৪০ মাস ধরে ইউক্রেন রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মস্কো দেশজুড়ে বড় ধরনের আক্রমণ চালানোর পর থেকে ইউক্রেনকে বারবার ভয়ংকর ও ধ্বংসাত্মক হামলার মুখে পড়তে হয়েছে।
এই ৪০ মাসে কয়েক হাজার মানুষ নিহত বা আহত হয়েছেন। কোটি মানুষ ঘরছাড়া। ইউক্রেনের শিল্পকারখানা, দোকানপাট, স্কুল, হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস হয়েছে। উর্বর কৃষিজমি নষ্ট হয়ে গেছে। শিশুদের অনেকেই এতিম হয়েছে। অনেককে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অথবা জোর করে অপহরণ করা হয়েছে।
ইউক্রেন বহুবার সাহায্যের জন্য বিশ্বের কাছে আবেদন করেছে, কিন্তু এই সহিংসতা থামানো যায়নি। সেনাসংখ্যায় কম ও অস্ত্রে দুর্বল ইউক্রেন তবু যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
এই ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যেও ইউক্রেনের সাহস আর প্রতিরোধ এতটাই সুবিদিত হয়ে গেছে যে অনেকে সেটাকে আর গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন না। যেন এটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হয়ে গেছে। অথচ বাস্তবতা ভীষণ ভয়ানক। এখন প্রায় প্রতিদিনই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের বাহিনী ড্রোন দিয়ে কিয়েভসহ নানা শহরে হামলা চালাচ্ছে। এ কারণে সাধারণ মানুষ ভয়ে থাকছে।
একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য কমে গেছে, শান্তি আনার চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে, আর ইউক্রেনের সেনারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁরা ফ্রন্টলাইনে খুব অল্প গোলাবারুদ আর সরঞ্জাম নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।
এই অবস্থায় যদি কেউ ইউক্রেনের সাহসের প্রশংসা না করে বা গুরুত্ব না দেয়, তাহলে সেটা বড় ভুল হবে। এখন যে প্রশ্নটা কল্পনার বিষয় নয়, বরং একদম বাস্তব, সেটি হলো: যদি ইউক্রেন হেরে যায়, তাহলে কী হবে?
এর উত্তর হলো: যদি ইউক্রেন ভেঙে পড়ে, তাহলে তা হবে পশ্চিমাদের জন্য একটি বড় কৌশলগত ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা আফগানিস্তান বা ইরাক যুদ্ধের চেয়েও বড় বিপর্যয়কর হতে পারে। ইউরোপ, ব্রিটেন, ট্রান্সআটলান্টিক জোট এবং আন্তর্জাতিক আইনের ওপর এর বিরূপ প্রভাব হবে ভয়াবহ। আমাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার জন্য এ চিন্তাই যথেষ্ট হওয়া উচিত।
২০২৩ সালের শেষ দিকে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, ইউক্রেন জিতছে না। এ বছরজুড়ে রুশ বাহিনী দোনেৎস্কসহ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধক্ষেত্রে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে।
নিজের যত ক্ষয়ক্ষতি হোক না কেন, তা রাশিয়া পাত্তা দিচ্ছে না। অনুমান করা হচ্ছে, রাশিয়ার হতাহত সেনার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তবু তারা থেমে নেই। যদিও রাশিয়া এখনো বড় কোনো জয় পায়নি, তবু ইউক্রেনের সেনাদের জন্য প্রতিটি দিন এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। তাঁরা এখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন; এটাও একধরনের বিস্ময়।
নিজের যত ক্ষয়ক্ষতি হোক না কেন, তা রাশিয়া পাত্তা দিচ্ছে না। অনুমান করা হচ্ছে, রাশিয়ার হতাহত সেনার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তবু তারা থেমে নেই। যদিও রাশিয়া এখনো বড় কোনো জয় পায়নি, তবু ইউক্রেনের সেনাদের জন্য প্রতিটি দিন এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। তাঁরা এখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন; এটাও একধরনের বিস্ময়।
