ট্রাম্প প্রশাসন কি ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করছে? সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো: সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবে নয়, তবে ঘটনাচক্রে এমনটা ঘটতে পারে। আর সেটাই আসল সমস্যা।

যুক্তরাষ্ট্র-ভেনেজুয়েলা সাম্প্রতিক উত্তেজনা পুরোনো সেই পরিচিত গল্পই মনে করিয়ে দিচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলার ভেতরে সক্রিয় মাদক চক্রগুলোর ওপর সামরিক হামলা করার চিন্তাভাবনা করছে। এটি প্রকারন্তরে মাদুরোকে দুর্বল করার একটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ।

যদিও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো কোনো পদক্ষেপের অনুমোদন দেননি। মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। স্পষ্ট কোনো পরিণতি নির্ধারণ না করেই চাপ বাড়ানোর কৌশল এটি।

ট্রাম্প প্রশাসন অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে এটিকে সরাসরি শাসন পরিবর্তনের কথা না বলে মাদক ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান হিসেবে উপস্থাপন করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও কট্টরনীতি বাস্তবায়নের পেছনে প্রধান চালিকা শক্তি। ভেনেজুয়েলাকে তাঁর কিউবান-আমেরিকান অভিজ্ঞতার যে প্রিজম, তা দিয়েই দেখেন। তিনি মনে করেন, মাদুরোর শাসন কিউবার গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা টিকে আছে, আর ভেনেজুয়েলার তেল কিউবার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মাদুরোকে অপসারণ করাই হলো ‘মহাদেশ পরিষ্কারের প্রথম ধাপ’।

কিন্তু বাস্তবতা এখানে মতাদর্শকে টক্কর দিচ্ছে। ট্রাম্প নিজে ভেনেজুয়েলায় শাসন পরিবর্তনের চেষ্টার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন, তবে তিনি ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছে বড় সামরিক শক্তি মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন। এই বৈপরীত্য কেবল কূটনৈতিক ছলনা নয়; বরং ভেনেজুয়েলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি, তা নিয়েই বিভ্রান্তি তৈরি করে।

যুক্তরাষ্ট্র কি মাদুরোকে আলোচনায় বসতে চাপ দিচ্ছে? দেশটি কি আশা করছে, ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনীকে দিয়ে একটি অভ্যুত্থান ঘটাবে? অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে একটি জনবিদ্রোহ সৃষ্টির কথা চিন্তা করছে? নাকি এগুলোর সবই?

দুঃখজনক হলো, ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলায় ঘটনাচক্রে সরকার পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে। কেউই পরিষ্কারভাবে ভেনেজুয়েলার পুনর্গঠন চাইছে না। তবে বর্তমান নীতির ফল অনিবার্যভাবেই আমাদের ওপর এই দায় চাপিয়ে দিতে পারে। এটি কৌশল নয়, এটি কঠোরতার ছদ্মবেশে আসলে দায়িত্বহীনতা।

ইচ্ছাকৃত হোক আর অনিচ্ছাকৃত—সরকার পরিবর্তন যে নানা সমস্যা তৈরি করে, সেটা পরবর্তী সময় দেখা যায়। ভেনেজুয়েলার পরিস্থিতি ইরাক বা লিবিয়ার মতো না হলেও একই ধরনের সমস্যা সেখানে আছে। দেশটি তেলের ওপর নির্ভরশীল আর প্রতিষ্ঠানগুলোও দুর্বল।

বিরোধী দলগুলো বিভক্ত ও নেতাদের বড় একটা অংশ নির্বাসিতও। সেনাবাহিনীর একটা অংশ মাদক পাচারের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। যেকোনো অন্তর্বর্তী সরকারকে তাৎক্ষণিক বৈধতার সংকটের কারণে অর্থনৈতিক সংকট ও সহিংসতার মুখোমুখি হতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের এবারের কৌশল হয়তো বিপরীত ফলই বয়ে আনবে। মাদুরো এখন জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং সামরিক-বেসামরিক বাহিনীকে সক্রিয় করতে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির বিরুদ্ধে তিনি জাতীয়তাবাদী আবেগের জাগরণ ঘটাচ্ছেন।

কোনো স্বৈরশাসককে বাইরের চাপ, যা বিদেশি আক্রমণ হিসেবে দেখানো যায়, দুর্বল করতে পারে না। আমরা এমন দৃশ্য আগে দেখেছি—কিউবা, ইরান, উত্তর কোরিয়ায়। সাধারণত এর সমাপ্তি ভালো হয় না।

কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকারের ওপর বিদেশি চাপ, যেটাকে সহজেই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বলে চিত্রিত করা যায়, সেটা সেই সরকারকে শক্তিশালী করে। এর আগে আমরা কিউবা, ইরান, উত্তর কোরিয়া—সব কটি দেশের ক্ষেত্রে একই চিত্র দেখেছি।

সবচেয়ে বড় রঙ্গ হচ্ছে, ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণার সময় ভেনেজুয়েলা থেকে অভিবাসন বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ভেনেজুয়েলার পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হলে যুক্তরাষ্ট্রে ভেনজুয়েলার অভিবাসীদের সংখ্যা আরও বাড়বে।

ভেনেজুয়েলা এরই মধ্যে সত্তর লাখের বেশি শরণার্থী ও অভিবাসীর জন্ম দিয়েছে। ভেনেজুয়েলায় রাষ্ট্র পতনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। কলম্বিয়া, ব্রাজিল ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশও অভিবাসী নিয়ে চাপের মুখে রয়েছে। ট্রাম্প ও তাঁর উপদেষ্টারা কি ভেবেছেন, ভেনেজুয়েলার এই মানুষগুলো কোথায় যাবে?

ভেনেজুয়েলার বিষয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হলে কিছু অস্বস্তিকর সত্যকে মানতেই হবে। প্রথমত, মাদুরোর আচরণ নিন্দনীয় হলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সরাসরি হুমকি নন। তাঁর শাসন দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত ও ধীরে ধীরে সমর্থন কমছে। কিন্তু বাইরের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া তাঁর সরকারের পতনের মতো অবস্থা নেই।

দ্বিতীয়ত, ভেনেজুয়েলার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব তৈরির সুযোগও সীমিত। ট্রাম্প প্রশাসন বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোর ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞায় শর্তসাপেক্ষে যে ছাড় ঘোষণা করেছিল, তা বাতিল করেছে। কোম্পানিগুলোকে ভেনেজুয়েলা ছাড়ার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। এটিই সর্বোচ্চ চাপ। এরপর আর কী বাকি থাকে? সামরিক পদক্ষেপ নিয়ন্ত্রণযোগ্য একটি সমস্যাকে আঞ্চলিক সংকটে পরিণত করার ঝুঁকি তৈরি করবে।

তৃতীয়ত, ট্রাম্প প্রশাসনকে ভাবতে হবে, এখানে আসলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কী। যদি উদ্দেশ্য হয় মাদক পাচার বন্ধ করা, তাহলে ভেনেজুয়েলায় হামলা করার চেয়ে আরও কার্যকর উপায় আছে। যদি উদ্দেশ্য হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, তাহলে ইতিহাস দেখিয়েছে, সামরিক হস্তক্ষেপ সাধারণত সাহায্য না করে ক্ষতি করে।

ট্রাম্প প্রশাসনের সামনে এখন দুটি পথ খোলা। ভেনেজুয়েলার ওপর চাপ বাড়িয়ে সরকার পরিবর্তনের ঝুঁকি নেওয়া, অথবা নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন যেমন মাদকবিরোধী সহযোগিতা, অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক স্বাভাবিকীকরণের জন্য সংলাপে মনোযোগ দেওয়া।

এ ধরনের সংলাপ কি অপ্রিয়? হ্যাঁ। এতে স্বৈরশাসককে বৈধতা দেওয়া হয় কি? কিছুটা, হ্যাঁ। তবে বাস্তববাদী হওয়া মানে কখনো ভালো-খারাপের মধ্যে একটিকে নির্বাচন করা নয়।

দুঃখজনক হলো, ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলায় ঘটনাচক্রে সরকার পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে। কেউই পরিষ্কারভাবে ভেনেজুয়েলার পুনর্গঠন চাইছে না। তবে বর্তমান নীতির ফল অনিবার্যভাবেই আমাদের ওপর এই দায় চাপিয়ে দিতে পারে। এটি কৌশল নয়, এটি কঠোরতার ছদ্মবেশে আসলে দায়িত্বহীনতা।

যদি ট্রাম্প প্রশাসন বিদেশে অনন্তকাল ধরে চলা একটি সমস্যার দায়দায়িত্ব এড়াতে চায়, তবে ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তনের প্রলোভন থেকে তাদের সরে আসা উচিত। ভেনেজুয়েলার মানুষ মাদুরোর চেয়ে ভালো শাসক পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির পরবর্তী বিপর্যয়ে তারা পরিণত হতে পারেন না।

লিওন হাদার একজন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে বিশ্লেষক

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

সূত্র, প্রথম আলো