে বাংলাদেশী জনশক্তি আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এসব কারণগুলোর কোনটি সত্য, কোনটি অসত্য তা যাচাই করা এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তবে এটা সত্য যে, মধ্যপ্রাচ্য দূরপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশসমূহে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি আগের তুলনায় এ সময় প্রায় এক চতুর্থাংশে নেমে এসেছিল।
এসব দেশে নতুন জনশক্তি নিয়োগ যেমন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে তেমনি পুরাতন কর্মজীবীদের ছাঁটাই-এর পরিমাণও ব্যাপকভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। তারা নতুন করে নিয়োগ চুক্তি নবায়ন করতে পারছিলেন না কিংবা নিয়োগদাতা পরিবর্তন করতেও পারছিলেন না। ফলে হাজার হাজার প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছে । এতে জাতীয় অর্থনীতি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেমনি সামাজিক শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট হবারও যথেষ্ট কারণ দেখা দিয়েছে। তবে সমীক্ষা ও জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়েছে বাংলাদেশ সম্পর্কে মুসলিম দেশগুলোর একটি সাধারণ উপলব্ধি। একজন ব্যাংকার সম্প্রতি এক সেমিনারে বক্তব্যদানকালে এ গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধিটির কথাটি জানিয়েছেন। বলাবাহুল্য, প্রতিভাবান এ কর্মকর্তা একটি সেক্যুলার ব্যাংকে কর্মরত আছেন এবং হজ্ব করতে গিয়ে মক্কা মদিনায় প্রায় একশ’টি দেশের হাজীদের সাথে কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের ধারণা বর্ণনা করতে গিয়ে তাকে তারা যে কথাটি বলেছেন তা হচ্ছে, “কাদ নাজালা ইয়াজুজু ওয়া মাজুজু ফি বাংলাদেশ” অর্থাৎ বাংলাদেশে ইয়াজুজ মাজুজের আবির্ভাব ঘটেছে। সারাবিশ্বের মুসলমানদের কাছে ইয়াজুজ মাজুজ একটি পরিচিত নাম, একটি অত্যাচারী সম্প্রদায়। লুটপাট, খুন-খারাবী ও চরম অশান্তি সৃষ্টি এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কুরআনে সূরা আল কাহাফ-এ এদের কথা উল্লেখ রয়েছে।
এখন কথা হচ্ছে মুসলিম দেশগুলো কেন মনে করে যে বাংলাদেশে ইয়াজুজ মাজুজের আবির্ভাব ঘটেছে? প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী তাদের এ ধারণা থেকেই মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে এবং তার প্রভাব আমাদের জনশক্তি রফতানিসহ সামগ্রিক সম্পর্কের ওপর পড়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে মুসলিম বিশ্বে এ নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির পেছনে মুখ্যত কয়েকটি ঘটনা দায়ী বলে জানা যায়। এর একটি হচ্ছে ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে পুরানা পল্টনে একটি ইসলামী রাজনৈতিক দল কর্তৃক আয়োজিত সমাবেশে আওয়ামী লীগ দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলা এবং প্রকাশ্য রাজপথে সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ হত্যা ও নিহত ব্যক্তিদের লাশের ওপর উল্লাস ও নৃত্য প্রদর্শন। দ্বিতীয় ঘটনাটি হচ্ছে ২০১০ সালে নাটোরের বড়াই গ্রামে একই কায়দায় বিএনপি দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবুকে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে হত্যা। এ উভয় ঘটনা দেশি-বিদেশী টিভি চ্যানেলসমূহের বদৌলতে সারাবিশ্বের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে এবং মর্মাহত হয়েছে। ঘটনাগুলো ছিল পাশবিক ও নৃশংস। যাদের মধ্যে মানুষের সামান্য রক্তও আছে তাদের জন্য অসহনীয়। যুদ্ধে মানুষ হতাহত হয়। গুলীতে মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়। পিটিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা এবং উল্লসিত হয়ে লাশের ওপর নাচার ঘটনা দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। যারাই এ ঘটনাগুলো দেখেছেন তাদের মনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জেগেছে, বাংলাদেশের মানুষ কি আদিম যুগে ফিরে গেছে? তাদের এ নৃশংসতার মধ্যে মুসলিম বিশ্ব ইয়াজুজ মাজুজের বৈশিষ্ট্যকেই প্রত্যক্ষ করেছে এবং দেশটি সম্পর্কে