আজকের আলোচনা শুরু করছি ভারতীয় মুসলিম নারী সেনা কর্মকর্তা কর্নেল সোফিয়া কোরেশীকে দিয়ে। জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ হিসাবে ভারত পাকিস্তানে যে ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরিচালনা করেছিলো,
আজকের আলোচনা শুরু করছি ভারতীয় মুসলিম নারী সেনা কর্মকর্তা কর্নেল সোফিয়া কোরেশীকে দিয়ে। জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ হিসাবে ভারত পাকিস্তানে যে ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরিচালনা করেছিলো, সে অপারেশনের স্পোকসপারসন ছিলেন ভারতীয় সেনা বাহিনীর এ চৌকস ও মেধাবী নারী অফিসার। ভারত সরকার বা ভারতীয় আর্মি তার উপর আস্থা রেখেছিলো। তিনি অপারেশন সিঁদুরের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, সর্বশেষ খবরা-খবর গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্টদের অবহিত করতেন। মিসেস কোরেশী ঐতিহ্যবাহী সেনা পরিবারের সন্তান। তার পিতামহ ও পিতা ভারতীয় আর্মিতে সততা, নিষ্ঠা ও সুনামের সাথে চাকরি করেছেন। তার স্বামী তাজুদ্দীন কোরেশীও ভারতীয় সেনা বাহিনীর একজন গর্বিত মুসলিম কর্মকর্তা।
ঘটনাক্রমে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর স্পেকসপারসনের দায়িত্ব পড়েছিলো কর্নেল সোফিয়ার ওপর। তিনি নিজের ধর্ম পরিচয়ে বৃত্তাবদ্ধ না থেকে একজন ভারতীয় নাগরিক ও সেনা কর্মকর্তা হিসাবে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে যথাযথভাবে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জীবন একটাই। তাই তা দেশের জন্য লিখে দেওয়াই শ্রেয়’। তার এ বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তিনি নিজ জন্মভূমির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও জাতীয় নিরাপত্তায় যেকোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত আছেন এবং থাকবেন। এক্ষেত্রে তার ধর্ম পরিচয় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, ভারতে ক্রমবর্ধমান উগ্রবাদী রাজনীতির তোপে তিনি কোনভাবেই ভারতীয় হতে পারেন নি বরং হয়ে গেলেন পাকিস্তানের কথিত সন্ত্রাসীদের বোন।
ধর্ম বিশ্বাসের পার্থক্যের কারণে তার বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হলো রাষ্ট্রের একেবারে শীর্ষ পর্যায় থেকে। উল্লেখ্য, মিসেস কোরেশী সম্পর্কে দেশটির মধ্যপ্রদেশের বিজেপির সরকারের উপজাতি কল্যাণমন্ত্রী বিজয় শাহ কোন রাখঢাক না করে বলেই ফেলেছেন, ‘আমাদের হিন্দু ভাইদের যেসব সন্ত্রাসীরা বিবস্ত্র করে পেহেলগামে হত্যা করেছিলো, মোদিজী সেসব সন্ত্রাসীদের এক বোনকে পাঠিয়ে ওদের উলঙ্গ করে শিক্ষা দিয়েছেন’। বিজেপি মন্ত্রীর এমন মুসলিম বিদ্বেষী ও ঘৃণাত্মক সাম্প্রদায়িক বক্তব্য সোসাল মিডিয়ায় রীতিমত ভাইরাল হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে। কিন্তু উগ্রবাদী ঘৃণার হাত থেকে তিনি রক্ষা পাননি। এজন্য তার নিরাপত্তা জোরদার করতে হয়েছে। এমনকি এ ঘটনার জের ধরে সোফিয়া কোরেশীর শ্বশুর বাড়ীতে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। যা ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার অবগুণ্ঠন উন্মোচন করেছে।
এবার আসছি শহীদ ঝন্টু আলী শেখের কথায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এ মুসলিম হাবিলদার পেহেলগাম ট্রাজেডির দিনে সেখানেই কর্মরত ছিলেন এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই করতে গিয়ে গুলীবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। তার কফিন যখন নদিয়ায় গ্রামের বাড়ীতে এসেছিলো তখন সেখানে স্বজনদের আহাজারিতে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিলো। সদ্য বিধবা হওয়া স্ত্রী শাহনাজ পারভীন স্বামী শোকে নিজের পায়ে ভর করে দাঁড়াতেও পারছিলেন না। তারপরও তাকে স্বামীর লাশের পাশে দাঁড়িয়ে ভারতীয় জাতীয় পতাকা উচ্চকিত