নেপালে পরিস্থিতি এখন চরম উত্তপ্ত ও অগ্নিগর্ভ। জেনারেশন জেড বা ‘জেন–জি’ নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সরকারের মন্ত্রীদের যাকে যেখানে পেয়েছে বেধড়ক পিটিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।

বিক্ষোভকারীরা অগ্নিসংযোগ করেছেন জাতীয় সংসদ ভবনের অংশ, সিংহদরবার সচিবালয়, মন্ত্রিপরিষদের আবাসন এলাকা এবং ইউনিফায়েড মার্কসবাদী পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই প্রতীকী আগুন গণতন্ত্রের ব্যর্থতা, রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতি এবং রাষ্ট্রীয় অকার্যকারিতার বিরুদ্ধে এক প্রজন্মের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

নেপালে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘জেন-জি’ আন্দোলন পুরো দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য এক সতর্কবার্তা। ২০২৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সরকার যখন হঠাৎ করে ২৬টি জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেয়, তখন তরুণেরা সেটিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখেন।

এর আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ‘নেপো বেবি’ ট্রেন্ড রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানদের অযাচিত সুযোগ-সুবিধা ও সম্পদের চিত্র প্রকাশ করে, যা দুর্নীতি ও নেপোটিজমের প্রতি তরুণদের ক্ষোভকে আরও ঘনীভূত করে। যদিও আন্দোলনের তাৎক্ষণিক সূত্রপাত এই ডিজিটাল ব্যান থেকে, কিন্তু এর শিকড় অনেক দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি এবং অকার্যকর শাসনব্যবস্থায়।

২০০৮ সালে নেপাল তার শতাব্দীপ্রাচীন রাজতন্ত্র বিলোপ করে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। সেই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মুহূর্তে জনগণের মনে জেগে উঠেছিল সমতা, সমৃদ্ধি এবং উন্নত জীবনের স্বপ্ন—নতুন কর্মসংস্থান, মানসম্পন্ন সরকারি সেবা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাত্রার প্রত্যাশা। মানুষ বিশ্বাস করেছিল, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথ সুগম করবে, দারিদ্র্য দূর করবে এবং একটি শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলবে।

কিন্তু গত দুই দশকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতির বিস্তার এবং স্বজনপ্রীতির সংস্কৃতি এই প্রত্যাশাগুলোকে বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশা ও বাস্তবতার মধ্যকার ব্যবধান আজ এতটাই প্রকট যে তা তরুণদের মধ্যে গভীর হতাশা ও আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছে।

২০০৭ সালে নেপাল একটি অন্তর্বর্তী সংবিধান গ্রহণ করে, যা ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পথপ্রদর্শক ছিল। ২০০৮ সালে কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় স্তরে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের সংবিধান নারীদের, দলিত ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে, যা বিশ্বের অন্যতম প্রগতিশীল সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত। সংবিধান সামাজিক ন্যায়বিচার, দারিদ্র্য বিমোচন এবং অসমতা দূরীকরণের প্রতিশ্রুতি বহন করেছিল।

২০০৮ সালের প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পর থেকে মাত্র ১৬ বছরে নেপালে ১৩টি সরকার ক্ষমতায় এসেছে। দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া মূল তিনটি রাজনৈতিক দল হলো মাওবাদী কেন্দ্র, সিপিএন-ইউএমএল এবং নেপালি কংগ্রেস। এ দলগুলো ক্ষমতার লড়াই ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অতিরিক্ত জড়িয়ে পড়েছে। নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি এবং জনগণের চাহিদা বাস্তবায়নের পরিবর্তে তারা কৌশলগত জোট গঠন এবং ক্ষমতা ধরে রাখার দিকে বেশি মনোযোগী হয়েছে।

এর ফলে প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্প স্থগিত হয়েছে এবং দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুবসমাজের মধ্যে হতাশা জমে গেছে আর এই হতাশা আজকের আন্দোলনের মূল ইন্ধন হিসেবে কাজ করছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিস্তার। সরকারি পদে নিয়োগ, প্রকল্প বরাদ্দ এবং অর্থ বিতরণ প্রায়ই ব্যক্তিগত বা পার্টি স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দুর্নীতির কারণে নেপাল বছরে প্রায় ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হারায়। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ও জনসেবা প্রায়ই তহবিল অপব্যবহারের কারণে স্থবির হয়ে যায়।

উদাহরণস্বরূপ, সুদূর পশ্চিম প্রদেশে ৫০ লাখ নেপালি রুপির সেচ প্রকল্প আজও শুরু হয়নি; অভিযোগ উঠেছে যে তহবিল জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ হয়েছে। ২০১৭ সালে নেপাল এয়ারলাইনস দুটি এ৩৩০ জেট কেনার মাধ্যমে প্রায় ১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন রুপি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পাঁচ বছর ধরে তদন্ত চললেও কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এই ধরনের দায়মুক্তি এবং দুর্নীতির সংস্কৃতি জনমনে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের প্রতি আস্থা হ্রাস করেছে। বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে আস্থা হারাচ্ছেন। বিশেষ করে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, যেমন ৭৫০ মেগাওয়াটের ওয়েস্ট সেতি এবং ১২০০ মেগাওয়াটের বুঢ়ি গন্ডকি, রাজনৈতিক কারণে বাতিল বা পুনর্বণ্টিত হয়েছে। এর ফলে দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

তবে উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতি সত্ত্বেও নেপাল তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। ১৯৯১ সালে যেখানে সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ, তা ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশে। একইভাবে, দারিদ্র্যের হার ২০১০ সালের ২৫ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে কমে এসেছে ২০ দশমিক শূন্য শতাংশে, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক অগ্রগতি।

কিন্তু এই সামাজিক অর্জনগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল শাসন এবং দীর্ঘস্থায়ী দুর্নীতির কারণে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়নে রূপ নিতে পারেনি। ২০২৩ সালে নেপালের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড় প্রবৃদ্ধির তুলনায় অনেক নিচে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা স্থবির, শিল্প খাতে বিনিয়োগের ঘাটতি প্রকট এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার অপর্যাপ্ত। ফলে জনগণের একটি বড় অংশ উন্নত জীবনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

নেপালে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো এবং বিনিয়োগের ঘাটতি অর্থনীতিকে স্থবির করে তুলেছে, যার অন্যতম প্রতিফলন হচ্ছে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব। ২০১৭–১৮ অর্থবছরে মোট বেকারত্বের হার ছিল ১১ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০২২–২৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১২.৬ শতাংশে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক চিত্র দেখা যায় তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে, ১৫–২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২০১৭–১৮ সালে ছিল ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ, যা সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালে কিছুটা কমে ২০ দশমিক ৮২ শতাংশ হয়েছে। তবু এটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম উচ্চ হার হিসেবে রয়ে গেছে।

এই সীমিত কর্মসংস্থান, ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দক্ষতা উন্নয়নের অভাব তরুণদের বিদেশে কর্মসংস্থানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন নেপালি বিদেশে কর্মরত, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ জনগোষ্ঠী।

বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক শিক্ষা

বাংলাদেশে বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। একদিকে একটি রাজনৈতিক শক্তি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (পিআর) পদ্ধতি চালুর দাবি তুলছে, অন্যদিকে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন, এটি রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়াতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী নেপালের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে।

বাংলাদেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বিতর্ক নেপালের অভিজ্ঞতার আলোকে সতর্কতার সঙ্গে দেখা উচিত। অন্তর্ভুক্তি জরুরি, কিন্তু যদি তা রাজনৈতিক অস্থিরতা ডেকে আনে, তাহলে উন্নয়ন ও সুশাসন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

নেপালের অভিজ্ঞতা আমাদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। প্রথমত, অন্তর্ভুক্তিকে অস্বীকার করা যায় না। গণতন্ত্রে প্রতিনিধিত্বমূলক বৈচিত্র্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে যদি পিআর পদ্ধতি চালু হয়, তবে ছোট দলগুলোর সংসদে প্রবেশ সহজ হবে। এর ফলে একদিকে রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ঘটবে; কিন্তু অন্যদিকে সরকার গঠনে জোটনির্ভরতা এবং নীতিগত অনিশ্চয়তা বাড়ার আশঙ্কা থাকবে।

আরও পড়ুন

গণ–অভ্যুত্থানে বাংলাদেশ–নেপালে যে ৫টি জায়গায় বিস্ময়কর মিল

১৭ ঘণ্টা আগে

গণ–অভ্যুত্থানে বাংলাদেশ–নেপালে যে ৫টি জায়গায় বিস্ময়কর মিল

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি এই জটিলতা সামলাতে প্রস্তুত? সরকার যদি ঘন ঘন পরিবর্তিত হয়, তবে রাষ্ট্রযন্ত্র অকার্যকর হয়, উন্নয়ন প্রকল্পে ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়, নীতি বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটে এবং সাধারণ মানুষের আস্থা ক্ষয় পায়।

সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, কেবল একটি প্রগতিশীল সংবিধান বা বিকেন্দ্রীকরণ কাঠামো দিয়েই কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। টেকসই গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন, দক্ষ নীতি বাস্তবায়ন, জবাবদিহি ও প্রশাসনিক সক্ষমতা।

এগুলো অনুপস্থিত হলে গণতন্ত্র জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় এবং ধীরে ধীরে হতাশা ও অস্থিরতার জন্ম দেয়। তাই বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি হলো, গণতন্ত্রকে নির্বাচনী বিতর্কের মধ্যে আটকে না রেখে বাস্তবায়নযোগ্য, কার্যকর, অংশগ্রহণমূলক এবং জবাবদিহিমূলক শাসনে রূপান্তর করা।

গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তরুণদের আস্থার ওপর। নেপালের তরুণেরা যে ক্ষোভ প্রকাশ করছে, তা কেবল রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে নয়—এটি রাষ্ট্রের কার্যকারিতা, সুশাসন এবং ভবিষ্যতের প্রতি ভেঙে পড়া বিশ্বাসের বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রতিবাদ।

বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা স্পষ্ট; তরুণদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে শাসনব্যবস্থাকে হতে হবে দক্ষ, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক। শুধু গণতন্ত্রের কাঠামো থাকলেই যথেষ্ট নয়, তার প্রাণশক্তি নিহিত জনগণের আস্থা, অংশগ্রহণ এবং ভবিষ্যতের প্রতি বিশ্বাসে। বাংলাদেশের তরুণদের আস্থা অর্জন করতে হলে, সরকারকে শুধু প্রতিশ্রুতি নয়—কার্যকর, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং জবাবদিহিমূলক শাসন নিশ্চিত করতে হবে।

ড. গোলাম রসুল অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা।

মতামত লেখকের নিজস্ব

সূত্র, প্রথম আলো