ভারতের ওপর প্রথমে ২৫ শতাংশ, পরে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ মার্কিন বাণিজ্য শুল্ক আরোপের ঘটনায় ভারতের রাজনীতিতে মৃদু ভূকম্পন শুরু হয়েছে।
এখন আলাপ-আলোচনা চলছে, সত্যি সত্যি যদি এই হারে ভারতের রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে অর্থনীতিতে বড় রকমের চাপ পড়বে। সবচেয়ে বড় চাপ আসবে কৃষি খাতে। রাজনীতিতেও তার প্রভাব অনিবার্য। এমনকি মোদির গদি নিয়েও টান পড়তে পারে।
যে প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি, তা হলো ট্রাম্প-মোদির বন্ধুত্ব বা ‘ব্রোমান্স’ সত্ত্বেও হঠাৎ কী এমন ঘটল যে ট্রাম্প তাঁর প্রিয় বন্ধুকে এই বিপদ ফেলে দিলেন?
দুটি কারণ সামনে এসেছে। ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ওপর ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চাপ বাড়াতে চান। রাশিয়ার তেল কিনে ভারত এ যুদ্ধ জিইয়ে রেখেছে। অতএব ভারতকে সে পথ থেকে সরে আসতে তার ওপরই চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
সমস্যা হলো ভারতের চেয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে অনেক বেশি তেল কেনে চীন। কই, তার ওপর তো কোনো নিষেধাজ্ঞা বা বাণিজ্য শুল্ক আরোপ করা হয়নি। এই সেদিন ট্রাম্প বাণিজ্যচুক্তি সম্পন্ন করতে চীনকে আরও ৯০ দিনের রেয়াত দিয়েছেন।
অন্যদিকে যুদ্ধ না থামালে রাশিয়ার ওপর অতিরিক্ত শুল্কের কথা ট্রাম্প বলেছেন বটে, কিন্তু আরোপ করেননি। উল্টো কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই তাঁকে নিজ দেশে ডেকে আনছেন আলোচনায় বসতে।
দ্বিতীয় সম্ভাব্য কারণ, ঝিকে মেরে বউকে শায়েস্তা করার মতো ট্রাম্প ভারতকে শাস্তি দিয়ে ‘ব্রিকস’-কে থামাতে চান। ব্রিকস, মানে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গঠিত বিকল্প অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট, যার একটা বড় লক্ষ্য বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ছড়ি ঘোরানোয় বাধা দেওয়া।
এই জোট বিশ্বজুড়ে ডলারের চলতি আধিপত্য রোধে বিকল্প ‘কারেন্সি’ও চালু করতে চায়। সে কথা উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেছেন, এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যেতে পারে না। কিন্তু তাঁর এ যুক্তির শুভংকরের ফাঁকিটা হলো ভারত নয়, রাশিয়া ও চীন এই দুই দেশ ব্রিকসের প্রধান দুই খুঁটি। ট্রাম্প তাদের ওপর চাপ না প্রয়োগ করে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর চাপ প্রয়োগ করছেন। তাতে লাভ কী?
অতএব ট্রাম্প-মোদির ব্রোমান্সের আপাত অবসানের পেছনে কারণ হিসেবে অন্য কিছু খুঁজতে হবে। সে রকম একটা কারণ হলো পাক-ভারত যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের ভূমিকা। ট্রাম্প ও তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বারবার দাবি করেছেন, ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় এই দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ যুদ্ধ বন্ধ সম্ভব হয়েছে। ট্রাম্প নিজে তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে বড় বড় অক্ষরে লিখেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে রাতভর আলাপ-আলোচনার পর তাঁরা উভয়েই ‘পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক’ যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয়েছেন। রুবিও এক কদম এগিয়ে নিজ থেকে দাবি করেছেন, শুধু ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় এ যুদ্ধবিরতি অর্জন সম্ভব হয়েছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও সে দেশের সেনাপ্রধান আসিম মুনির বেশ জোরেশোরেই বলেছেন, ‘ঠিক! ঠিক!’ শুধু তা-ই নয়, ১৮ জুন হোয়াইট হাউসে এক মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেওয়ার সময় আসিম মুনির এ যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের ঐতিহাসিক ভূমিকার জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম সুপারিশ করে একটি চিঠির কপি ট্রাম্পের হাতে হস্তান্তর করেন।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি, সেটিও তাঁর টুপিতে আরেক পালক হতে পারত। অথচ তাঁরই বন্ধু মোদি তাঁর এ ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইন্ড’ প্রকল্পে এভাবে পানি ঢেলে দেবেন, তা হয়তো ঘুণাক্ষরেও তিনি ভাবেননি। শুল্ক তো খুবই সামান্য, ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি যে আরও ভয়াবহ কিছু করে বসেননি, তাতেই রক্ষে!
সমস্যা হলো ভারত বলছে উল্টো কথা। তারা বলছে, যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রশ্নই ওঠে না। পাকিস্তানের জোরাজুরিতে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর নিয়মিত চ্যানেলের মাধ্যমে সংঘর্ষ বন্ধে উভয় দেশ সম্মত হয়েছে। এ প্রশ্নে ভারতীয় পার্লামেন্টে তর্কবিতর্ক হয়েছে, বিরোধী কংগ্রেস পার্টি সরকারের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চেয়েছে। মোদি সাফ বলেছেন, না, এতে ট্রাম্পের কোনো ভূমিকাই ছিল না।
এ ঘটনার দুই সপ্তাহের মাথায় ট্রাম্প ভারতের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের কথা ঘোষণা করেন। কেন, তার উত্তর সম্ভবত এই শেষ কারণেই খুঁজে পাওয়া যাবে। এটা কোনো গোপন ব্যাপার নয় যে ট্রাম্প যেভাবেই হোক শান্তিতে নোবেল পুরস্কারটি চান। কিছু না করেই প্রেসিডেন্ট ওবামা এ পুরস্কার পেয়েছেন, আর তিনি পাবেন না!
দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হয়ে ট্রাম্প নিজেকে শান্তির দূত প্রমাণে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। এক দিনেই গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধ থামিয়ে দেবেন—এমন ঘোষণা করেছিলেন। সে ঘোষণা ঢাকের আওয়াজের মতো বারবার পেটানো হলেও বাস্তবে অবস্থা বদলায়নি। তবে এই দুই ক্ষেত্র ছাড়া তাঁর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ একাধিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যেমন আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী লড়াই থামাতে একটি শান্তিচুক্তির ব্যবস্থা করেছেন তিনি। রুয়ান্ডা ও কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ বন্ধেও তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগ কাজে লেগেছে।
অতি সম্প্রতি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে হঠাৎ যে যুদ্ধ বেঁধে গেল, তা থামাতেও ট্রাম্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ না করলে দুই দেশের ওপরই তিনি অতিরিক্ত বাণিজ্য শুল্ক আরোপ করবেন—এমন হুমকি দিয়েছিলেন। শোনা যাচ্ছে, তাতেই কাজ দিয়েছে।
নোবেল পুরস্কারের পথে এসবই ট্রাম্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি, সেটিও তাঁর টুপিতে আরেক পালক হতে পারত। অথচ তাঁরই বন্ধু মোদি তাঁর এ ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইন্ড’ প্রকল্পে এভাবে পানি ঢেলে দেবেন, তা হয়তো ঘুণাক্ষরেও তিনি ভাবেননি। শুল্ক তো খুবই সামান্য, ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি যে আরও ভয়াবহ কিছু করে বসেননি, তাতেই রক্ষে!
