ট্রাম্পের শুল্কনীতি ভারতের অর্থনীতি ও কৌশলগত ভবিষ্যতের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের বিভিন্ন পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, রাশিয়া থেকে ভারত তেল কিনছে বলেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ট্রাম্পের এ ঘোষণা বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থার জন্য আরেকটি বড় ধাক্কা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের ভালো সম্পর্ক থেকেও সরে আসার ইঙ্গিত। ভারতের অর্থনীতি এত দিন বিশ্ববাজারের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত থেকে যে সুবিধা ভোগ করে এসেছে, নতুন শুল্কের কারণে তা কিছুটা চাপের মুখে পড়তে পারে। এর চেয়েও বড় ঝুঁকি হলো, ভারতের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনায় এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে।

তবে ভারতের জন্য আশার কথা, এমন কিছু কারণ আছে, যা এই নতুন শুল্কের তাৎক্ষণিক প্রভাব কমিয়ে আনবে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হলেও ভৌগোলিকভাবে দেশটি অনেক দূরে অবস্থিত। উচ্চ পরিবহন খরচের কারণে ভারত অনেক আগে থেকেই বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৈচিত্র্যময় করার কৌশল নিয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারও কখনো একই রকম থাকে না। ট্রাম্পের এই বৈশ্বিক শুল্কযুদ্ধ নতুন করে বাণিজ্যের ধারা পরিবর্তন করবে এবং সরবরাহব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ঘটাবে। ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা অন্যান্য দেশের ব্যবসায়ীদের মতোই বিকল্প বাজার খুঁজে নেবেন; যদিও এই পরিবর্তনের খরচ বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ট্রাম্প যে শুল্ক বসিয়েছেন, তা ভারতের মোট রপ্তানির একটি ছোট অংশকে প্রভাবিত করবে। গত অর্থবছরে ভারত প্রায় ৪৪১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিদেশে বিক্রি করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৬৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য নতুন শুল্কের আওতায় পড়ছে। অর্থাৎ মোট রপ্তানির ১৫ শতাংশের কম প্রভাবিত হবে। তাই এই শুল্ক ভারতের জন্য অবশ্যই একধরনের সমস্যা তৈরি করবে, কিন্তু সেটা এত বড় আঘাত নয় যে ভারতের পুরো রপ্তানি ব্যবসা বা অর্থনীতি ভেঙে পড়বে।

শুধু পণ্যের দিকে তাকালে ভারতের বাণিজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী খাতটি আড়ালে থেকে যায়। সেটি হলো সেবা খাত। বর্তমানে ভারতের সেবা রপ্তানি বছরে ৩৮০ বিলিয়ন ডলারের বেশি এবং তা দ্রুত বাড়ছে। এ খাতই ভারতের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির আসল চালিকা শক্তি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সেবা রপ্তানির মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা, আর্থিক সেবা, ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ার আউটসোর্সিং, গবেষণা ও উন্নয়ন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত, যেগুলোর ওপর কোনো শুল্ক আরোপ করা হয় না।

ট্রাম্পের শুল্কনীতি থেকে সৃষ্ট নীতিগত অনিশ্চয়তা ভারতকে একটি অপ্রত্যাশিত সুবিধাও দিতে পারে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরিয়ে অন্য দেশে বৈচিত্র্য আনতে চাইবে। এই পরিবর্তন থেকে ভারত বড় লাভবান হতে পারে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, ভারতের পণ্য ও সেবা রপ্তানিকারকেরা ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র বাদে অন্যান্য ওইসিডি দেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে।

ট্রাম্পের শুল্কনীতি থেকে সৃষ্ট নীতিগত অনিশ্চয়তা ভারতকে একটি অপ্রত্যাশিত সুবিধাও দিতে পারে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরিয়ে অন্য দেশে বৈচিত্র্য আনতে চাইবে। এই পরিবর্তন থেকে ভারত বড় লাভবান হতে পারে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, ভারতের পণ্য ও সেবা রপ্তানিকারকেরা ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র বাদে অন্যান্য ওইসিডি দেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে।

