জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম একটি স্লোগান ছিল—দেশটা কারও বাপের নয়। কিন্তু এত বড় একটা রক্তাক্ত গণ–অভ্যুত্থানের পরও যে দেশটাকে অনেকে এখনো নিজের ‘বাপের’ মনে করেন, সেটিই আমরা দেখতে পাচ্ছি। ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা নিজের কর্মস্থলে যেতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অতিব্যস্ত সড়ক আটকে রাখেন সকাল থেকে প্রায় দুপুর পর্যন্ত। রাতে ফিরতেও একই পরিস্থিতি দেখা যায়। তাঁর জন্য ফাঁকা রাখতে হয় আস্ত একটা উড়ালসড়ক! প্রথম আলোর সরেজমিন প্রতিবেদন বলছে, এ কর্মকর্তা হলেন গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার মো. নাজমুল করিম খান। তিনি যেভাবে প্রটোকল ‘উপভোগ’ করেন, সেটি অনেকাংশে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে দেখা যেতো। যে-ই ক্ষমতায় আসুক, এ দেশটাকে নিজের ‘জমিদারি’ মনে করার প্রবণতা আমরা শাসকগোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে দেখে আসছি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সেটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। শেখ হাসিনাকে ঘিরে যে পরিবারতান্ত্রিক জমিদারি গড়ে উঠেছিল, তারই অনুকরণে একই মডেলে জেলা-উপজেলায় আবার গড়ে উঠেছিল একেকটি ‘তালুক’। সংসদ সদস্য, তাঁর স্ত্রী-সন্তান-ভাই–শ্যালকেরাই আসলে গোটা এলাকার সরকারি ক্ষমতাচর্চা ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এসব জমিদারি ও তালুকের দাপটে নিষ্পেষিত হওয়া মানুষ তখন এমন স্লোগান দিতে শুরু করে। জনগণের টাকায় সবকিছু করে, এমনকি নিজের বেতন ও সুযোগ–সুবিধাগুলোও জনগণের টাকায় ভোগ করে যখন বলা হয় ‘আমি বা আমরাই সব করেছি’, তখন তো ‘দেশটা কারও বাপের নয়’—স্লোগানই ওঠবে। তবে ‘রাজনৈতিক জমিদারি’র বাইরে আরেক জমিদারির চল সেই ব্রিটিশ আমলে থেকে চলে আসছে, সেটার কথা কতটা উচ্চারিত হয়? প্রশাসনিক বা আমলাতান্ত্রিক জমিদারি এখনো কতটা গভীরে প্রোথিত আছে, সেটিই যেন আমাদের আরও স্পষ্ট করে দিলেন জিএমপির ‘খান সাহেব’। গাজীপুরের এই খান সাহেব থাকেন ঢাকার অন্যতম অভিজাত এলাকা গুলশানে। প্রতিদিন সেখান থেকে যান কর্মস্থলে মানে গাজীপুরে। সেখান থেকে ফেরেনও একইভাবে। যাওয়ার সময় টঙ্গীর কলেজ গেট এলাকায় উড়ালসড়ককে একমুখী করে দেওয়া হয়। এ সময় গাজীপুর থেকে ঢাকামুখী লেন বন্ধ হয়ে যায়। কমিশনারের ফেরার সময় একইভাবে একমুখী করে দেওয়া হয় গাজীপুরের ভোগড়া এলাকার উড়ালসড়ক। তখন গাজীপুরমুখী চলাচল বন্ধ থাকে। এ সময় ঢাকামুখী লেনে গাড়ির লম্বা লাইন তৈরি হয়। খান সাহেবের এমন ‘নবাবি’ চলাফেরায় প্রতিদিন সকালে ভয়াবহ ভোগান্তির মুখে পড়েন ময়মনসিংহ ও গাজীরপুরের অনেক চাকরিজীবী। ফেরার সময়ও একই চরম দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয় তাদের। কী সুন্দর চাকরি! সাধারণ মানুষকে কীভাবে সড়কে ও গণপরিবহনে যাতায়াত করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নাকানিচুবানি খেতে হয়, তা উপলব্ধিই করতে হয় না এসব কর্তাদের। ফলে এ দেশের সড়কগুলো এমন ‘নরকসম’ হবে না তো কোন দেশের হবে? স্থানীয় গাড়িচালকদের মতে, শুক্র ও শনিবার