বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা আজ এক চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, তরুণ জনগোষ্ঠীর সম্ভাবনা এবং বিশ্বমানের গবেষণার চাহিদা; অন্যদিকে গবেষণার সীমিত পরিসর এবং ক্রমবর্ধমান মেধাপ্রবাহ বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা। এই দ্বন্দ্বের মূল কারণগুলোর একটি হলো—আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনকাঠামো। বর্তমানে তাঁরা একই জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত, যা সাধারণ প্রশাসনিক বা অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে সমানতালে চলে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ও গবেষণার মতো বিশেষায়িত ও শ্রমসাধ্য কাজের প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র কার্যকর সমাধান হলো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য একটি পৃথক ও প্রতিযোগিতামূলক বেতনকাঠামো।
বর্তমান বেতনকাঠামোর বাস্তবতা
জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের পদভিত্তিক বেতনসীমা হলো: প্রভাষক (গ্রেড-৯) ২২,০০০-৫৩,০৬০ টাকা, সহকারী অধ্যাপক (গ্রেড-৬) ৩৫,৫০০-৬৭,০১০ টাকা এবং অধ্যাপক (গ্রেড-৩) ৫৬,৫০০-৭৪,৪০০ টাকা (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী)। প্রথম দেখায় এই অঙ্ক হয়তো সাধারণ চাকরিজীবীদের জন্য যথাযথ মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম লাগামছাড়া—চাল, ডাল, তেল, মুরগি, মাছ থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বেড়েছে। একটি গড় পরিবার চালাতে যেখানে মাসে ন্যূনতম ৭০-৮০ হাজার টাকার প্রয়োজন, সেখানে একজন সহকারী অধ্যাপক পরিবার চালাতে হিমশিম খান। শিক্ষকতার প্রতি ভালোবাসা থাকলেও বাস্তব জীবনের চাপ তাঁদের মানসিক যন্ত্রণায় ফেলে।
শ্রীলঙ্কার মডেল প্রমাণ করে গবেষণা ভাতা ও একাডেমিক ভাতা কীভাবে শিক্ষকদের উৎসাহিত করে। আর চীন দেখিয়েছে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকে যদি রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার হিসেবে ধরা হয়, তবে স্বল্প সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব। তাই বাংলাদেশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পৃথক বেতনকাঠামো কেবল ন্যায্য দাবি নয় বরং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের কৌশলগত শর্ত।
প্রতিবেশী দেশের তুলনা
ভারত : ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক প্রণীত সপ্তম পে কমিশনের আওতায় বেতন পান। সেখানে সহকারী অধ্যাপকের প্রবেশমূলক বেতন ধরা হয়েছে ৫৭,৭০০ (একাডেমিক লেভেল-১০), সহযোগী অধ্যাপক ১,৩১,৪০০ (লেভেল-১৩ এ) এবং অধ্যাপক ১,৪৪, ২০০ (লেভেল-১৪)। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মহার্ঘ ভাতা, গৃহভাড়া ভাতা, মেডিকেল সুবিধা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। বাস্তবে একজন অধ্যাপক ভারতের একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ অর্থ পান, তা বাংলাদেশের প্রায় তিন থেকে চার গুণ বেশি।
শ্রীলঙ্কা: শ্রীলঙ্কায় বেতনকাঠামো কিছুটা ভিন্ন। সেখানে মৌলিক বেতন তুলনামূলকভাবে কম হলেও বিশাল পরিমাণ একাডেমিক ভাতা যোগ হয়। যেমন অধ্যাপকপদে মৌলিক বেতন ১,১৭,৩৫০-১,৫২,৪৫০ শ্রীলঙ্কান রুপি হলেও এর সঙ্গে ১৬০ থেকে ১৬৭ শতাংশ একাডেমিক ভাতা যুক্ত হয়। ফলে একজন অধ্যাপক মাস শেষে ৩ লাখ রুপি বা তারও বেশি পান। একইভাবে লেকচারার বা সিনিয়র লেকচারাররাও তাঁদের মৌলিক বেতনের দ্বিগুণের কাছাকাছি ভাতা পান। ফলে তাঁদের আয় বাংলাদেশের তুলনায় বহুগুণ বেশি, আর এতে শিক্ষকেরা গবেষণা, শিক্ষাদান ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় সময় ও শ্রম দিতে আরও উৎসাহিত হন।
নেপাল: নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত বেতনকাঠামো অনুযায়ী সহকারী অধ্যাপকেরা প্রায় ৪২,৩৮০ নেপালি রুপি পান, যা বিভিন্ন ভাতা যুক্ত হয়ে প্রায় ৫৩,৬৮৪ রুপিতে দাঁড়ায়। সহযোগী অধ্যাপক পান প্রায় ৬০,৯০২ রুপি এবং অধ্যাপক প্রায় ৬৬,৮৬০ রুপি। যদিও এই অঙ্ক ভারতের বা শ্রীলঙ্কার তুলনায় কম, তবু বাংলাদেশের তুলনায় তুলনামূলক প্রতিযোগিতামূলক।
এই তুলনা স্পষ্ট করে যে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ের বেতন পান। বিশেষত ভারত ও শ্রীলঙ্কা যেখানে শিক্ষকতা পেশাকে উচ্চ মর্যাদা ও প্রতিযোগিতামূলক বেতনে মূল্যায়ন করছে, সেখানে বাংলাদেশ পিছিয়ে যাচ্ছে।
সামাজিক মর্যাদা ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রবণতা
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা একটি সম্মানজনক পেশা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকতায় আসেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক যোগ্য ছাত্রছাত্রী এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে আগ্রহী নয়। তারা করপোরেট সেক্টর, ব্যাংক বা বিদেশে ভালো বেতনের চাকরিতে চলে যাচ্ছে। কারণ, একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে সমাজে যে সম্মান দেওয়া হয়, তার সমান মর্যাদা তিনি অর্থনৈতিকভাবে পান না। ফলে এই বৈষম্য পেশাটিকে কম আকর্ষণীয় করে তুলছে।