তবে এ ঘটনার প্রভাব কেবল বাণিজ্য অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়; এটি ভারতের আন্তর্জাতিক অবস্থান সম্পর্কেও একটি বড় প্রশ্ন তোলে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি হলো ভারতকে একটি আত্মবিশ্বাসী এবং উন্মুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা, যা পশ্চিমাদের প্রযুক্তি, অর্থ ও বাজারের সহায়তা নিয়ে বিশ্বায়নের মাধ্যমে উন্নতি অর্জন করতে চায়। ভারতের পূর্ণ সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করতে হলে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে আরও গভীর সংযোগ স্থাপন জরুরি।

এ ভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গি বলছে, ভারতের উন্নতি অনেকটাই পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফল। ১৯৯১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ভারতের অর্থনৈতিক সাফল্যের বড় কারণ ছিল পশ্চিমা দেশগুলোর প্রযুক্তি, ব্যবসায়িক সংযোগ ও বিনিয়োগ। এ সময় পশ্চিমা দেশগুলোয় ভারতীয় প্রবাসীদের সংখ্যা বেড়েছে, আর তাদের প্রভাবও অনেক বেশি হয়েছে। ভারতও পশ্চিমাদের প্রযুক্তি আর ব্যবসায়িক নেটওয়ার্কের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। যদিও মাঝেমধ্যে রাশিয়া বা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর কথা বলা হয়, বাস্তবে ভারতের ধনী বা প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানদের ওই দেশগুলোয় পড়াশোনা করতে পাঠানোর ঘটনা প্রায় নেই।

দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক সংযোগকে সুযোগ নয়, বরং দুর্বলতা হিসেবে দেখে। এই মনোভাব এসেছে ঔপনিবেশিক আমল থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পশ্চিমাদের প্রতি অবিশ্বাস থেকে। এতে আত্মনির্ভরশীলতার ওপর এত বেশি জোর দেওয়া হয় যে তা প্রায়ই অর্থনৈতিক দক্ষতা ও প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে।

ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি ভারতের মধ্যে যে রক্ষণশীল বা সুরক্ষাবাদী ভাবনা আগে থেকেই ছিল, সেটাকে আরও শক্তিশালী করেছে। এখন অনেকেই মনে করতে শুরু করেছে যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্বাসযোগ্য নয়, আর পশ্চিমাদের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ হলে সেটা ভারতের নিরাপত্তা ও স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

যদি ভারতের নেতারা এই ভাবনাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন, তাহলে দেশটি হয়তো সুরক্ষাবাদী নীতি নেবে (মানে নিজেদের বাজার অন্যদের জন্য বন্ধ করে দেবে) এবং সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের দিকে যাবে। এতে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি উন্নতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এশিয়ার নিরাপত্তা কমে যাবে, আর বিশ্বে যে সামান্য উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আছে, সেটাও দুর্বল হয়ে পড়বে।

তবে ভালো খবর হলো, উন্মুক্ত অর্থনীতির পক্ষে থাকা দৃষ্টিভঙ্গি এখনো প্রাধান্য পাচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ভারতের যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হয়েছে, তা শুল্ক কমানো এবং সুরক্ষাবাদী নীতি হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই চুক্তি দেখায়, ভারত এখনো পারস্পরিক সম্মান ও স্বার্থের ভিত্তিতে ওইসিডি দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করতে আগ্রহী। আশা করা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য চুক্তির আলোচনাও একই ধারা অনুসরণ করবে এবং ভারতের বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্তি আরও দৃঢ় হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতিকে ভারত নিজের জন্য সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এ ঘটনা ভারতকে স্পষ্টভাবে ভাবতে সাহায্য করবে যে তার ভবিষ্যৎ কৌশল কী হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষাবাদী নীতির জবাবে ভারতের উচিত নয় প্রতিশোধ নেওয়া বা অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলা। বরং ভারতের উচিত সেই সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করা, যারা এখনো সৎ নিয়ম মেনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশ্বাস করে। যদি ভারত যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করে, তাহলে দেশটি তার অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো নতুনভাবে সাজাতে পারবে। এতে ভারত প্রমাণ করতে পারবে যে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা শুধু তার উন্নতির জন্য নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থের জন্যও জরুরি।

অজয় শাহ মুম্বাইভিত্তিক অলাভজনক গবেষণা সংস্থা এক্সকেডিআর ফোরামের সহপ্রতিষ্ঠাতা

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সূত্র, প্রথম আলো