১৬ জুন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর যেভাবে হতে পারে’ শিরোনামে একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে দেওয়া বিভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্যের সূত্র ধরে লিখেছেন ফরহাদ মজহার

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর প্রতিনিধিত্ববাদী ক্ষমতা ও শাসনকাঠামোর মধ্যেই বিকল্প খোঁজার চেষ্টা আসলে জনগণের ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া।

‘নাগরিক সমাজ’ বারবার ব্যবহৃত হয়েছে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই নাগরিক সমাজ বলতে বোঝানো হচ্ছে মূলত এনজিওকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত প্রতিনিধিকাঠামো।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার একটি প্রত্যক্ষ প্রকাশ ঘটিয়ে সবাইকে বিস্মিত করে। আমরা সবাই তা প্রত্যক্ষ করেছি। এই অভ্যুত্থান নিছকই একটি রাজনৈতিক সরকার পতনের ঘটনা ছিল না, বরং ছিল একটি মৌলিক গঠনতান্ত্রিক মুহূর্ত। যেখানে জনগণ বিদ্যমান রাষ্ট্রিক শৃঙ্খলার বাইরে নিজস্ব সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা বাংলাদেশকে নতুনভাবে গঠন করতে ঐতিহাসিকভাবে প্রস্তুত।

কিন্তু বিদ্যমান সংবিধানের অধীন উপদেষ্টা সরকারকে শপথ পাঠ করিয়ে সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে পুরোনো রাষ্ট্রব্যবস্থাই বহাল রাখা হয়। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের কোনো ঘোষণাও (প্রক্লেমেশন) দিতে দেওয়া হয়নি। সমাজের অভিজাত শ্রেণির নেতৃত্বে কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে গণ–অভ্যুত্থানকে তথাকথিত সংস্কারের শূন্যগর্ভ আলোচনায় পর্যবসিত করা হয়।

পরবর্তী সময় নানা বুদ্ধিজীবী, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার মধ্য দিয়ে একধরনের জুলাই অভ্যুত্থানের লক্ষ্যবিরোধী আদর্শিক প্রতিক্রিয়া ও বয়ান তৈরি শুরু হয়ে যায়, যার লক্ষ্য এই অভ্যুত্থানকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার’ ও ‘ধাপে ধাপে পরিবর্তন’-এর মধ্যে সংকুচিত করে ফেলা। অর্থাৎ সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের পক্ষে বয়ান তৈরির কাজও শুরু হয়ে যায়।

জুলাই অভ্যুত্থানের আদর্শ ও চাওয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বয়ান তৈরির উদাহরণ হিসেবে আমরা ১৬ জুন যৌথভাবে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর যেভাবে হতে পারে’ শিরোনামে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করতে পারি। এই গোলটেবিল বিষয়ে প্রথম আলোর যথার্থ শিরোনাম, ‘প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রূপান্তরে যেতে হবে’।

লক্ষণীয় যে জুলাই অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ও আদর্শবিরোধী সংস্কারবাদী রাজনীতি গঠনতান্ত্রিক রূপান্তরের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অস্বীকার করে। এমনকি তারা রাষ্ট্রের সংস্কারও চায় না। তারা শুধু চায় বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার। আলী রীয়াজের ভাষায়, ‘আসল কাজ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাঁড় করানো, কার্যকর করা। দ্বিতীয় হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য সম্মিলিত শক্তির একটা সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা করা। এটা এখনকার যেসব রাজনৈতিক শক্তি আছে, তাদের মাধ্যমে করার সম্ভাবনা আমি প্রায় দেখি না।’

আলী রীয়াজ বিদ্যমান লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির প্রতিনিধিদের সংগঠনকেই ‘রাজনৈতিক দল’ গণ্য করেন এবং জনগণের শক্তি শুধু তাদের মধ্যেই নিহিত রয়েছে, এটা অনুমান করেন। উপদেষ্টা সরকারের কার্যকলাপও গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী প্রতিবিপ্লবী ধারণা ধারণ করে বলে লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক দল গণ্য করে।

গণ-অভ্যুত্থান লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির নেতৃত্বে হয়নি। আলী রীয়াজসহ উপদেষ্টা সরকারের চিন্তায় জনগণ অনুপস্থিত। ফলে দেখা যায়, অসচেতনতা–দোষে অথবা সজ্ঞানেই প্রতিবিপ্লবী (সংস্কারবাদী) বয়ান কীভাবে ‘জনগণ’কে রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে চ্যুত করে। আর সেখানে লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির প্রতিনিধিদের প্রতিস্থাপিত করা হয়।

এরপর জনগণের সার্বভৌম কতৃত্বকে প্রতিষ্ঠাননির্ভর সংস্কারের নামে প্রতিস্থাপিত করে কার্যত জনগণের গণতান্ত্রিক গাঠনিক ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়। অথচ যে ক্ষমতার শক্তি আমরা গত ৫ আগস্ট দেখেছি এবং উপদেষ্টা সরকার তার ফলভোগীমাত্র।

অভ্যুত্থানকে ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখা: গঠন নয়, ব্যবস্থার মেরামত

গোলটেবিলের বক্তারা জুলাই অভ্যুত্থানকে মূলত একটি ‘সুযোগের জানালা’ (উইনডো অব অপরচুনিটি) হিসেবে উপস্থাপন করেন, যেখানে কিছু প্রতিষ্ঠান সংস্কার করে বিদ্যমান গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের গঠনতান্ত্রিক শক্তিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এবং বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোর ধারাবাহিকতা রক্ষার পথেই চলে যায়।

‘প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাঁড় করানো ও সম্মিলিত শক্তির সমাবেশ ঘটানো এখনকার প্রধান কাজ’—কথাটি শুনতে যতই যুক্তিসংগত মনে হোক না কেন, এটি জনগণের গঠনতান্ত্রিক উত্থানকে ব্যবস্থার অন্তর্গত একটি শৃঙ্খলা রক্ষামূলক ইস্যুতে পরিণত করে। এই অভ্যুত্থানকে সংবিধানবহির্ভূত একনতুন গঠনের ভাষা হিসেবে না দেখে বক্তারা সেটিকে পাশ্চাত্য পরাশক্তির তৈরি করা সুশীল সমাজ বা এনজিওপন্থী সংস্কারের সীমিত পরিসরে আবদ্ধ করে ফেলেন।

গঠনতন্ত্র নির্মাণের দাবির অনুপস্থিতি ও ক্ষমতার উৎসে জনগণের অনুপস্থিতি

গোলটেবিলে কারও বক্তৃতায় কোনো পর্যায়ে ‘নতুন গঠনতন্ত্র’ বা ‘গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া’র কথা ওঠেনি; বরং সব বক্তা বর্তমান সংবিধান ও রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যেই সংস্কার খুঁজতে চান, যেমন নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার, কমিশনের স্বাধীনতা বা নারীদের উচ্চকক্ষে অংশগ্রহণ ইত্যাদি। এ থেকে বোঝা যায়, বক্তারা ক্ষমতার উৎস হিসেবে জনগণকে স্বীকার করেন না; বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকেই ক্ষমতার ধারক মনে করেন। অথচ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে পারেনি।

আন্তোনিও নেগ্রি তাঁর ইনসার্জেনসিস: কনস্টিটুয়েন্ট পাওয়ার অ্যান্ড দ্য মডার্ন স্টেট বইয়ে দেখিয়েছেন, জনগণের গাঠনিক ক্ষমতা হলো এমন এক গাঠনিক ক্ষমতা, যা বিদ্যমান সংবিধান ও আইনের কাঠামোকে অস্বীকার করে নতুন ক্ষমতাকাঠামো ও ব্যবস্থা নির্মাণ করে। বাংলাদেশের প্রসঙ্গে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রক্রিয়া যদি এ ধরনের একটি গাঠনিক প্রক্রিয়া না হয়, তাহলে বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ আদতে গাঠনিক শক্তিকে ধ্বংস করার জন্যই করা হবে। গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশে গণবিরোধী প্রতিবিপ্লবী ধারার বয়ান সহজে শনাক্ত করতে পারা জরুরি একটি কাজ।

প্রতিষ্ঠান সংস্কার ও গঠনের কথা বলা হলেও জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা, তাদের নিজস্ব আইন প্রণয়নের অধিকার বা নতুন গঠনতন্ত্র নির্মাণের রাজনৈতিক উত্থান—এসব বিষয়ে কোনো বক্তা সরাসরি কোনো অবস্থান নেননি। এতে স্পষ্ট হয়, তাঁরা জনগণের গাঠনিক ক্ষমতার ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করতে চান।

সুশীল বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার মধ্যে নিহিত এই গণক্ষমতাবিরোধী ধ্যানধারণা আদতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী ধারা। একে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবিলা গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির জন্য আগামী দিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আত্মসমালোচনা ও পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে সমাজের এই বুদ্ধিবৃত্তিক ধারাকে আমরা কতটা গণরাজনৈতিক ধারার দিকে প্রবাহিত করতে পারি, তার ওপর আগামী দিনে গণরাজনৈতিক ধারার বিকাশ নির্ভর করবে।

প্রতিনিধিত্ব বনাম সরাসরি অংশগ্রহণের বিভ্রান্তি

গোলটেবিলে মির্জা এম হাসান ও ইমরান মতিন ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র’, ‘ডেলিবারেটিভ ডেমোক্রেসি’, ‘কাউন্টারভ্যালিং সিটিজেন পাওয়ার’ প্রভৃতি ধারণা এনেছেন। তবে এসব একান্তই একধরনের ব্যবস্থাপনাগিরি বা ব্যবস্থাপনাগত সংস্কার। যার উদ্দেশ্য, ক্ষমতার উৎসে জনগণের প্রতিষ্ঠার বদলে জনগণের ওপর প্রতিনিধিদের কর্তৃত্বকেই রক্ষা করা।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রতিনিধিত্ববাদী ক্ষমতা ও শাসনকাঠামোর মধ্যেই বিকল্প খোঁজার চেষ্টা আসলে জনগণের ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া। জনগণের সরাসরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার (যেমন পপুলার অ্যাসেম্বলি বা মজলিশভিত্তিক আইন প্রণয়ন) কোনো বাস্তব প্রস্তাব তারা করেনি। বিপরীতে তাদের তত্ত্বগুলো ইউরোপীয় বা লাতিন আমেরিকান প্রেক্ষাপটে যতটুকু কার্যকর, বাংলাদেশের বিদ্যমান ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র ও বাজারনিয়ন্ত্রিত সমাজে নিছকই আলংকারিক, তার অধিক কিছু নয়।

বাংলাদেশে প্রতিনিধিভিত্তিক বিকল্প তত্ত্ব কার্যত অপারগ। কারণ, রাষ্ট্র এখানে একটি নয়া ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামো; যেখানে আমলাতন্ত্র, সামরিকতা ও বৈদেশিক দাতানির্ভর শাসনব্যবস্থা জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণকে নীতি কিংবা আইন তৈরির স্তরে কখনোই পৌঁছাতে দেয় না। অতএব বাংলাদেশে গণতন্ত্র কায়েমের লড়াইটা ঠিক এখান থেকেই শুরু করতে হবে। এর বিকল্প নেই। বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞতা মারাত্মক বিপদ হয়ে রয়েছে। আফসোস, এত বড় গণ-অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা কিছুই শেখার চেষ্টা করছি না।

সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব সম্পর্কে পরিকল্পিত নীরবতা

আলোচনাকারীরা কেউই ২০২৪ সালের ৮ আগস্টের পর সংঘটিত ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’, অর্থাৎ সেনাসমর্থিত উপদেষ্টা সরকারের শপথ ও ফ্যাসিবাদী সংবিধান বহাল রাখার বিষয়ে কোনো মন্তব্য বা সমালোচনা করেননি। ফলে বৈঠকটি কার্যত গণ-অভ্যুত্থানের মর্মের বিপরীতে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক ধারাকেই শক্তিশালী করে।

জনগণের সার্বভৌম কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য গাঠনিক ক্ষমতার উন্মেষ আমরা ৫ আগস্টে দেখেছি। তাকে গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন করা, অর্থাৎ নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল। কেন তা ব্যর্থ হলো, তা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। এখন সংস্কার–চিন্তা সেই সম্ভাবনার রেশটুকুকেও মুছে ফেলছে এবং গণ-অভ্যুত্থানকে জনগণের স্মৃতি ও সংকল্প থেকে মুছে ফেলার এক আদর্শিক কৌশল হয়ে উঠছে। এটি বিপজ্জনক।

গণতন্ত্রের মর্ম হচ্ছে, জনগণই সার্বভৌম। রাজনৈতিক সাহিত্যের ভাষায়, ‘সার্বভৌম হলেন যিনি ব্যতিক্রমের সিদ্ধান্ত নেন।’ সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের জনগণ যদি জুলাই অভ্যুত্থানে ‘সাংবিধানিক ব্যতিক্রম’ তৈরির সামষ্টিক কর্তা হয়ে থাকে, তবে নতুন গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু না করে সেনাসমর্থিত সরকারের প্রতিষ্ঠা সেই গঠনতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটি সাংবিধানিক প্রতিক্রিয়া (কাউন্টার রেভল্যুশন)।

গোলটেবিলের বক্তারা এই ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’ ঘটে যাওয়ার মৌলিক রাজনৈতিক সত্য থেকে সরে গিয়ে ও গণ-অভ্যুত্থানের মর্ম অস্বীকার করে কেবল ‘ধাপে ধাপে সংস্কার’-এর কথা বলছেন। এর দ্বারা তাঁরা আদতে সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবকেই আদর্শিকভাবে বৈধতা দিচ্ছেন।

নাগরিক সমাজ ও মধ্যবিত্ত প্রতিনিধিকাঠামো

বক্তাদের ভাষায় ‘নাগরিক সমাজ’ বারবার ব্যবহৃত হয়েছে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই নাগরিক সমাজ বলতে বোঝানো হচ্ছে মূলত এনজিওকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত প্রতিনিধিকাঠামো, যা জনগণের সরাসরি ক্ষমতার দাবিকে প্রতিস্থাপন করে বিশেষজ্ঞ, উপদেষ্টা ও চিন্তাশীল শ্রেণির মাধ্যমে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা দিয়ে।

শেল্ডন ওলিন এ ব্যবস্থাকে বলেন, ‘ম্যানেজড ডেমোক্রেসি’—যেখানে জনগণের পরিবর্তে অভিজাত নাগরিকদের মধ্য থেকে বাছাই করা নাগরিকেরা রাষ্ট্রের সঙ্গে দেনদরবারে অংশ নেন। এই পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র একটি প্রতিক্রিয়াজাত রক্ষণশীল ব্যবস্থাপনায় পরিণত হয়, যে কারণে জনগণের অভ্যুত্থানমূলক শক্তি কোনো বাস্তব রাজনৈতিক শর্ত বা কাঠামো তৈরি করতে পারে না; বরং জনগণের শক্তি ছিন্নভিন্ন হয়ে আবার পুরোনো প্রতিষ্ঠানের ভেতর অন্তর্ভুক্ত বা লীন হয়ে যায়।

বক্তারা বারবার ‘নাগরিক সমাজ’-এর কথায় ফিরে গেছেন, কিন্তু এ সমাজ আসলে ‘জনগণ’কে একধরনের এনজিওপন্থী মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিব্যবস্থায় পর্যবসিত করে। এ কারণে গণ-অভ্যুত্থানের কর্তাশক্তি হিসেবে ‘জনগণ’ অদৃশ্য হয়ে যায়। জনগণের রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের বদলে তাদের কথনকারীরাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ সভা-সমিতি, গোলটেবিল করা ‘সুশীল গোষ্ঠী’ই রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের মীমাংসাকারী হয়ে ওঠে, যেখানে সুশীল জনপ্রতিনিধিত্ব জনগণের বিকল্প হয়ে ওঠে।

গঠনতান্ত্রিক রূপান্তরের বদলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের নামে জনগণের ক্ষমতা হরণ করারএই প্রক্রিয়াকে শনাক্ত করা ও বোঝা জরুরি। নতুনভাবে বাংলাদেশকে গঠন ও নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের আহ্বানকে পেছনে ফেলে আবার রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই সমস্যার সমাধান খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা স্পষ্টই গণবিরোধী।

গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের বিপরীতে পুরোনো রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখাই ‘সংস্কার’মার্কা মতাদর্শের উদ্দেশ্য। জনগণের গঠনতন্ত্র নির্মাণের শক্তিকে অস্বীকার করে, এমন চিন্তা আসলে বিদ্যমান ক্ষমতারই পুনরুৎপাদন। গণ-অভ্যুত্থানের উত্তরসূরি হিসেবে আমাদের কর্তব্য হবে এই প্রতিক্রিয়াশীল গণ্ডির বাইরে গিয়ে বাংলাদেশের জনগণের জন্য নতুন গণগঠনতন্ত্রের সম্ভাবনা উন্মোচন করা।

নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন বনাম সংস্কার—জনগণের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখন

প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকটি জনগণের গঠনতান্ত্রিক অধিকারকে সাংবিধানিক সংস্কারে প্রতিস্থাপনের একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা। বক্তারা অভ্যুত্থানকে ‘একটি সুযোগ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে জনগণের সার্বভৌম সিদ্ধান্তের ক্ষমতাকে সংকুচিত করেন। এ ধরনের আলাপ শুধু গণতন্ত্র নয়, জনগণের অস্তিত্বকেই প্রতিনিধি শাসনের ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর করে।

জুলাই অভ্যুত্থান ছিল একটি ঐতিহাসিক গঠনতান্ত্রিক মুহূর্ত। এখন প্রয়োজন ‘গণগঠনতন্ত্র’ নির্মাণের রাজনৈতিক পরিকল্পনা, যেখানে জনগণ নিজেরাই নিজেদের আইন, প্রতিষ্ঠান ও সিদ্ধান্ত নির্মাণে সরাসরি অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে নিজেরাই নিজেদের গঠনতন্ত্র (কনস্টিটিউশন) রচনা করবে বা রাজনৈতিকভাবে গঠন করবে।

গঠনতন্ত্র রচনা বা লেখা প্রসঙ্গে জ্যাক দেরিদার একটি কথা মনে পড়ছে, ‘রাইটিং ইজ নট অনলি দ্য কন্ডিশন অব ল, ইট ইজ দ্য ল অব দ্য কন্ডিশন।’ বাংলাদেশের জনগণের জন্য নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের মধ্য দিয়ে জনগণই এখন সেই শর্ত রচনা করতে পারে।

ফরহাদ মজহার কবি, লেখক ও চিন্তক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সূত্র, প্রথম আলো