রাশিয়ার সেনারা এখন ইউক্রেনে বড় কোনো জয় পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। ক্লান্তিকর যুদ্ধে শত শত সেনা মারা যাচ্ছে। অথচ অগ্রগতি হচ্ছে হয় বড় জোর কয়েকশ মিটার, নয়তো একেবারেই কিছু না।
কিন্তু কূটনীতির ক্ষেত্রে ছবিটা আলাদা। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলাস্কায় শীর্ষ বৈঠক করে বড় ধরনের কূটনৈতিক জয় পেয়েছেন।
জয়েন্ট বেস এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসনে আয়োজিত বৈঠকে পরিবেশ ছিল একেবারেই বন্ধুত্বপূর্ণ। লাল গালিচায় পুতিন হেঁটে আসার সময় ট্রাম্প হাততালি দেন। পরে হাত মেলান এবং তাঁকে প্রেসিডেন্টিয়াল গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যান। পুতিন তখন লুইস ক্যারলের উপন্যাস এলিস’ অ্যাভেঞ্চারস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড–এর চেশায়ার বিড়ালের মতো খুশিতে হাসছিলেন।
প্রায় তিন ঘণ্টার বৈঠকের পর দুজন প্রকাশ্যে তেমন কিছু জানাননি। তাঁরা শুধু বলেছেন, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা একমত হয়েছেন। পুতিন ট্রাম্পকে মস্কো সফরের আমন্ত্রণ জানান, যদিও ট্রাম্প আপাতত সে আমন্ত্রণ এড়িয়ে যান।
বৈঠক শেষে পুতিন সাংবাদিকদের বললেন, আলোচনার নিয়ন্ত্রণ আসলে তাঁর হাতেই ছিল। তিনি রাশিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে নিজের উদ্বেগের কথা তুলেছেন। আর ট্রাম্পকে প্রশংসা করেছেন এই বলে যে, ট্রাম্প নাকি যুদ্ধ-সংঘাতের ইতিহাস বুঝতে চেষ্টা করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার দারচিভ জানান, ইউক্রেন ছাড়াও দুটো বড় দ্বিপাক্ষিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ১. বাইডেন প্রশাসনের সময় বাজেয়াপ্ত হওয়া ছয়টি রুশ কূটনৈতিক সম্পত্তি ফেরত দেওয়া। ২. যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার সরাসরি বিমান যোগাযোগ পুনরায় চালু করা।
বৈঠকের আগে ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু আলোচনার পর তিনি ইউক্রেন ও ইউরোপীয় মিত্রদের সামনে রাশিয়ার দাবিই এগিয়ে ধরেন। তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতির বদলে একটি ‘সংঘাত মীমাংসা চুক্তি’ করতে হবে। পরে ট্রাম্প তাঁর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখলেন, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও নাকি ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার সেরা উপায় সরাসরি একটি শান্তি চুক্তি’ করার বিষয়ে একমত হয়েছেন।
তবে ইতিবাচক দিক হলো, ট্রাম্প অন্তত রাশিয়ার ভূখণ্ড দখলের দাবি মেনে নেননি। অর্থাৎ, বৈঠকটা ‘নতুন মিউনিখ’ হয়নি। ১৯৩৮ সালে মিউনিখে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের নেতারা হিটলারকে খুশি করতে চেকোস্লোভাকিয়ার একাংশ দখল করতে দিয়েছিলেন। ট্রাম্প অন্তত সে পথে হাঁটেননি।
পুতিন এই বৈঠকের মাধ্যমে দেখাতে পেরেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তাঁকে আবারও বিশ্বমঞ্চে বৈধতা দিচ্ছেন। ২০২২ সালে ইউক্রেনে হামলা আর যুদ্ধাপরাধের কারণে রাশিয়া একঘরে হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আলাস্কায় পুতিনকে একজন ‘মহাশক্তির নেতা’ হিসেবেই উপস্থাপন করা হলো যার সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে তাঁরই বেঁধে দেওয়া শর্তে।
পুতিনের কাছে ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু দনবাস বা সোভিয়েত পতনের অবিচারের প্রতিশোধ নয়। তাঁর লক্ষ্য হলো বিশ্বকে নতুনভাবে গড়ে তোলা। আর ট্রাম্পের কাছে এই যুদ্ধ কেবল এমন এক ঝামেলা, যা তাঁর নিজের পরিকল্পনার পথে বাধা।
