এ মুহূর্তে প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে ইসির সামনে রয়েছে চ্যালেঞ্জ, এমন অভিমত অনেকের। তবে আমি মনে করি, প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন আয়োজন করাই ইসির একমাত্র চ্যালেঞ্জ নয়; বরং অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তার গুরুত্ব সম্পর্কে উপলব্ধি করে নির্বাচন কমিশনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রশ্ন দাঁড়াবে, অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ কোনটি? তা হলো, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ভোটারের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা। যদিও স্বাধীনতার ৫৪ বছর অতিক্রম করেও আমরা নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে তুলতে পারিনি।
সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশ, নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে এ বিষয়ে কিছু উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মহলের দাবি, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বকীয়ভাবে চলুক এবং সংবিধান সমুন্নত রেখে মানুষের অধিকারের পথ মসৃণ করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে সরকার মনোযোগ আরও গভীর করুক। এ দাবি নানা মহল থেকে বহুদিন ধরেই করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে দলগুলোর মধ্যে আস্থা গড়ে তোলা জরুরি। এমনকি দলগুলোর মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধা রাখা অবশ্যই জরুরি।
নির্বাচন কমিশনই শুধু নয়, মানুষের অধিকার নিশ্চিতকল্পে দেশে নিরপেক্ষ তদারকি প্রতিষ্ঠান আরও রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা জরুরি। প্রতিষ্ঠানের ভিত মজবুত করার পাশাপাশি রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের ব্যাপারে রাজনীতিকদেরই ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ভূমিকা পালনের অন্যতম মাধ্যম নির্বাচন। প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনই কেবল পারে জিইয়ে থাকা বিতর্কের নিরসন করতে।
লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠকে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
ইসি সূত্র বলছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিতে গতি আনছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, রুটিন কার্যক্রম আগেই শুরু হয়েছিল। এখন কাজ আরও গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কমিশনের প্রস্তুতির বড় অংশগুলোর মধ্যে রয়েছে ছবিসহ ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, উপযুক্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, নতুন রাজনৈতিক দল ও দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রস্তুতি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে শেষ করতে হয়। এ ধরনের প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
সরকারের তিনটি অঙ্গীকার ছিল—সংস্কার, জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ের হত্যার বিচার ও নির্বাচন। সরকারের গঠন করা সংস্কার কমিশনগুলো ইতিমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আর সব কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব বা সুপারিশ বাস্তবায়নের সঙ্গে সংবিধান বা নির্বাচনেরও সম্পর্ক নেই। সরকার নির্বাহী আদেশে অনেক সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারে। কিন্তু দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সরকার কোনোটিতে হাত দেয়নি। বিচারপ্রক্রিয়াও এগিয়ে চলেছে, তবে বিচারটি কবে শেষ হবে, সেটা নির্ভর করে আদালতের ওপর। তৃতীয়টি হলো নির্বাচন।
নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রে উত্তরণের কোনো বিকল্প উপায় আছে বলে আমাদের জানা নেই। নির্বাচন দুই মাস পর হলে সব সংস্কার বা বিচারকাজ শেষ হবে, তার নিশ্চয়তাও নেই। যদি দলগুলো তাদের মধ্যে হানাহানি পরিহার করতে না পারে, তাহলে ইতিহাসের সেরা নির্বাচন দূরের কথা, মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচন করাও দুরূহ হবে।
জানা যায়, ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে যারা ১৮ বছর পূর্ণ করবেন, এমন ৬০ লাখের বেশি নতুন ভোটারকে এবার ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া কাজ চলছে ২০ লাখ মৃত ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কাজও।