ইউক্রেন আর কত দিন যুদ্ধের ময়দানে, আকাশপথে এবং কূটনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকতে পারবে, এখন সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। দেশটি এখন সেনাসংখ্যা, গোলাবারুদ ও শত্রুপক্ষের হামলা ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেপণাস্ত্রের সংকটে ভুগছে। তবে এখনো তারা পাল্টা আঘাত হানতে সক্ষম। রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলের একটি অংশে ইউক্রেনের দখল প্রতিষ্ঠা এবং গত মাসে রাশিয়ার গভীরে অবস্থিত কৌশলগত বোমারু ঘাঁটি ধ্বংস করা—এগুলো ছিল বিস্ময়কর ঘটনা। কিন্তু এ ধরনের কিছু অস্থায়ী সাফল্য আসল শক্তির ভারসাম্য বা যুদ্ধের সামগ্রিক গতিপথ বদলাতে পারছে না।
ইউক্রেন ধীরে ধীরে বিশ্বমঞ্চেও বিশ্বস্ত মিত্র হারাচ্ছে। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, তাদের কখনোই সত্যিকারের নির্ভরযোগ্য মিত্র ছিল না। পুতিন তাঁর নিজের ‘মিত্রদের জোট’ গড়ে তুলেছেন। এই জোটে আছে চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ। তারা রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্রকে সমর্থন দিচ্ছে। এর বিপরীতে পশ্চিমা দেশগুলোর জোট (যা মূলত ব্রিটেন ও ফ্রান্স নেতৃত্ব দিচ্ছে) কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। ইউক্রেনকে আশ্বস্ত করতে সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনাও এগোচ্ছে না।
পুতিনের একগুঁয়েমি এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের অদক্ষতার কারণে কোনো যুদ্ধবিরতি সম্ভব হচ্ছে না। তেমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
গত সপ্তাহে লন্ডনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার আবারও আগের মতো ইউক্রেনের প্রতি ‘অটল সমর্থনের’ অঙ্গীকার করেছেন। এসব বলা সহজ, কিন্তু কার্যকর সামরিক সহায়তা দেওয়া অনেক কঠিন।
ইউরোপের অন্য দেশগুলোর মতো যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের কাছেও এমন উন্নত অস্ত্র বা সরঞ্জাম নেই। এগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে কেবল যুক্তরাষ্ট্রই সরবরাহ করতে পারে।
এই ঘাটতি পূরণে জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিক মের্ৎস যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা কিনে তা কিয়েভকে উপহার দিতে প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও গত মাসের ন্যাটো সম্মেলনের মূল অগ্রাধিকার নিজেদের প্রতিরক্ষা। ইউক্রেনকে ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করার পাশাপাশি জার্মানি নিজের সামরিক বাজেট তিন গুণ বাড়াচ্ছে। যুক্তরাজ্যও একই পথে হাঁটছে।
এদিকে ট্রাম্প (যাঁকে অনেকে বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘আত্মসমর্পণপ্রবণ নেতা’) এখন ইউক্রেনের কূটনৈতিক অস্থিরতার সবচেয়ে বড় কারণ। তিনি যে একতরফা ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা রাশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে যে বাণিজ্যিক চুক্তি করতে চেয়েছিলেন, সেগুলোও ধোপে টেকেনি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে অপমান করেছেন, আর পুতিনকে খুশি রাখতে চেয়েছেন। এখন সেই ‘অত্যন্ত স্থিতিশীল প্রতিভা’ ট্রাম্প নিজেই বলছেন, পুতিন ‘আজেবাজে’ কথা বলেন এবং তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখা যায় না।
ট্রাম্প এখন বলছেন, তিনি আবারও কিয়েভকে সীমিত পরিমাণ প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র সরবরাহ করবেন এবং নতুন করে কিছু নিষেধাজ্ঞাও সমর্থন করতে পারেন। কিন্তু এটি কোনো নীতিগত অবস্থান নয়, বরং এটি তাঁর ব্যক্তিগত আবেগপ্রবণ আচরণের ফল। তাঁর অহংকারে আঘাত লেগেছে এবং তিনি অপমানিত বোধ করছেন বলেই তিনি কিয়েভকে সমর্থন দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু ক্রেমলিনের কোনো নেতা যদি তাঁর একটু প্রশংসা করে কথা বলেন, তাহলে তিনি আবার হঠাৎই রাশিয়ার পক্ষে চলে যেতে পারেন। ক্ষমতা উপভোগ করতে পছন্দ করা সব নেতার মতো ট্রাম্পও স্বভাবতই শক্তিশালী পক্ষের পক্ষে থাকেন।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পুতিন মনে করছেন, তিনি ইউক্রেনকে ধীরে ধীরে ক্লান্ত করে ফেলতে পারবেন, পশ্চিমা জোটকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্বল করে দেবেন এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ জিতবেন।
তবে এখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। ট্রাম্প ইউক্রেনের পাশে থাকুন বা না থাকুন, ন্যাটো চাইলে আরও কড়া অবস্থান নিতে পারে। তারা ইউক্রেনকে অবরুদ্ধ না করে ইউক্রেনীয় অঞ্চলের ওপর বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করতে পারে এবং রাশিয়ার ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ভূপাতিত করতে পারে। সামরিকভাবে এটি করা সম্ভব। আইনি ও মানবিক দিক থেকেও এর যথেষ্ট ভিত্তি আছে।
রাশিয়া বারবার ন্যাটোর প্রতিবেশী দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে। পুতিনের পারমাণবিক হুমকিগুলো (যেগুলোয় জো বাইডেন ভয় পেয়েছিলেন) আসলে হাস্যকর ছিল। ন্যাটোর যদি সাহস থাকত, তাহলে তারা পুতিনকে তার জায়গায় ফেরত পাঠাতে পারত।
পুতিনকে নিরস্ত্র করা যদি এখন সম্ভব না হয়, তাহলে অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত রাশিয়ার তেল রপ্তানির ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। পশ্চিমা ব্যাংকগুলোতে রাশিয়ার সরকারের যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পড়ে আছে, সেগুলো বাজেয়াপ্ত করে ইউক্রেনের জন্য অস্ত্র ও যুদ্ধ–পরবর্তী পুনর্গঠনের খরচ মেটানো উচিত। ভারতসহ যেসব দেশ এখনো রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি এবং যুদ্ধ থেকে মুনাফা করছে, তাদের উচিত ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধ নিয়ে সদ্য প্রকাশিত ভয়াবহ প্রতিবেদনটি পড়া এবং তারপর একটি পক্ষ বেছে নেওয়া।
এখন দুটি ফলাফলের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি: হয় দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চলতে থাকবে, নয়তো ইউক্রেন পতনের দিকে এগোবে। যদি ইউক্রেন পরাজিত হয় এবং পুতিন নিজের শর্তে একটি সমঝোতা চাপিয়ে দিতে সক্ষম হন, তাহলে সেটি কেবল ইউক্রেন নয়; বরং গোটা পশ্চিমা বিশ্বের জন্য একটি বিশাল কৌশলগত পরাজয় হবে। এর ফলে ইউরোপজুড়ে স্থায়ী, ক্রমবর্ধমান সংঘাতের যুগ শুরু হতে পারে।
তবে রাশিয়ার জন্যও এর কোনোটিই প্রকৃত বিজয় হবে না। এখন আরও জোরালোভাবে রাশিয়ার রাজনৈতিক ও সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে যে এই যুদ্ধ তাঁদের জন্য প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ এবং আলোচনার মাধ্যমে এই যুদ্ধ শেষ করা সম্ভব। যুদ্ধটি শেষ করা গেলে তাঁদের প্রকৃত নিরাপত্তার বিষয়গুলো সমাধান করা যেতে পারে। আর অন্য যেকোনো পথ তার চেয়েও ভয়াবহ হবে।
কিন্তু এর আগে একটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে, তা হলো: সবাইকে বোঝাতে হবে, রাশিয়ার এই বিপর্যয়ের মূল পরিকল্পনাকারী যিনি, সেই পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে আন্তর্জাতিক বিচারের মুখে দাঁড় করাতে হবে। বিশ্বকে এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে, ইউক্রেনের পতন নয়, অবিলম্বে পুতিনের পতন হওয়া উচিত।
সাইমন টিসডাল গার্ডিয়ানের বিদেশ নীতিবিষয়ক বিশ্লেষক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