চীনের উদাহরণ
চীন শিক্ষা ও গবেষণার শক্তিকে জাতীয় উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ১৯৯০-এর দশক থেকে তারা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক বেতন ও গবেষণা ভাতা প্রবর্তন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একজন অধ্যাপক সরকারি ভর্তুকি, গবেষণা প্রকল্প ও অতিরিক্ত ভাতার মাধ্যমে মাসে কয়েক হাজার ডলার আয় করতে পারেন। প্রজেক্ট ৯৮৫ ও প্রজেক্ট ২১১—এর মতো কর্মসূচির মাধ্যমে চীন বুঝিয়ে দিয়েছে—শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে হলে প্রথমে শিক্ষককে মর্যাদা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে হবে। আজ চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে উঠছে এরই ফলে।
বেতনবৈষম্যের প্রভাব
১. মেধাপ্রবাহ বিদেশমুখী হওয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা একসময় ছিল সর্বোচ্চ সম্মানজনক পেশা। কিন্তু বর্তমানে বেতনবৈষম্যের কারণে অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী বিদেশে উচ্চশিক্ষার পর দেশে আর ফিরে আসতে চান না। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পর্যায়ের বেতন বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪-৬ লাখের সমান, অথচ দেশে একজন প্রভাষকের বেতন সরকারি স্কেলে ৩০–৪০ হাজার টাকার বেশি নয়। ফলে উচ্চশিক্ষা শেষে অনেকে বিদেশেই স্থায়ী হচ্ছেন।
২. গবেষণা উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা গবেষণার পাশাপাশি জীবনধারার জন্য অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের পথ খুঁজছেন। তাঁরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স পড়ানোর সুযোগ খুঁজে নেন। এই অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং বেতনবৈষম্য তাঁদের গবেষণার জন্য সময় ও মনোযোগ কমিয়ে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, গবেষণা ভাতা না থাকায় নতুন প্রকল্প গ্রহণ বা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশনা কম হচ্ছে। এর ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার মান আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় পিছিয়ে যাচ্ছে।
৩. নিয়োগে সংকট
যোগ্য প্রার্থীরা বর্তমানে ব্যাংক, করপোরেট সেক্টর, আইটি খাত বা বিদেশি প্রতিষ্ঠানে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন, কারণ সেখানকার বেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অনেক বেশি। যেমন একটি বেসরকারি ব্যাংকে প্রবেশ পর্যায়ের কর্মকর্তার বেতন প্রায় ৫০-৬০ হাজার টাকা, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে দীর্ঘ প্রতিযোগিতার পর নিয়োগ পেলেও হাতে আসে প্রায় একই বা তার চেয়েও কম অর্থ। এতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতায় আসতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
৪. মানসিক চাপ ও কর্ম-অসন্তুষ্টি বৃদ্ধি
বেতনবৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটি মানসিক চাপও তৈরি করে। একই শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মেধার মানুষ অন্য খাতে অনেক বেশি সুবিধা ভোগ করলে শিক্ষকের মধ্যে অবমূল্যায়নের বোধ জন্মায়। যেমন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ও প্রশাসনিক ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার দায়িত্ব ভিন্ন হলেও দেখা যায় কর্মকর্তা অনেক বেশি আর্থিক সুবিধা পান। এই বৈষম্য থেকে শিক্ষকেরা অসন্তুষ্ট হন, যা তাঁদের কর্মোদ্যম কমিয়ে দেয়।
৫. প্রজন্মের কাছে শিক্ষকতার মর্যাদা কমে যাওয়া
শিক্ষার্থীরা দেখছে তাদের শিক্ষকেরা আর্থিক কষ্টে ভোগেন, যেখানে একই বয়সী অনেকে অন্য খাতে অনেক বেশি আয় করছেন। এতে তরুণ প্রজন্মের কাছে শিক্ষকতার আকর্ষণ কমে যাচ্ছে। এর বাস্তব উদাহরণ হলো, সরকারি বিসিএস বা বেসরকারি খাতে অনেক বেশি মেধাবীরা ঝুঁকছেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় আগ্রহী হচ্ছেন কমসংখ্যক।
করণীয় ও প্রস্তাবনা
১. আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সমন্বয়: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য একটি পৃথক বেতনকাঠামো প্রবর্তন করা উচিত, যা ভারত, শ্রীলঙ্কা ও চীনের মতো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক এবং প্রভাষক সব পদে এমন বেতন নির্ধারণ করতে হবে, যা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিযোগিতামূলক বেতনের অনুরূপ। এটি শুধু অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেবে না, বরং শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও পেশাগত আকর্ষণও বৃদ্ধি করবে।
২. গবেষণা ও একাডেমিক ভাতা চালু: মৌলিক বেতনের ওপর ৫০-১০০ শতাংশ হারে গবেষণা ও একাডেমিক ভাতা প্রবর্তন করা উচিত। এই ভাতা শিক্ষকদের নতুন প্রকল্প গ্রহণ, আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশনা, গবেষণামূলক শিক্ষা এবং উদ্ভাবনী কার্যক্রমে উৎসাহিত করবে।
৩. প্রারম্ভিক পর্যায়ের ও সব পদে সুরক্ষা: প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপকের জন্য ন্যূনতম জীবিকা নির্বাহযোগ্য বেতন নিশ্চিত করা উচিত, যাতে তাঁরা পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন এবং আর্থিক চাপের কারণে গবেষণা বা শিক্ষাদান থেকে মনোযোগ বিচ্যুত না হয়।
৪. আর্থিক সুবিধা ও সহায়তা: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কম সুদে গাড়িঋণ ও গৃহঋণ প্রদান করা যেতে পারে, যেমনভাবে বিসিএস ক্যাডার এবং সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা পেয়েছেন। এর ফলে শিক্ষকেরা নিজস্ব বাসস্থান ও পরিবহন সহজে ব্যবস্থা করতে পারবেন, যা তাঁদের আর্থিক নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তি নিশ্চিত করবে।
বাংলাদেশ এখন এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছে, যখন টেকসই উন্নয়ন, স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অগ্রসর হওয়ার জন্য উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা কেবল পাঠদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন; তাঁরা নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করেন, গবেষণা পরিচালনা করেন, বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন ঘটান, তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করেন এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের সুনাম প্রতিষ্ঠা করেন। অথচ তাঁদের বেতনকাঠামো এখনো সাধারণ প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে বাঁধা, যা এই বিশাল দায়িত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
যদি আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতিযোগিতামূলক বেতন ও গবেষণা ভাতা নিশ্চিত না করি, তাহলে মেধাবীরা ধীরে ধীরে বিদেশমুখী হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্য শিক্ষক সংকট দেখা দেবে, এবং শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। ভারতের উদাহরণ দেখায় কীভাবে জাতীয় পর্যায়ে একাডেমিক লেভেলভিত্তিক উচ্চ বেতন মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করছে।
শ্রীলঙ্কার মডেল প্রমাণ করে গবেষণা ভাতা ও একাডেমিক ভাতা কীভাবে শিক্ষকদের উৎসাহিত করে। আর চীন দেখিয়েছে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকে যদি রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার হিসেবে ধরা হয়, তবে স্বল্প সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব। তাই বাংলাদেশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পৃথক বেতনকাঠামো কেবল ন্যায্য দাবি নয় বরং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের কৌশলগত শর্ত।
একই সঙ্গে সামাজিক বাস্তবতাও বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনকেই কঠিন করে তুলছে; অথচ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বর্তমান বেতন দিয়ে একটি পরিবার চালানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। সমাজে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে আমরা সর্বোচ্চ সম্মান দিই, কিন্তু বাস্তবে তাঁদের জীবনযাত্রা সেই সম্মানের সঙ্গে যায় না। এই বৈপরীত্য তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষকতা পেশা থেকে নিরুৎসাহিত করছে। ফলে আগামী দিনে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা অন্য খাতে চলে যাবে, যা দেশের জ্ঞানভিত্তিক উন্নয়নকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
একটি পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় বেতনকাঠামো শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে, গবেষণা ও উদ্ভাবনে নতুন উদ্দীপনা আনবে এবং তরুণদের কাছে শিক্ষকতাকে আবার আকর্ষণীয় করে তুলবে। রাষ্ট্র যদি সত্যিই উন্নত বাংলাদেশ গড়তে চায়, তবে শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগকে ব্যয়ের খাত হিসেবে নয়, বরং ভবিষ্যতের উৎপাদনশীল সম্পদ হিসেবে দেখতে হবে। আজকের শিক্ষকের আর্থিক কষ্ট, অবমূল্যায়ন ও অবহেলা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী প্রজন্মও তার মূল্য চুকাবে। পরিশেষে শেষ করতে চাই সরোচিত কবিতার লাইন দিয়ে—
যে শিক্ষক জ্বালান আলো, তারই ঘরে আঁধার,
জ্ঞানের বীজ বুনে যান, থাকেন অবহেলার ভার।
ড. জিয়া আহমেদ শিক্ষক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট