গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কথা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষকের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (জাকসু) নির্বাচনে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, সেখানকার অবস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও খারাপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত প্রতিরোধ মঞ্চ থেকে একজন জয়ী হয়েছেন, জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু জিততে না পারলেও প্রতিযোগিতায় ছিলেন। জাহাঙ্গীরনগরে এমন কেউ প্রতিযোগিতায় আসবে বলে মনে হয় না।
ঘণ্টাখানেক পরই খবর পেলাম, জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রদল ও বাম সমর্থকসহ পাঁচটি প্যানেল ভোট বর্জনের আওয়াজ দিয়ে লড়াই থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে যে তাঁরা ফলাফল ঘোষণার আগেই নিজেদের নৈতিক পরাজয় স্বীকার করে নিলেন, এই বোধও সম্ভবত নেতাদের নেই।
ভোট গ্রহণের পর আরেক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলি, যিনি চব্বিশের গণ–আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগরে অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর বক্তৃতা শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দেশবাসীকেও উদ্দীপ্ত করেছে। তিনি জাকসুর নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় নানা অনিয়ম–অব্যবস্থাপনার জন্য প্রশাসনকেই দুষলেন। যাঁরা এই নির্বাচনের দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁদের সেই দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা ও দক্ষতা আছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি স্টার মার্ক পেয়ে থাকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পাস নম্বরও পায়নি। বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় ভোট গ্রহণ শেষ হলেও গণনার কাজ এই সম্পাদকীয় লেখা পর্যন্ত শেষ হয়নি।
বেদনাদায়ক ঘটনা হলো জাহাঙ্গীরনগরে ভোট গণনাকালে শুক্রবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস মৌমিতা অসুস্থ হয়ে মারা যান। তিনি পোলিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন। এর আগে ডাকসু নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ভেতর অসুস্থ হয়ে মারা যান এস টিভির সাংবাদিক তরিকুল ইসলাম শিবলী।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন শুধু একটি সাধারণ নির্বাচনই নয়, এটি একটি “ফাউন্ডেশনাল ইলেকশন”, যার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে আগামীর বাংলাদেশের পথরেখা। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের অবশ্যই মৌলিক সংস্কারগুলো চূড়ান্ত করে ফেলতে হবে।’
অন্য ছাত্রসংগঠনগুলো যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে ডাকসু ও জাকসুতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেই প্যানেলকে বেছে নিয়েছে, তাকে সম্মান জানাতে হবে। তাদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। কী কারণে তারা পরাজিত হলো সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, বৈঠকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব এবং এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এটাও পুরোনো কথা। এরই মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদে রদবদলের গুঞ্জনও আছে। প্রধান উপদেষ্টা যদি মনে করেন, নির্বাচনের অবাধ ও সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে উপদেষ্টা পরিষদের যোগ–বিয়োগ করা দরকার, সেটা এখনই করতে হবে।
ডাকসু নির্বাচনের ফল অনেককেই চমকে দিয়েছে। এখানে জাতীয় রাজনীতির চেয়েও বেশি ভূমিকা রেখেছে প্রার্থীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও নমনীয়তা, সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিপদে আপদে যাঁকে কাছে পেয়েছেন তাঁকে ভোট দিয়েছেন। ডাকসুতে বড় বিজয় পেয়েছে ছাত্রশিবির। শিবিরের বিশাল জয়ের বিষয়ে এনসিপির এক নেতার মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘প্রথাগত ধর্মীয় রাজনীতির বাইরে এসে লিবারেল ধারায় মধ্যমপন্থী জায়গা থেকে প্রচার ও প্যানেল সাজিয়েছিল শিবির। ডানপন্থী বা ধর্মভিত্তিক বক্তব্য না টেনে মধ্যপন্থী জায়গা থেকে তারা প্রচার চালিয়েছে, এ বিষয়টিও তাদের জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।’
অন্য ছাত্রসংগঠনগুলো যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে ডাকসু ও জাকসুতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেই প্যানেলকে বেছে নিয়েছে, তাকে সম্মান জানাতে হবে। তাদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। কী কারণে তারা পরাজিত হলো সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। ইতিমধ্যে বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিবের আঁতাত আবিষ্কার করেছেন। তাঁদের এই আবিষ্কারের পেছনে তথ্যপ্রমাণ থাকলে সেটা দেশবাসীকে জানানো হোক। কিন্তু এটিও প্রশ্ন, তারা গত এক বছরে কী করেছে?
নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ। আমাদের রাজনীতিকেরা গত ৫৪ বছরে এই ধাপটিই পার হতে পারেননি। তাঁরা ক্ষমতায় গিয়ে এমন কাজ করে দেখাতে পারেননি, যাতে মানুষ মনে করে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব। রাজনীতিকেরাই আন্দোলন সংগ্রাম করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করলেন। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে ২০০৭ সালের নির্বাচনটিই করতে পারল না। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে গিয়ে তাদের আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবাধায়ক ব্যবস্থাটিই বাতিল করে দিল। তার পরিণামও তারা ভোগ করছে।
এখন আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। বিএনপি মাঠে আছে। মাঠে আছে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও অন্যান্য দলও। কিন্তু এসব দল গত কয়েক মাস ধারাবাহিক আলোচনা করেও নির্বাচন তথা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামোর বিষয়ে মতৈক্যে আসতে পারেনি। এই ব্যর্থতার দায় ‘পতিত স্বৈরাচারের’ ওপর চাপিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করা যাবে, গণতন্ত্র এক পাও এগোবে না।
আমাদের বিজ্ঞ রাজনীতিকেরা, ছাত্রনেতারা কেউ অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেন না। তাঁদের অনেকে বিতাড়িত আওয়ামী লীগকে নিয়ে প্রতিদিনই কথা বলেন। তাদের ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু নিজেরা কীভাবে একটি নির্বাচন করবেন, সে বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে পারছেন না।
ছাত্রদল, বাম ছাত্রসংগঠন ও বাগছাসের নেতারা জাতীয় রাজনীতি নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। এখনো বলছেন। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে তাঁরা খুব কম কথাই বলেছেন। নানা সূত্রে জানতে পেরেছি, এই কাজটি ছাত্রশিবিরের নেতা–কর্মীরা করেছেন। ছাত্রদল তো সুষ্ঠু পরিবেশ নেই বলে নির্বাচনই ঠেকিয়ে দিতে চেয়েছিল। পরে সব ছাত্রসংগঠনের দাবির মুখে তারা ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে রাজি হয়। অন্যদিকে বাম ও চব্বিশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতৃত্ব বহু ভাগে ভাগ হয়ে গেল, যার সুফলটা এককভাবে শিবির–সমর্থিত প্যানেল পেয়েছে।
ছাত্রদলের নেতারা মনে করতেন, জাতীয় নির্বাচন হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। একসময় বামপন্থী রাজনীতিকেরাও এই কাজটি করতেন। তাঁরা বলতেন, আগে সমাজ বদলাও। এরপর মানুষের ভাগ্যও বদলে যাবে। কিন্তু তাঁরা এ কথা কখনো ভাবেননি যে মানুষ না বদলালে সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা কিছুই বদলায় না।
চব্বিশে গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যেই ছাত্রনেতৃত্ব একটি দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সরকারকে হটিয়ে দিতে পেরেছে, তারা কেন সুন্দরভাবে একটি ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে পারবে না। ডাকসু নির্বাচনটি মোটামুটি উতরে গেলেও জাকসুতে এসে প্রলয়কাণ্ড ঘটল, যার দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এড়াতে পারবে না। দুর্ভাগ্য, চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর যাঁরা নতুন বন্দোবস্তের কথা বলেছেন, তাঁরাও পুরোনো পথে হাঁটছেন।
মাঠে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারে, যদি ছাত্রনেতৃত্ব সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয় কিংবা নির্বাচন হওয়ার পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের রায় না মেনে নেয়, তাহলে সামনে আরও অনেক বিপদ অপেক্ষা করে আছে।
সোহরাব হাসান সাংবাদিক ও কবি
সূত্র, প্রথম আলো