তাদের মনে ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশে সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার এসেছিল এবং তারা তাদের দু’বছরের শাসনামলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার নামে আমাদের সকল মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং গণপ্রশাসনের ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন এনেছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাদের ঘোষিত মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে একটি প্রতিবেশি দেশের সাথে আঁতাত করে তাদেরই দ্বারা নিন্দিত একটি অপশক্তিকে ক্ষমতাসীন করেছে। এ অপশক্তিটি ২৮ অক্টোবরের হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িত ছিল। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলায় চার্জশীটও দিয়েছিল। কিন্তু তারা ক্ষমতায় এসে প্রথম যে কাজটি করেছেন তা হচ্ছে লগি-বৈঠা নিয়ে সংঘর্ষে নামার হুকুমদাতা শেখ হাসিনাসহ চার্জশীটভুক্ত সকল খুনের আসামির মামলা প্রত্যাহার এবং তাদের নির্দোষ ঘোষণা। তাদের এ সিদ্ধান্ত দেশে খুনি, সন্ত্রাসীদের নতুন জীবন প্রদান করে এবং পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের সহায়তায় তারা নতুন নতুন হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। তাদের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, খুন, রাহাজানি, গুম প্রভৃতি নতুন মাত্রা পায় এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিশেষ করে ইসলামপন্থীদের নির্মূল করার অশুভ অভিযানে তারা নেমে পড়ে। টুপি-দাঁড়িওয়ালা, নামাযী, ধার্মিক ব্যক্তিরা তাদের প্রধান টার্গেট হয়ে পড়ে। আলেম ওলামা ও ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হয় এবং তাদের ধ্বংস করার জন্য তারা স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধের ধুয়া তুলে বিচারের নামে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করতে শুরু করে।
তারা ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দদের ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে। এ দেশের বুক থেকে ইসলামী মূল্যবোধ ও অনুশাসনকে মুছে ফেলাই যে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সংবিধানে বিধৃত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি থেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসকে উচ্ছেদ করে তার স্থলে ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করার মধ্যদিয়ে। তারা এ সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকেও বিসমিল্লাকে বাদ দেয়ার অশুভ প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল এবং শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের এ দেশে কুরআন ও সুন্নাহকে শুধু অবজ্ঞাই করনি বরং সরকারি সংস্থা ইসলামিক ফাউন্ডেশনে প্রশিক্ষণের নামে মসজিদের ইমামদের ডেকে এনে কুরুচিপূর্ণ অশ্লীল ব্যালে নৃত্য প্রদর্শন করেছে যাতে মার্কিন ছেলেমেয়েরা অংশগ্রহণ করেছে। এদেশের মানুষের চিন্তা-চেতনাকে ধ্বংস করার জন্য সাংস্কৃতিক কর্মসূচির নামে ক্ষমতাসীনরা ইহুদী-মুশরিক সংস্কৃতিকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। এ উদ্দেশ্যে তারা বিদেশ থেকে সুন্দরী নর্তকী ও গায়ক-গায়িকাদের আমদানি করে অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং চরিত্র বিধ্বংসী উচ্ছৃঙ্খলতা ছড়িয়েছে। প্রতিবাদমুখর আলেম সমাজের উপর তারা হামলা-মামলা ও নির্যাতনও শুরু করেছে। আদালতের মাধ্যমে বোরকার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তারা মুসলিম মেয়েদের ফরজ দায়িত্ব পালনে বাধার সৃষ্টি করেছে এবং কুরআনে বিধৃত সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন করে নারী নীতি প্রণয়ন করেছে।
তাদের ইসলামবিরোধী অপতৎপরতা সারাদেশের ১৮ কোটি মুসলমানকে বিক্ষুব্ধ করে তুললেও প্রতিবাদ-বিক্ষোভ প্রদর্শনের মৌলিক অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করেছে। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, শিরকপন্থীদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং মসজিদের ইমাম ও খতিবদের অনুষ্ঠানে নগ্ন ব্যালে নৃত্য প্রদর্শনের জন্য দেশের খ্যাতনামা আলেম ওয়ালামারা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের যে ডিজির অপরসারণের জন্য আন্দোলন করেছেন হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত ফতোয়াবিরোধী রায়ের বিরুদ্ধে করা আপীলের নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় সে মহাপরিচালকের কাছেই মহামান্য আপীল আদালত মতামত প্রদানের জন্য পাঁচজন আলেমের তালিকা চেয়েছেন। আগেই বলেছি, বিতর্কিত মহাপরিচালক জনাব শামীম আফজাল ইতোমধ্যে তার ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য হক্কানী আলেম-ওলামা এবং বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে নিন্দিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। এ আলেম-ওলামারাই হাইকোর্টের ফতোয়াবিরোধী রায়ের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছর ধরেই আন্দোলন করেছেন। এ অবস্থায় মহাপরিচালক শামীম আফজাল আপীল আদালতে ফতোয়া সম্পর্কে কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকাহর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার জন্য হক্কানী কোন আলেমের তালিকা পেশ করবেন এটা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি। বলা বাহুল্য, শামীম আফজাল ইতিমধ্যে শত শত কোটি টাকার দায় নিয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন
আমি বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ ধ্বংসকারী কয়েকটি হত্যাযজ্ঞের কথা উল্লেখ করেছিলাম এবং বলেছিলাম যে কুখ্যাত ২৮ অক্টোবরের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ মামলার আসামীদের সরকার মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। অর্থাৎ সারা দুনিয়ার মানুষ যে হত্যাযজ্ঞ দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলেন সে হত্যাযজ্ঞ পতিত ক্ষমতাসীনদের কাছে কোন গুরুত্ব পায়নি। মানুষ হত্যার এ অপরাধ সরকারের দৃষ্টিতে কোন অপরাধই ছিল না এবং পরোক্ষভাবে এর অর্থ দাঁড়ায়, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের সদস্য হলে তারা যত অপরাধই করুক না কেন তা সব বৈধ। তাদের সামনে আইনের শাসন মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। অত্যাচার অবিচারের এর চেয়েও বড় দৃষ্টান্ত কি দুনিয়ায় আছে? এসব হত্যাকাণ্ডের পর তারা আরও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, জাহাঙ্গীরনগর এবং শাহজাহাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠসমূহে কোথাও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের মাধ্যমে, আবার কোথাও প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করে তারা শিক্ষাপতিষ্ঠানসমূহে অগনিত হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু কোন বিচার হয়নি। অন্যান্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড তো আছেই।
নাটোরের বড়াইগ্রামের উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবু হত্যার সাথে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার ভিডিও ফুটেজ ও সচিত্র রিপোর্ট যথাক্রমে টিভি চ্যানেলসমূহ ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সরকার দলীয় নেতাদের চাপে প্রথমদিকে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেনি। কিন্তু পরবর্তীকালে পত্রপত্রিকাসমূহ সমালোচনামুখর হয়ে পড়ায় এদের ১৯ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাদের বিচার ও শাস্তি প্রদানের ব্যাপারে যে লক্ষণ দেখা গেছে তাতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, এ মামলাটির ভাগ্য ২৮ অক্টোবরের মামলার মতোই হবে। আসামীদের ইতোমধ্যে জামিন দেয়া হয়েছে- যদিও জামিনের ব্যাপারে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য এরই মধ্যে উচ্চ আদালতের তরফ থেকে রুল দেয়া হয়েছিল। বলাবাহুল্য, আওয়ামী আমলে বাংলাদেশের বিদ্যমান অবস্থার আলোকে দেখা যায়, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড তো দূরের কথা অন্য যেকোন ফৌজদারী অপরাধের ব্যাপারে বিরোধী দলসমূহের নেতাকর্মীদের দূরতম যদি কোন সংশ্লেষও পাওয়া যায় অথবা ভবিষ্যতে অপরাধ করতে পারে এ ধরনের সামান্যতম সন্দেহও যদি পুলিশের মনে সৃষ্টি হতো তাহলে তাদের গ্রেফতার করা হতো এবং আদালত তাদের জামিন দিতো না।