এ কথায় কোনো ভুল নেই—ভারতের ওপর এ অস্বাভাবিক শুল্ক প্রধানমন্ত্রী মোদির জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। শুল্ক ছাড়াও মার্কিন কৃষিজাত পণ্যের জন্য ভারতীয় বাজার উন্মুক্ত করার দাবি তুলেছেন ট্রাম্প। সে দাবির জবাবে মোদি সরাসরি না বলে দিয়েছেন। তিনি এমন কথাও বলেছেন, এ জন্য তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে। তাঁর এ শেষ কথা উদ্ধৃত করে কেউ কেউ এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, আগামী বছরের রাজ্য পর্যায়ের নির্বাচনে তিনি হয়তো বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন। এমনকি তাঁর গদি নিয়েও টান পড়তে পারে। এ কথায় সেই ইঙ্গিতই রয়েছে।
তবে আমার তা মনে হয় না। ‘মূল্য দিতে হবে’ বলতে মোদি আসলে কী বলেছেন, তা তাঁর কথায় নজর দিলেই পরিষ্কার হবে। মোদি তাঁর হিন্দি ভাষণে বলেন, ‘দেশ কি লিয়ে কিসি ভি কিমাত কো চুকানে কো তৈয়ার হু’। অর্থাৎ ‘দেশের স্বার্থে যেকোনো চরম মূল্য দিতে আমি প্রস্তুত।’ অন্য কথায়, ‘যে যা-ই বলুক, আমার জন্য দেশের স্বার্থ সবার আগে, আমি সে প্রশ্নে মাথা নোয়াব না।’ বস্তুত, তাঁর এ মারকুটে বক্তব্য মোদিকে সম্ভবত দেশের ভোটারদের কাছে আরও জনপ্রিয় করবে। কংগ্রেসের জনপ্রিয় সংসদ সদস্য শশী থারুর তো বলতে গেলে মোদিকে তাঁর এ শক্ত অবস্থানের জন্য বাহবাই দিয়েছেন।
দুজনের ‘ব্যালান্স শিট’ মিলিয়ে বলতে পারি, বাণিজ্য শুল্কের এ খেলায় মোদি নন, ট্রাম্পই ঠকবেন বেশি। আগেই বলেছি, ব্রিকসকে ভয় দেখাতে ট্রাম্প ভারত ও ব্রাজিলের ওপর অতিরিক্ত শুল্কের কুঠারটি ছুড়ে মেরেছেন। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ঘটছে ঠিক উল্টো। ভারতের মতো ব্রাজিলও বলেছে, ট্রাম্পের হুমকিতে তারা ভীত নয়। মাথা নিচু করে মেনে নেওয়ার বদলে তারা সমান হারে পাল্টা শুল্ক বসাবে।
আরও মজার ব্যাপার হলো এ বাণিজ্যযুদ্ধের ডামাডোলের ভেতরেই ব্রিকসের তিন প্রধান কুশীলব—চীন, রাশিয়া ও ভারত একে অপরের আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার পথে কয়েক কদম এগিয়ে গেছে। ট্রাম্প যেদিন ভারতের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত শুল্কের হুমকি দিলেন, সেদিনই দিল্লি জানাল প্রধানমন্ত্রী মোদি চীন সফরে যাচ্ছেন। আরও জানা গেল, শুধু মোদি নন, মস্কো থেকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও আসছেন সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের এক বৈঠকে অংশ নিতে। ৩১ আগস্ট তিয়ানজিনে তাঁরা চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে এক শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেবেন।
এ বৈঠকের ফলাফল কী হবে জানি না, তবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে তাঁরা নতুন ঘুঁটি চালা নিয়ে আলোচনা করবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুল্কযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা তো হবেই, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বাণিজ্যিক নির্ভরশীলতা কীভাবে কমানো যায়, সে বিষয়েও আলোচনা হবে। নিরাপত্তার প্রশ্নটিও বাদ যাবে না। বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে বাজি খেলায় দিনের শেষ হাসিটা ট্রাম্প নয়, মোদিরই হবে।
হাসান ফেরদৌস সাংবাদিক ও লেখক
(মতামত লেখকের নিজস্ব)