ছাড়া প্রায় প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকাগামী উড়ালসড়কে কোনো গাড়ি উঠতে দেওয়া হয় না। ফলে উড়ালসড়কের নিচে পাশের লেনে যানজটের সৃষ্টি হয়। খান সাহেবের এমন নবাবি কর্মকাণ্ডের বিষয়টি উঠে এসেছে পুলিশের এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনেও। সেখানেও উঠে এসেছে সড়ক আটকে খান সাহেবের অফিসে আসা–যাওয়ার কারণে মানুষের চরম ভোগান্তি ও দুর্ভোগের কথা। ছাত্র-জনতা, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের রক্তের ওপর দিয়ে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে। সেই মানুষগুলোর ভাগ্য বদলের যে দাবি উঠেছিল, রাষ্ট্র সংস্কারের নামে সেখানে ‘লাভের গুড়’ খেতে যেন সবার আগে আবির্ভূত হয়ে গেলেন ‘পিঁপড়া’রূপে সরকারি হর্তাকর্তারাই। এ ব্যাপারে খান সাহেব আবার উদাহরণ দেন সচিব ও উপদেষ্টাদের প্রটেকশনের। তাঁদের প্রটেকশনের কারণে যদি ‘ডিস্টার্ব’ না হয়, তাহলে তাঁর বেলায় কেন? খান সাহেব যে তাঁদের উদাহরণ দিলেন, তাঁর কাছে প্রশ্ন রাখলাম, উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁর বিষয়টি কি তুলনাযোগ্য? উভয়ের প্রটোকল কি সমান? তাঁর কাছে আরও জানতে চাই, কোন সচিব বা উপদেষ্টা প্রতিদিন কর্মস্থলে বা অফিসে যেতে উড়ালসড়ক বন্ধ রাখেন? প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে শেখ হাসিনা যে কঠোর প্রটোকল বা প্রটেকশন নিয়ে চলতেন, তেমনটি তো প্রধান উপদেষ্টার ক্ষেত্রেও দেখা যায় না। তা ছাড়া এ সরকারের বেশ কয়েকজন এমন উপদেষ্টাও রয়েছেন, অনেক সময় কোনো প্রটোকল বা প্রটেকশন ছাড়াই তাঁরা চলাফেরা করেন। প্রটোকল বা প্রটেকশন মেনে চললেও অন্তত খান সাহেবের মতো এভাবে ‘জমিদারিভাবে’ নয়। গাজীপুর শহর এখন দেশের অন্যতম অপরাধপ্রবণ এলাকা। এখানে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ ও খুনের একের পর এক ঘটনা চরম আতঙ্ক তৈরি করেছে। মাদকের ব্যাপক বিস্তারের ফলে সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন অভিভাবকেরা। এখন কমিশনার সাহেব সার্বক্ষণিক এলাকায় না থাকতে পারায় সবকিছু সঠিকভাবে তদারকিতেও ঘাটতি পড়ে বা অধস্তন কর্মকর্তাদের মধ্যেও থাকে ঢিলেঢালা ভাব। আর শিল্পাঞ্চল হওয়ার কারণে সেখানে চলা একের পর এক বিক্ষোভ নিয়েও তাঁর কোনো দুশ্চিন্তা কাজ করে না। শিল্প পুলিশের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়েই ভারমুক্ত হতে চান তিনি। খান সাহেব জানালেন, গাজীপুরে যেহেতু তাঁর বাসা নেই, তাই তাঁকে ঢাকায় থাকতে হয় এবং ঢাকা থেকেই কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করতে হয়। কিন্তু তাই বলে গোটা সড়কই আটকে রাখবেন, তা কোন যুক্তিতে মেনে নেওয়া যায়? তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ‘কমিশনারের তো একটা বাংলো থাকার কথা ছিল, তাই না? বাংলো বানাইয়া দিতে বইলেন। আমি ওখানে ফ্যামিলি নিয়ে চলে যাব। একটা বাংলো বানাইয়া দেওয়ার জন্য একটা প্রতিবেদন লেখেন।’ কমিশনারের থাকার জন্য ‘বাংলোই’ থাকতে হবে, ‘বাংলোই’ বানাতে হবে—এর থেকেই বোঝা যায়, এ দেশের প্রশাসনযন্ত্র বা আমলাতন্ত্রের মাথায় এখনো কতটা ঔপনিবেশিক ভূত আসর করে আছে। একটি বড় অ্যাপার্টমেন্ট বা ভবন হলেই চলবে না, তাঁর জন্য ‘বাংলোই’ লাগবে। সেটিই স্বাভাবিক; কারণ, তাঁর সমমর্যাদার অন্যান্য কর্মকর্তার জন্য বাংলো থাকলে তাঁর জন্য কেন থাকবে না! এই যে ‘মর্যাদার রেষারেষির’ সংস্কৃতি, সেটি খুবই দৃষ্টিকটূভাবে দেখা যায় সরকারি কোনো বৈঠকে কে কোন বা কেমন চেয়ারে বসবেন, তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। সেখানে একটি ভালো চেয়ার হলেই চলবে না, বস্তুগত চেয়ারটারও আলাদা ‘মূল্য’ বা ‘মর্যাদা’ থাকতে হবে! জিএমপি কমিশনার যে গাড়িতে চলাফেরা করেন, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেটির কেনাকাটা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সে ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে সেটিও তিনি উপদেষ্টা পর্যায় পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন। তাঁর এমন বক্তব্যকেও ক্ষমতাচর্চার ‘ঔদ্ধত্য’ হিসেবেও দেখতে চাইছেন কেউ কেউ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর এই ‘জমিদারিকাণ্ড’ ভাইরাল হয়ে গেছে। প্রথম আলোর ফেসবুকে কিছু কমেন্ট পড়ে আসা যাক—‘প্রজাতন্ত্রের চাকর, দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক বন্ধ করে ঢাকা থেকে গাজীপুরে অফিস করতে যায়, এত সাহস পায় কীভাবে, জানতে চায় জনগণ’, ‘এই খান সাহেবই পারবেন সব আইনকানুন, রীতিনীতি ভেঙে খানখান করে দিতে’, ‘নতুন জমিদারি’, ‘বাংলার শেষ নবাব তাই’, ‘বাংলার বারো ভূঁইয়ার একজন’, ‘এটাই সংস্কার’, ‘১২ বছর ওএসডি ছিল, এখন কড়ায়–গন্ডায় শোধ তুলছে’, ‘ওনার কথা বলার স্টাইল তো প্রধানমন্ত্রীর থেকেও ওপরের লেভেলের ভাবলেশহীন যেন তার ওপরে আর কেউ নাই’, ‘ডিবি হারুনও সেইম কাজটা করত, রাস্তা বন্ধ করে ফুল প্রটোকল নিয়ে ঢাকা যাইত, অফিস করত গাজীপুরে।’, ‘দেশটা তো ওদেরই, আমরা হলাম ভাড়াটিয়া’, ‘এই ****** এর জন্য রাশ টাইমে রাস্তায় জ্যাম লেগে যায়। প্রতিদিন বাসে গাজীপুর-কলেজ গেট মাত্র ৩-৩.৫ কি.মি রাস্তা পার হতেই সময় লাগে ১-১.৫ ঘন্টা।’ আমরা জানতে পারছি, শুধু এই খান সাহেব নন, তাঁর আগে এমন নবাবি স্টাইলে সড়ক বন্ধ করে দিয়ে মানুষকে নিয়মিত দুর্ভোগে ফেলতেন আরও অনেকে। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পরও সেই প্রবণতার অবসান ঘটেনি। ছাত্র-জনতা, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের রক্তের ওপর দিয়ে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে। সেই মানুষগুলোর ভাগ্য বদলের যে দাবি উঠেছিল, রাষ্ট্র সংস্কারের নামে সেখানে ‘লাভের গুড়’ খেতে যেন সবার আগে আবির্ভূত হয়ে গেলেন ‘পিঁপড়া’রূপে সরকারি হর্তাকর্তারাই। যেসব গোষ্ঠী হাসিনা সরকারকে ফ্যাসিবাদী বা স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার রাস্তা প্রশস্ত করে দিয়েছিল, কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল; সেই পুলিশ, প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের ‘লাটবাহাদুরি’ স্বভাবের অবসান ঘটা ছাড়া আদৌ কি কোনো পরিবর্তন সম্ভব? রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী।

ই–মেইল: [email protected]

সূ্ত্র, প্রথম আলো