অধ্যাপক মুজিবুর রহমানসহ জামায়াতের কয়েকজন নেতাকর্মী একটি দোয়ার মাহফিলে শামিল হচ্ছিলেন। এই অবস্থায় তাদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়। দীর্ঘকাল পর্যন্ত আদালত তাদের জামিন দেননি। পরবর্তীকালে জামিন দেয়া হলেও জেলগেট থেকেই তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং বলা হয় যে, সরকারের বিরুদ্ধে ঐ দিন মিরপুরের একটি বাড়িতে ষড়যন্ত্র করছিলেন। যিনি মুক্তি পেয়ে জেলগেট থেকেই বাড়িতে পৌঁছতে পারলেন না তিনি সরাসরি কিভাবে অন্য আরেকটি স্থানে গিয়ে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। দেশবাসী এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়নি। প্রায় একই রকমের অবস্থা হয়েছে ঢাকা মহানগরীর তৎকালীন আমীর বর্তমান সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানের ব্যাপারেও। তাকে গ্রেফতার করে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়, দীর্ঘকাল আটক রাখার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে তাকে মুক্তি দিয়ে জেলগেট থেকেই পুনরায় নতুন আকেরটি মামলায় গ্রেফতার করা হয়। এ মামলায় একটি নির্ধারিত তারিখ ও মাস উল্লেখ করে বলা হয় যে, ঐদিন তিনি হরতালের সমর্থনে নটরডেম কলেজের সামনে পিকেটিং এর নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং নিজ হাতে বাস ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন। কিন্তু জেলখানার ও আদালতের রেকর্ডপত্রে দেখা গেছে যে, ঐদিন জনাব খান মুক্ত মানুষ ছিলেন না। জেলখানাতেই বন্দি ছিলেন। বিষয়টি আদালতের গোচরীভূত করা হয়েছিল, কিন্তু মিথ্যা রিপোর্ট দেয়ার জন্য আদালত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেননি এবং তাকে মুক্তিও দেননি। বিচারের বাণীকেও এখানে নীরবে নিভৃতে কাঁদতে দেখা যায়। এগুলো অতীতের ঘটনা হলেও ভুলে যাবার মত নয়। অপরাধী আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দকে তাদের এ ধরনের লক্ষ লক্ষ অপরাধের যদি শাস্তি দেয়া না হয় এবং রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পায় তা হলে দেশ ও জাতি কলংক মুক্ত হবে না।
আওয়ামী শাসনামলে বাংলাদেশে এ ধরনের অবিচার, নির্যাতন, অমানবিক আচরণ, অত্যাচার, নিপীড়ন, নিষ্ঠুরতা, লুন্ঠন, হত্যাযজ্ঞ প্রতিদিনই ঘটেছে। পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলসমূহে এর খণ্ডিত চিত্র বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছেন। এ অবস্থায় মুসলিমবিশ্ব এ অত্যাচারীদের মধ্যে যদি ইয়াজুজ মাজুজের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পায় তাহলে কিছু করার আছে কি? তাদের এ অনুভূতি থেকেই এ দেশের সাধারণ মানুষ সম্পর্কে বিদেশীদের ধারণা পাল্টে যায়। তারা বাংলাদেশী বলতেই খুনি-সন্ত্রাসী বুঝছেন। ৩৬ জুলাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুথানে আওয়ামী লীগ পালিয়েছে। দেখা যাচ্ছে আরেকটি দল সন্ত্রাস নৈরাজ্য নিয়ে তাদের স্থান দখল করেছে। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশীরা তেল সমৃদ্ধ দেশসমূহ ও উন্নয়নশীল এবং উন্নত মুসলিম দেশসমূহে চাকরির অযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে তেমনি বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগও তাদের আকর্ষণ হারাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ও তার ফ্যাসিবাদী শাসকদের অত্যাচারে অতীষ্ঠ দেশবাসী তাদের পতন ও পদত্যাগ কামনা করেছিল। ক্ষমতায় যাবার আগেই যে দলটি সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হত্যা, লুন্ঠন ও চাঁদাবাজীতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে দেশবাসী তাদের থেকে পরিত্রাণ চায়। আমার বিশ্বাস এ পরিত্রাণ তখনই তারা পেতে পারেন যখন নির্বাচনে তারা সৎ, যোগ্য ও আদর্শবান ব্যক্তিদের উপর দেশ শাসনের ম্যাণ্ডেট অর্পণ করবেন।