যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে জিনিয়াস অ্যাক্ট নামের একটি বড় ধরনের ডিজিটাল মুদ্রা আইন পাস করেছে। ক্ল্যারিটি অ্যাক্ট নামের আরও একটি আইন প্রতিনিধি পরিষদে পাস হয়েছে। এর ফলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায় বলতে গেলে, দেশটি ‘বিশ্বের ক্রিপ্টো রাজধানী’ হতে পারে। কিন্তু যাঁরা এ নতুন আইন নিয়ে উচ্ছ্বসিত, তাঁদের সতর্ক হওয়া দরকার।
ক্রিপ্টো ব্যবসার মালিকেরা অনেক অর্থ রাজনীতিবিদদের অনুদান দিয়েছেন। এ অনুদানের কারণে তাঁরা বড় ধরনের প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। তাই এখন জিনিয়াস অ্যাক্ট আর ক্ল্যারিটি অ্যাক্ট নামের যে নতুন আইন আসছে, সেগুলো আসলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বানানো হয়নি; বরং যাতে সরকার কড়াকড়ি নিয়ম চাপাতে না পারে, সে জন্য এই আইন বানানো হয়েছে।
ফলে কী হবে? প্রথমে এই খাত খুব দ্রুত বাড়বে, সবাই মুনাফা করতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। কিন্তু যেহেতু সঠিক নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই হঠাৎই পুরো বাজার ভেঙে পড়তে পারে, অর্থাৎ একসময় অত্যধিক উত্থান হবে, আবার একসময় হঠাৎ পতন হবে।
ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক বাজারের অন্যতম বড় সুবিধা ছিল তুলনামূলক বেশি স্বচ্ছতা। ফলে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি ভালোভাবে বুঝতে পারেন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু আর্থিক খাতে উদ্ভাবনের অর্থ হলো ঝুঁকি কেবল ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীর জন্য নয়, পুরো আর্থিক ব্যবস্থার জন্য। তাই আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য হলো পুরো ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত রাখা। তবে গত ২০০ বছরে তারা কিছু মারাত্মক আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীনও হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ১৯২৯ সালের শেয়ারবাজার ধস, যা গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দার সূচনা ঘটায়।
জিনিয়াস অ্যাক্ট ‘স্টেবলকয়েন’ নামে এক নতুন ধরনের ডিজিটাল সম্পদের জন্য কাঠামো তৈরি করছে। স্টেবলকয়েন হলো এমন একটি ডিজিটাল মুদ্রা, যা দাবি করে এর মূল্য সব সময় নির্দিষ্ট একটি প্রচলিত মুদ্রা বা পণ্যের সঙ্গে স্থির থাকবে, বিশেষ করে ডলারের সঙ্গে এর মান স্থির থাকবে। স্টেবলকয়েন মূলত সক্রিয় ক্রিপ্টো বিনিয়োগকারীদের জন্য উপকারী। কারণ, এতে তাঁরা প্রচলিত (নন-ক্রিপ্টো) আর্থিক ব্যবস্থার ঝামেলায় না পড়ে সহজেই এক ক্রিপ্টো সম্পদ থেকে অন্যটিতে যেতে পারেন। কেবল বিনিয়োগকারীরাই নন, ওয়ালমার্ট কিংবা অ্যামাজনের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানও হয়তো এ ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহী হবে, যাতে তারা প্রচলিত পেমেন্ট সিস্টেম এড়িয়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সত্যিই ক্রিপ্টোর ‘বিশ্বরাজধানী’ হয়ে উঠবে। এতে কিছু ধনী আরও বেশি ধনী হবেন। কিন্তু কংগ্রেস যেভাবে ক্রিপ্টো ব্যবসায়ীদের ইচ্ছেমতো সব করছে, তাতে সাধারণ যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এবং পুরো বিশ্ব অর্থনীতি ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়বে। আবারও বড় ধরনের আর্থিক আতঙ্ক, ব্যাপক চাকরি হারানো আর অসংখ্য মানুষের সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
স্টেবলকয়েন কোম্পানিগুলোকে ব্যাংকের মতো ভাবতে পারেন। তারা নিজেদের ডিজিটাল মুদ্রা বাজারে ছাড়ে। যাঁরা এই মুদ্রা কেনেন, কোম্পানিকে তাঁদের কোনো সুদ দিতে হয় না। ফলে কোম্পানির হাতে যে টাকা জমা হয়, সেটা তারা বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করে মুনাফা করার চেষ্টা করে।
কিন্তু সমস্যা হলো বেশি লাভের লোভে তারা নিরাপদ খাতের বদলে ঝুঁকিপূর্ণ খাতেও টাকা ঢালতে পারে। এতে যদি বিনিয়োগ ব্যর্থ হয়, তাহলে বড় ক্ষতি হবে। ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। কারণ, অনেক সময় এসব কোম্পানি যেসব রাজ্য থেকে অনুমতি নেয়, সেখানে নিয়মকানুন তুলনামূলকভাবে ঢিলেঢালা থাকে। তাই নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হলে সমস্যা আরও বড় আকার নিতে পারে।
মূলত জিনিয়াস অ্যাক্টের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো এটি স্টেবলকয়েন নিয়ে সম্ভাব্য ‘দৌড়’ বা আতঙ্কজনক ভাঙন (রান) ঠেকাতে কার্যকর কোনো সমাধান দেয় না। কারণ, এই আইন নিয়ন্ত্রকদের শক্তিশালী মূলধন, তারল্য বা অন্যান্য নিরাপত্তার শর্ত আরোপ করতে বাধা দেয়। প্রশ্ন হলো যখন কোনো স্টেবলকয়েন কোম্পানি (দেশি হোক বা বিদেশি) সমস্যায় পড়বে, তখন কে এগিয়ে আসবে? কার হাতে থাকবে সে ক্ষমতা যে সমস্যা ছড়িয়ে পুরো অর্থনীতিকে ১৯৩০-এর দশকের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেবে না?
যদি কোনো স্টেবলকয়েন কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যায়, তখন দেউলিয়া আইন প্রয়োগ করলে বিনিয়োগকারীদের তার জন্য অনেক মূল্য দিতে হবে। তাঁদের অর্থ ফেরত পেতে অনেক দেরি হবে। তা ছাড়া অবশিষ্ট টাকাও খুব কম পাওয়া যাবে। এতে অন্য স্টেবলকয়েন কোম্পানির ওপরও আস্থা নষ্ট হবে ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে।
যদি ক্ল্যারিটি অ্যাক্ট নামে আইনটি সিনেটে পাস হয়ে যায়, তাহলে এমন কিছু কাজ আবার বৈধ হয়ে যাবে, যা ১৯২০-এর দশকের পর থেকে আর অনুমোদিত হয়নি। যেমন নিজেদের স্বার্থে ভেতরে–ভেতরে কারসাজি করা বা স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়ে পড়া।
যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সত্যিই ক্রিপ্টোর ‘বিশ্বরাজধানী’ হয়ে উঠবে। এতে কিছু ধনী আরও বেশি ধনী হবেন। কিন্তু কংগ্রেস যেভাবে ক্রিপ্টো ব্যবসায়ীদের ইচ্ছেমতো সব করছে, তাতে সাধারণ যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এবং পুরো বিশ্ব অর্থনীতি ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়বে। আবারও বড় ধরনের আর্থিক আতঙ্ক, ব্যাপক চাকরি হারানো আর অসংখ্য মানুষের সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
সাইমন জনসন ২০২৪ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