ট্রাম্প পুতিনকে সত্যিই খুব পছন্দ করেন—তাঁর ব্যক্তিত্ব আর শাসনপদ্ধতি দুটোই তাঁর কাছে আকর্ষণীয়। তাই ইউক্রেনের ব্যাপারে নিজের অবস্থান পাল্টাতে তিনি মোটেও আগ্রহী নন। কিন্তু ইউক্রেনের জন্য বিষয়টা খুব কঠিন, কারণ তার টিকে থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অত্যন্ত জরুরি। ইউরোপ বাড়তি অর্থ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তাদের সামরিক শক্তি আর অস্ত্রশিল্প এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ নয়।
ট্রাম্প শুধু মুখে শান্তির কথা বলেন, কিন্তু আসল ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবেন না। কিন্তু ইউক্রেনের জন্য সেই আসল ব্যাপারগুলোই জীবন-মরণ প্রশ্ন। আর ইউরোপের জন্য এর মানে হলো—ইউক্রেন হারলে তারাও পুতিনের পরবর্তী শিকার হতে পারে।
তবে ট্রাম্পকে প্রভাবিত করার পথ আছে। ইউক্রেন আর ইউরোপ চাইলে পুতিনের মতো কৌশল নিতে পারে। ট্রাম্প নিজের প্রশংসা শুনতে ভীষণ ভালোবাসেন—যেমনটা পুতিন বারবার করেছেন বৈঠকের পর। এমনকি ট্রাম্পের সেই দাবিও তিনি মেনে নিয়েছেন যে, যদি ২০২২ সালে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকতেন, তবে ইউক্রেন যুদ্ধ হতো না।
তাই দরকার হলো কূটনৈতিক আলাপ চালিয়ে যাওয়া এবং ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধকে যেভাবে দেখেন, সেটা পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করা।
ট্রাম্প ইউক্রেনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন যে বিষয়গুলোতে সেগুলো হলো—মার্কিন জ্বালানি রপ্তানি, চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রাধান্যের চ্যালেঞ্জ এবং আর্কটিক অঞ্চলকে ঘিরে সম্ভাব্য শোষণ। তাই আশ্চর্যের কিছু নেই যে বৈঠকের জায়গা হিসেবে তিনি আলাস্কা বেছে নিয়েছেন। আবার গ্রিনল্যান্ড নিয়ে তাঁর আসক্তিও এই প্রেক্ষাপটে অনেকটা পরিষ্কার।
এখন ট্রাম্পকে বোঝাতে হবে—রাশিয়া এসব ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য হুমকি। ট্রাম্পকে বোঝাতে হবে—নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলে রাশিয়ার এলএনজি বাজার ভরিয়ে দিতে পারে, যা মার্কিন রপ্তানির দাম নামিয়ে আনবে; রাশিয়া এখন চীনে খনিজ রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল, এতে চীন সস্তায় কাঁচামাল পেয়ে আরও প্রতিযোগিতায় সক্ষম হচ্ছে; পুতিন বারবার চীনকে উৎসাহ দিচ্ছেন ডলার বাদ দিয়ে নতুন বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কাঠামো গড়তে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বাদ পড়বে।
পুতিনের কাছে ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু দনবাস বা সোভিয়েত পতনের অবিচারের প্রতিশোধ নয়। তাঁর লক্ষ্য হলো বিশ্বকে নতুনভাবে গড়ে তোলা। আর ট্রাম্পের কাছে এই যুদ্ধ কেবল এমন এক ঝামেলা, যা তাঁর নিজের পরিকল্পনার পথে বাধা।
তাই ট্রাম্প কীভাবে এই যুদ্ধকে দেখছেন তা কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলোর বোঝা দরকার। তাদের দেখাতে হবে, পুতিন আসলে কীভাবে মার্কিন স্বার্থকে ক্ষতি করছে।
যদি তা না পারে, তবে আলাস্কার বৈঠক ‘নতুন মিউনিখ’ না হলেও এর উত্তরাধিকার হয়ে যেতে পারে একটি ‘নতুন ইয়াল্টা’। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইয়াল্টা সম্মেলনের মতো একটি পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যেখানে বড় শক্তিধর দেশগুলো বিশ্বের রাজনৈতিক ভাগাভাগি ঠিক করবে। ছোট দেশগুলোর ভাগ্য তাদের ইচ্ছার বাইরে বড় শক্তিধর দেশগুলো নির্ধারণ করবে।
ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর ফেলো এবং লন্ডনভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আল জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুদিতৎ