গণ-অভ্যুত্থানের পর বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছিল প্রবল আশাবাদ। বাতাসে ভাসছিল সংস্কার, নতুন বন্দোবস্ত আর দায় ও দরদের কথা। কিন্তু বছর যেতে না যেতেই সেই আশাবাদ অনেকটা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।

চলমান মব-সন্ত্রাস, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অর্থনীতির গতিহীনতা, কর্মসংস্থানের সংকট, মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি—সব মিলিয়ে জনজীবনে স্বস্তি আসেনি। পুরোনো বন্দোবস্তে নতুন মানুষ ঢুকেছে, কিন্তু বন্দোবস্তে নতুনত্ব দেখা যায়নি; বরং নতুন বন্দোবস্তের কথা বলা অনেকের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

সর্বশেষ সংযোজন হলো অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের বিষয়ে এই সরকারেরই সাবেক উপদেষ্টা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের তোলা অভিযোগ।

সম্প্রতি একাত্তর টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেছেন, অনেক উপদেষ্টা নিজেদের আখের গুছিয়েছেন অথবা গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। উপদেষ্টাদের অনেকে সেফ এক্সিটের কথা ভাবছেন বলেও উল্লেখ করেছেন নাহিদ।

খুবই গুরুতর একটি অভিযোগ। দেশের মানুষ যাঁদের বিশ্বাস করে ক্ষমতায় বসিয়েছে সংস্কার ও নতুন বন্দোবস্তের আশায়, তাঁরা যদি সেই কাজ না করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করেন, তাহলে সেটা গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাই বটে। তা ছাড়া সেফ এক্সিটের প্রসঙ্গটা আসে অনেক সময় অনিয়ম-দুর্নীতি বা জুলুমে জড়িয়ে গেলে। কিন্তু উপদেষ্টাদের মধ্যে কারা কীভাবে আখের গুছিয়েছেন এবং সেফ এক্সিটের কথা ভাবছেন, তা স্পষ্ট করেননি নাহিদ ইসলাম। এ রকম গুরুতর বিষয়ে অস্পষ্টতা না রেখে নাহিদ ইসলামের উচিত পুরো বিষয়টা খোলাসা করা।

তবে শুধু যে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধেই আখের গোছানোর অভিযোগ উঠেছে, তা নয়। অভিযোগ আছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে কাজে লাগিয়ে আখের গুছিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাক।

সরকারি আমলারা পদ ছাড়াই পদোন্নতি আদায় করেছেন। এমনকি অবসরে যাওয়া আমলাদেরও পদোন্নতি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত অবসরে যাওয়া ৭৬৪ কর্মকর্তাকে সচিব পদসহ বিভিন্ন পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে গত বছরের ৮ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত ৭৮৫ কর্মকর্তাকে নিয়মিত পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৮ আগস্ট উপসচিব পদে ২৬৮ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

অনেকেই একসময় চেয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকার যেন বেশি দিন থাকে। তাঁরা ভেবেছিলেন, অর্ন্তবর্তী সরকার যত বেশি দিন ক্ষমতায় থাকবে, ততই দেশের উপকার হবে, তত বেশি সংস্কার হবে। তাঁরা হয়তো তখন ভাবেননি, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কোনো অনিয়ম করলে তার জবাবদিহি কীভাবে আদায় করা হবে। রাজনৈতিক সরকারের মতো ভোট না দিয়ে তো এই সরকারকে শায়েস্তা করার উপায় নেই।

এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর জন্য গঠন করা হয়েছে পে কমিশন। প্রশ্ন উঠেছে, নতুন পে স্কেল করা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের মধ্যে পড়ে কি না। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল আমলাতন্ত্রকে জনবান্ধব করতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা।

এ বিষয়ে বড় ধরনের অগ্রগতি না হলেও নতুন পে স্কেলের উদ্যোগ নেওয়া হলো। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে হলে সেটা নেওয়া উচিত নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের, দেশের অর্থনীতির সামর্থ্য বিবেচনায় রেখে। নইলে আমলাদের চাপে অন্তর্বর্তী সরকার যেনতেনভাবে নতুন পে স্কেল বাস্তবায়ন করে দিয়ে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের পক্ষে তার চাপ সামলানো মুশকিল হয়ে যেতে পারে। এমনিতে দেশের অর্থনীতির অবস্থা সুবিধার নয়, রাজস্ব আয়ে রয়ে যাচ্ছে বিপুল ঘাটতি। এ রকম অবস্থায় নতুন পে স্কেলের উদ্যোগ কতটা সুবিবেচনা প্রসূত হলো, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

সরকারের কাছ থেকে পরিবহন ব্যবসায়ীরাও আদায় করছেন বিশেষ সুবিধা। কথা ছিল ২০ থেকে ২৫ বছরের পুরোনো বাস-ট্রাক রাস্তা থেকে তুলে দেওয়া হবে। সেটা তো হচ্ছেই না; বরং তাঁদের আরও বাড়তি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। দৈনিক সমকাল–এ প্রকাশিত খবর অনুসারে, রিকন্ডিশন্ড বাস, ট্রাক আমদানির সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব গাড়ি কেনার জন্য মালিকদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। পাশাপাশি তাঁদের আয়করের বোঝা কমানোর দিকেও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে ঋণখেলাপিরা মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। ফলে ঋণখেলাপিরা দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধে নতুন করে ১০ বছর সময় পাবেন। বিগত সরকারের আমলে সরকার ঘনিষ্ঠ বড় ব্যবসায়ীরা এ ধরনের বিশেষ সুবিধা পেতেন। এবার এই সুবিধা পাবেন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে চাপে থাকা এবং বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী।

অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যবহার করে আখের গোছানোর আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো বেসরকারি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স বাগানো। প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, এ বছরের জুন ও জুলাই মাসে এ রকম দুটি লাইসেন্স পেয়েছেন এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক মো. আরিফুর রহমান তুহিন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুর রহমান। তাঁদের টিভি চ্যানেল দুটির নাম যথাক্রমে ‘নেক্সট টিভি’ ও ‘লাইভ টিভি’। নেক্সট টিভির সঙ্গে আরও আছেন বগুড়া বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম হাফিজুর রহমানের ছেলে এ কে এম গোলাম হাসনাইন। তিনি সৌদি আরব (পূর্বাঞ্চল) বিএনপির সভাপতি। লক্ষণীয় বিষয় হলো কোনো ধরনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিগত আওয়ামী সরকারের স্টাইলে রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনায় এই লাইসেন্স দুটি দিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।

অথচ দেশে বিদ্যমান টিভি চ্যানেলগুলোই চলতে পারছে না। অনুমোদনপ্রাপ্ত টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ৫০ হলেও চালু আছে ৩৬টি। এগুলোর অধিকাংশেরই আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, দেশে বিজ্ঞাপনের বাজারও এই বিপুলসংখ্যক টিভি চ্যানেলের জন্য যথেষ্ট বিকশিত নয়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে দলীয় আনুগত্য, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থনীতি ও বাজারের চাহিদা ও সক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় লাইসেন্স দিয়ে সৃষ্ট নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুসারে গণমাধ্যম কমিশন গঠন করে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্সের পর্যালোচনা করা। সেটা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন দুটি লাইসেন্স দেওয়া হলো।

এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর লাভজনক থাকার পরেও বিদেশি কোম্পানির স্বার্থে বন্দরের মাশুল ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে সরকার। এতে দেশে আমদানি–রপ্তানির খরচ বাড়লেও লাভবান হবে ডিপি ওয়ার্ল্ড, এপিএম টার্মিনালস, পিএসএ ইন্টারন্যাশনালের মতো বিদেশি অপারেটররা। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) পরামর্শে এই মাশুল বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া—এই সাত দেশের ১৪টি বন্দরের মধ্যে ১৩টি বন্দরের মাশুলের চেয়ে চট্টগ্রামের মাশুল বেশি দাঁড়াবে।

এগুলো হলো বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর আখের গোছানোর কয়েকটি নমুনা, যেগুলো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে সংবাদমাধ্যমে এখনো প্রকাশিত না হওয়া দেশি এবং বিভিন্ন বিদেশি গোষ্ঠীর আখের গোছানোর তৎপরতা, যেগুলোর অনেক কিছু সম্পর্কে আমরা হয়তো জানি না।

অনেকেই একসময় চেয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকার যেন বেশি দিন থাকে। তাঁরা ভেবেছিলেন, অর্ন্তবর্তী সরকার যত বেশি দিন ক্ষমতায় থাকবে, ততই দেশের উপকার হবে, তত বেশি সংস্কার হবে। তাঁরা হয়তো তখন ভাবেননি, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কোনো অনিয়ম করলে তার জবাবদিহি কীভাবে আদায় করা হবে। রাজনৈতিক সরকারের মতো ভোট না দিয়ে তো এই সরকারকে শায়েস্তা করার উপায় নেই।

এখন এ রকম একটা সরকারের এক বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার ফলাফল কী দাঁড়াচ্ছে? উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে আখের গোছানো ও সেফ এক্সিট খোঁজার মতো গুরুতর অভিযোগ তোলা হয়েছে। সেই সঙ্গে অভিযোগ উঠছে অন্তর্বর্তী সরকারকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিলের। বিপুলসংখ্যক তাজা প্রাণের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের পর এ রকম একটি পরিস্থিতি তৈরি হওয়া ভীষণ দুঃখজনক।

কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

সূত্র, প্রথম আলো