করতে দেখা গেছে। তার বড় ভাই সুবেদার রফিকুল শেখের পাকিস্তানের দিকে প্রতিশোধের তোপ ধর্মীয় বিশ্বাস কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। স্বামী বিচ্ছেদের শোকে পাথর চলৎশক্তিহীন স্ত্রী শাহনাজ পারভীনের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে কথিত হত্যাকারী পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ। তার মুখ থেকে অবলীলায় বেরিয়ে এসেছে, ‘দেশটাকে (পাকিস্তানকে) বোম মেরে উড়িয়ে দাও গো’। এক্ষেত্রে ধর্ম কোনভাবেই প্রতিবন্ধক হয়নি। পাকিস্তানের গোলাতে নিহত হওয়া মুসলিম সৈন্য ইমতিয়াজের ক্ষেত্রেও ঘটেছে একই ঘটনা। তবে কোন ক্ষেত্রেই ধর্মীয় বোধ-বিশ্বাস প্রাধান্য পায়নি বরং দেশাত্মবোধই সর্বোচ্চ প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সাথে পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার বিষয়টি এখনো প্রমাণিত হয়নি। পাকিস্তান এ নিন্দনীয় ঘটনার জন্য আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানালেও ভারত তাতে মোটেই কর্ণপাত করেনি বরং গায়ে পড়ে যুদ্ধ বাধানোর জন্য পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রতিশোধমূলক ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরিচালনা করে মসজিদ-মাদ্রাসা ধ্বংস এবং বেসামরিক লোকজনদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। অথচ ভারতীয় সরকার পুরো ভারতবাসীকে জানিয়ে দিয়েছে যে, এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাথে পাকিস্তান জড়িত। কিন্তু সন্ত্রাসীদের হামলায় স্বামী হারানো শাহনাজ পারভীন কখনো জানতেই পারবেন না তার স্বামীর প্রকৃত হত্যাকারী কে? অথচ তার মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে অন্ধ পাকিস্তান বিদ্বেষ। বিষয়টি নিয়ে খোদ ভারতের আত্মসচেতন মহলে নানাবিধ প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তারাও এ বিষয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে সন্দেহের চোখেই দেখছেন।
মূলত, স্বাধীনতার পর থেকে ভারত যতবারই পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, মুসলিম সৈন্যরা সকল যুদ্ধেই পাকিস্তানের সাথে বিরোচিত লড়াই করেছেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ এবং ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধে ভারতীয় মুসলিম সৈন্যরা অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, ধর্মবিশ্বাসের ভিন্নতার কারণেই তারা ভারতীয় হতে পারেন নি বরং ভারতীয় মুসলমান বরাবরই জুলুম-নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। কথিত বিশ্বাসের ধুঁয়া তুলে ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের রাম মন্দির বানানো হয়েছে।
এখন প্রত্যেক মসজিদের নিচে মন্দির খোঁজার অশুভ তৎপরতা শুরু হয়েছে। তাজমহলকে ‘তেজোমহালয়া মন্দির’ দাবি করে সেখানে হিন্দুদের পূজা-অর্চনার দাবি জানানো হচ্ছে। এমনকি ভারতীয় উগ্রবাদীরা পবিত্র মক্কা নগরীর ‘মসজিদুল হারাম’কে ‘মক্কেশ্বর মন্দির’ বলে দাবি করে দখলের হুমকির খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। মূলত, ভারতীয় উগ্রবাদীদের ভাষায় মুসলমান মানেই সন্ত্রাসী, পাকিস্তানী; নয়তো বাংলাদেশী। এমনকি তাদের মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনুপ্রবেশকারী হিসাবেও আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। অথচ ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভারতীয় মুসলমানদের প্রায় সকলেই ভূমিপুত্র ও হিন্দু ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত মুসলিম। এদেরকে বহিরাগত বা অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। মূলত, উগ্রবাদীদের এমন ঘৃণা ভারতের মত বৃহৎ গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য মোটেই শোভনীয় নয়। অভিজ্ঞমহল বিষয়টি ভারতের ‘ক্ষয়রোগ’ হিসাবেই বিবেচনা করছেন।
পেহেলগামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর উগ্রবাদীরা যেন রীতিমত মওকা পেয়ে বসেছে। তারা ভারত জুড়ে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করে মুসলিম বিদ্বেষকে রীতিমত উস্কে দিয়েছে। দেশটির মধ্যপ্রদেশ, অযোধ্যা, গুজরাট ও দিল্লীসহ বিভিন্ন স্থানে মুসলামানদের বিশেষ করে বাংলাভাষী মুসলমানদের আটক করে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করা শুরু করেছে। এমনকি অনেক মুসমানকে ইতোমধ্যেই জেলে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। অথচ তারা প্রত্যেকেই ভারতের বৈধ নাগরিক। ভারতের একশ্রেণির মিডিয়া তো বিষয়টিকে বিদ্বেষ ছড়ানোর মোক্ষম হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছে। ভারতের রিপাবলিক বাংলার কথিত সাংবাদিক ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ তো সব বাদ দিয়ে মহল্লায় মহল্লায় পাকিস্তানী খোঁজার ঘোষণা দিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক দাংগা বাধানোর ধান্ধায় রয়েছেন। হয়তো তার ভাষায়, মুসলমান মানেই পাকিস্তানী। তা নাহলে ভারতের মহল্লায় মহল্লায় পাকিস্তানীদের উপদ্রব শুরু হলো কীভাবে? তিনি মাঝে মাঝে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম আবার কখনো পুরো বাংলাদেশ দখল করার দিবাস্বপ্ন দেখেন। অথচ তিনি বেমালুম ভুলেই যান এটা মধ্যযুগ নয় বরং একবিংশ শতাব্দী। আর পশ্চিম বাংলার বিরোধী দলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী ২৬-এর পরিবর্তে ২৬০ লাশ ফেলানোর ঘোষণা দিয়ে সে আগুনে রীতিমত ঘি ঢেলে দিয়েছেন। মূলত, ভারতীয় মুসলিমরা জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখলেও উগ্রবাদীরা তাদেরকে কখনোই ভারতীয় হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। এমনকি দেশটির কোন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথেই সুসম্পর্ক নেই।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভাজিত হয়ে বিশ্বমানচিত্রে পাকিস্তান ও ভারত নামের পৃথক দু’টি জাতিসত্ত্বার উন্মেষ ঘটেছিলো। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে পাকিস্তান গঠনের কথা থাকলেও ঔপনিবেশিক দুর্বৃত্ততা এক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা দেখাতে পারেনি। প্রায় শতভাগ মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে পাক-ভারতের মধ্যে স্থায়ী বৈরিতার বীজ বপন করা হয়েছিলো। সে মানদণ্ডে ভারতের পশ্চিম বাংলাও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা। এমনকি ১৯৪৭ সালে ভারতের পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদে কয়েকদিন ভারতীয় পতাকা উড়ানো হয়েছিলো। কিন্তু এক অদৃশ্য কারণে পশ্চিম বাংলা পাকিস্তানভুক্ত হয়নি।
যাহোক ভারত বিভাজনের পর ভারতীয় অংশের অনেক মুসলমান দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে যেতে চাননি বরং তারা জন্মভূমি ভারতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তারা আশাবাদী ছিলেন যে, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভারতে তারা পূর্ণ নাগরিক মর্যাদায় বসবাস করতে পারবেন। ধর্মবিশ্বাস এক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। সে সময় কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ভারতীয় মুসলমানদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ১৯৪৭ সালে দিল্লীর জামে মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে এক আবেগঘন বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘মুসলমান ভাই-বোনেরা, তোমরা কোথায় যাচ্ছ? এ দেশ তোমাদের। এখানে তোমাদের পূর্বপুরুষদের কবর রয়েছে’। আজ সে দিল্লীতেই অবস্থিত দেশের সংসদে এক বিল এলো যা ঐ জামে মসজিদের সিঁড়িই মুসলমানদের কিনা, সে প্রমাণ তলব করছে। কথিত ওয়াকফ আইন সংশোধনী বিলের নামে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে মুসলমানদের হাজার বছরের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোকে। যা দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্যকে রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব শহীদ নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার পলাশীর আম্র কাননের ষড়যন্ত্রমূলক ও প্রহসনের যুদ্ধে পরাজয় এবং নির্মমভাবে হত্যার পর ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তন হয়। এরপর একের পর এক ভারতের বিভিন্ন রাজ্য দখল করে নেওয়া শুরু করে। ১৭৯৯ সালে শহীদ ফতেহ আলী টিপু সুলতান, ১৭৬৪ সালে মীর কাসেমের নেতৃত্বে বক্সারের যুদ্ধ, ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ এবং ১৮৫৮ সালে ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মী বাঈ ইংরেজদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললেও ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিলম্বিত উপলব্ধির কারণে এসব প্রতিরোধ শেষ পর্যন্ত সাফল্য পায়নি। ফলে পুরো ভারত বর্ষের ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কিন্তু স্বাধীনচেতা ভারতীয়রা ঔপনিবেশিক শাসনের কাছে কোন ভাবেই মাথানত করেনি বরং ১৯০ বছরে অসংখ্যবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো। এতে ভারতীয়দের জানমালের অনেক ক্ষতি হয়েছে। নারীরা সম্ভ্রম হারিয়েছেন। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন ভারতবর্ষের আজাদী পাগল মুসলমানরা। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ইন্ডিয়া গেইটের স্মৃতিস্তম্ভ থেকে। ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রে এ স্মৃতিস্তম্ভে ৯২৩৬৩ জন শহীদের নাম খোদিত হয়েছে, যেখানে মুসলিম শহীদের সংখ্যা ৬২৯৪৫। এতে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের অবদান কতখানি। কিন্তু দেশটিতে উগ্রবাদী রাজনীতির উত্থানে মুসলমানরা এখন নিজে গৃহেই পরবাসী। যা খুবই অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত।
মূলত, ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম-হিন্দু কারোর অবদানকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু ধর্মীয় বিদ্বেষ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চার অনেক ক্ষেত্রেই মুসলমানদের অবদান সঠিকভাবে আলোচনা করা হয় না। স্বাধীনতার প্রায় ৮ দশক ধরেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস আলোচনা হয়ে থাকে। কিন্তু সেসব আলোচনা হয় অনেকটাই একপেশে, বিদ্বেষপূর্ণ ও পক্ষপাত দুষ্ট। সেসব আলোচনায় স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের অবদানের কথা কালেভদ্রেও স্বীকার করা হয় না।
নিরপেক্ষভাবে ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের পরবর্তী সময় থেকে যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বেধে উঠেছিলো, সেসব আন্দোলনে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ছিল উল্লেখযোগ্য অবদান। প্রসঙ্গত, সৈয়দ হাসান ইমাম ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতা। তাঁর উদ্যোগে ১৯১২ সালে বাঁকিপুরে জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন হয়। অ্যানি বেসান্ত গৃহবন্দী হলে তিনি তার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। হাসান ইমাম রাউলাট আইনের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি হোমরুল আন্দোলন, ১৯২৭ সালে সাইমন কমিশন বয়কট আন্দোলন ও আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।
উত্তর পশ্চিম ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতা ছিল উল্লেখযোগ্য। যখন ভারতের বিপ্লবীরা বাইরের দেশ থেকে অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে সর্বাত্মক সংগ্রাম চালানোর চেষ্টায় ছিলেন, তখন উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুজাহিদ বা মুজাহিড ওয়াহাবিগণ অনেকটা ধর্মীয় কারণ হলেও ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার ইচ্ছা পোষণ করতেন। ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হলে তুরস্কের সুলতান ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ান। কাজেই ভারতের মুসলমানরাও তুরস্কের সুলতানের সমর্থনে ইংরেজগণকে তাঁদের শত্রুরূপে বিবেচনা করেন। লাহোর, পেশোয়ার, কোহাট প্রভৃতি অঞ্চল থেকে অনেক মুসলমান ছাত্র মৌলভি ওবেদুল্লা, মৌলভি মামুদ হাসান প্রমুখের নেতৃত্বে আরব মুল্লুক ও মধ্যপ্রাচ্যের আরও কয়েকটি মুসলমান শাসিত দেশের কর্তৃপক্ষকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে উৎসাহিত করেন।
১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর কাবুলে স্বাধীন ভারতের যে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল তার রাষ্ট্রপতি ছিলেন মহেন্দ্রপ্রতাপ ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মৌলভি বরকতুল্লাহ্। বরকতুল্লাহ্ আফগানিস্তান থেকে বার্লিনে ফিরে গিয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি গঠন করেন। ১৯২৭’র ১০-১৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসে যে উপনিবেশিক অত্যাচার ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সম্মেলন হয়েছিল সেখানে তিনি সানফ্রানসিস্কোর হিন্দুস্থান গদর পার্টির প্রতিনিধি হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন।
খান আবদুল গফফর খান ‘খুদাই খিদমদগার’-গণদেশপ্রেমিক ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি গান্ধীজির অহিংস নীতির সংস্পর্শে এসেছিলেন। ১৯১৯ সালের মার্চে কুখ্যাত রাউলাট বিল আইনে পরিণত হয়। এর প্রতিবাদে ৬ এপ্রিল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পালিত হয় হরতাল। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আব্দুল গফফর খান। তিনি গ্রেপ্তার হন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মজহারুল হক একটি উল্লেখযোগ্য নাম। তিনি হোমরুল আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। পাটনায় হোমরুল লিগ শাখার সভাপতি হয়েছিলেন। তাঁর বেশ কয়েকটি ইংরেজ বিরোধী লেখা ‘দি মাদার ল্যান্ড’-এ প্রকাশিত হলে তিনি গ্রেপ্তার হন। মজহারুল রচিত ‘ঞযব এৎবধঃ ঞৎরধষ’ গ্রন্থে গান্ধীজির কারাবরণ সম্পর্কে লিখেছিলেন।
মহম্মদ আলি ও শওকত আলি স্বাধীনতা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৯১৯ সালের ১০ এপ্রিল গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সৈফুদ্দিন কিচলু। ১৯২১ সালে তিনি করাচিতে এক মামলায় কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তাঁর বিরুদ্ধে দেশীয় সৈন্যদের বিদ্রোহ করায় উসকানি দেওয়ায় অভিযোগ ছিল। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ এক নির্দেশ জারি করে বলেছিল, তিনি কোনো জনসভায় বক্তৃতা দিতে পারবেন না। ১৯২৯ সালে লাহোর কংগ্রেসের অধিবেশনে জহওরলাল নেহরু পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। কিচলু একে সমর্থন করেছিলেন। ডা. মহম্মদ আলি আনসারি জাতীয় আন্দোলনে একটি বিশিষ্ট নাম। ১৯২০ সালে তিনি মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলেও তাঁর সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিল না। তিনি অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে তিনি বহুবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
১৯২০ সালে বর্ধমানে আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেস সংগঠন গড়ে উঠেছিল। ১৯২১ সালে বর্ধমান জেলা কংগ্রেস কমিটি গঠিত হয়। প্রথম সভাপতি ছিলেন মৌলভি মহম্মদ ইয়াসিন। বর্ধমান জেলার মুসলমান নেতাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জাতীয় কংগ্রেসে কাজ করতেন। আবুল কাশেম চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ পার্টিতে যোগদান করেছিলেন। আব্দুল কাদের, আবুল হায়াত, কচি মিয়া, আব্দুল সাত্তার প্রমুখ নেতা জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। ভারতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনে হাকিম খান একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। ১৯১৭ সালে তিনি গান্ধীজির সংস্পর্শে এসেছিলেন। ১৯২০ সালে তিনি সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘হাজিক-উল-মুল্ক’ উপাধি বর্জন করেছিলেন। দেশবাসী তাঁকে ‘মামিন-উল-মুল্ক’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কাজী নজরুল ইসলামের অবদানকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। ১৯১৪ সালে শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধে অনেক যুব বাঙালি সৈনিক হিসাবে যোগদানে ইচ্ছুক ছিলেন। নজরুল সৈন্য বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। সে সময় বাঙালি সৈন্যদের নিয়ে ডবল কোম্পানি নামে একটি কোম্পানি গঠন করেছিলেন। পরবর্তীতে এ ডবল কোম্পানিটিকে ৪৯ নম্বর রেজিমেন্টে পরিণত করা হয়েছিল। করাচি সেনানিবাসে থাকার সময় নজরুল অনেক দেশাত্মবোধক গল্প ও কবিতা রচনা করেছিলেন। ১৯২০ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে অহিংস অসহযোগ প্রস্তাব গৃহীত হলে নজরুল গানে জয়ধ্বনি দিলেন-‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর।/ তোরা সব জয় ধ্বনি কর।/ ঐ নূতনের কেতন ওড়ে/ কাল বোশেখীর ঝড়’।
মৌলানা হসরত মোহানি স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র ঘৃণা ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনা করে তিনি লিখেছিলেন-সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করতে চায়, এমন কর্মসূচিতেই আমি বিশ্বাস রাখি। জীবনভর এটাই আমার কর্মসূচি থাকবে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কর্মসূচি সম্পন্ন যে কোনো দলেই আমি যোগ দেব। ব্রিটিশ বিরোধী লেখার জন্য তাঁকে ছ’বছর ব্রিটিশ কারাগারে বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছিল। ১৯২১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের আহমদাবাদ অধিবেশনে তিনি প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। গান্ধীর বিরোধিতাকে উপেক্ষা করেই তিনি এ প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। তাঁর এ প্রস্তাব পরাস্ত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এটির তাৎপর্য ছিল অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, রামপ্রসাদ বিসমিল ও আসফাকুল্লা খান প্রমুখ মোহানির সঙ্গে পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে অনেক প্রতিনিধির সমর্থন সংগ্রহ করে ফেলেছিলেন। কংগ্রেসের পরবর্তী অধিবেশনগুলোতেও প্রস্তাবটি পেশ করা হয়েছিল। ১৯২৯ সালে লাহোর অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্য গৃহীত হয়েছিল।
খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯২০ সালের ২০ জানুয়ারি দিল্লীতে অনুষ্ঠিত খিলাফত কমিটির এক সভায় গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিটি দিয়েছিলেন। এ সভার কয়েকদিন পর মীরাটে অনুষ্ঠিত খিলাফত সম্মেলনে কর্মসূচিটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল। ১৯২১ সালের জুলাই মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত খিলাফত সম্মেলনে যে প্রস্তাবগুলো গৃহীত হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতের স্বাধীন রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য অসহযোগ আন্দোলনের সংকল্প। প্রসঙ্গত, অসহযোগের প্রস্তাব প্রথমে উঠেছিল কংগ্রেস থেকে নয়, সেন্ট্রাল খিলাফত কমিটি ও ‘জমিয়তুল উলাম-ই-হিন্দ’ থেকে। (চলবে)