ইসি সূত্র জানায়, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর নির্বাচনের সময় ধরে জুলাইয়ে কর্মপরিকল্পনা ঘোষণার প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু এখন নতুন সময়সীমায় তা পরিবর্তন হচ্ছে। এ ছাড়া নির্বাচন ঘিরে আচরণবিধি, কেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা এবং আইন-বিধি সংস্কারের কাজও চলছে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ।
এই প্রক্রিয়ায় ভোটার সংখ্যা, ভৌগোলিক কাঠামো ও প্রশাসনিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে আসনগুলোর সীমারেখা ঠিক করা হয়। বর্তমানে নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার অনুমোদন নিয়েও ইসি কাজ করছে। নিবন্ধনের জন্য আবেদন পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্ট দলের সাংগঠনিক কাঠামো, কার্যক্রম ও নিয়মনীতি যাচাই করা হচ্ছে। ইসি সূত্র জানায়, আচরণবিধি, নির্বাচন পরিচালনা নীতিমালা, ভোটকেন্দ্র স্থাপনসংক্রান্ত নিয়মাবলি সময়মতো সংশোধন করে প্রকাশ করার পরিকল্পনা কমিশনের রয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম যথাসময়ে শুরু হবে।
সূত্রমতে, বরাবরের মতো আসন্ন নির্বাচনেও জেলা প্রশাসক, ইউএনও এবং ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দায়িত্ব বণ্টন করা হবে। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, তত দ্রুত এই ধাপগুলো সম্পন্ন হবে। রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে তফসিল ঘোষণার সময়। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাদের তালিকা চূড়ান্ত করে প্রশিক্ষণও শুরু হবে সে সময়েই। সময় বাড়ায় নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রস্তুতির সুযোগও বাড়ছে। ইসি এবার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে বলেও প্রত্যাশা সবার।
সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে সবার আগে দেখতে হবে প্রশাসন নিরপেক্ষ কি না। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রশাসনকে বাগে আনা বা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে টিম ম্যানেজমেন্টের ওপর গুরুত্বারোপ দরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য টিম ম্যানেজমেন্টের বিষয়টি এসেছে। কারণ, নির্বাচন করতে ৭ থেকে ১০ লাখ মানুষ কাজ করবেন। তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। নির্বাচন কমিশন তাঁদের মাধ্যমে নির্বাচন করবে। তাই তাঁদের ব্যবস্থাপনা, তাঁদের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং যোগাযোগ—এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ।
তাই মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের দূরত্ব জিরোতে আনতে হবে। মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ হলো জেলা প্রশাসক। জাতীয় নির্বাচনে তাঁরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। সুতরাং তাঁদের এড়িয়ে চলে নির্বাচন সফল হবে না। মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সম্পর্কের অবনতি হলে সেটি দ্রুত ঠিক করতে হবে এবং ডিসিদের শক্তিশালী করার জন্য আইন করতে হবে। কারণ, তাঁরা যাতে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সে জন্য সার্বিক সহযোগিতা করতে হবে।
বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিবেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার মাধ্যমে বর্তমান কমিশন নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আস্থার সংকট উত্তরণের সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনকেও এ সুযোগ কাজে লাগানোর বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে হবে গণতন্ত্রের শোভা বৃদ্ধি করতে।
দেশের মানুষ ২০ বছর ধরে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি এবং নতুন প্রজন্মের ভোটাররাও ভোট দিতে পারেননি। তাই তাঁরা দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র উত্তরণ চান। এটিই ছিল আন্দোলনের মূল প্রত্যাশা।
নির্বাচন ছাড়া গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক এবং জনগণের সাংবিধানিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার আর কোনো পথ নেই। আমরা যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তাহলে এখানে সবার মতামত নেওয়ার সুযোগ আছে। সুতরাং সবাই তাঁর মতামত দিতে পারেন। এটাই গণতন্ত্রের বড় পাওয়া, সবাই তাঁর নিজের মতামত দেবেন। এর মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। যতটুকু ঐকমত্য হবে, সংস্কারও ততটুকুই হবে। বাকি অংশটা নির্বাচনের মাধ্যমে জাতির কাছে নিয়ে যেতে হবে। সংস্কার তো চলমান প্রক্রিয়া এবং এটি এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না, নির্বাচনের পরও এটি চলমান থাকবে।
ড. মোসলেহ উদ্দিন আহমদ লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*মতামত লেখকের নিজস্ব