এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা অনেক ডিফিকাল্টির মধ্যে আছি।’ এই ‘ডিফিকাল্টি’র পেছনে আসলে কী কাজ করছে তা তাদের খুঁজে বের করতে হবে।

ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে এনসিপির এখনকার লক্ষ্য কী? বাকি ফ্যাসিবাদীদের খুঁজে খুঁজে বের করা? কোথাও যদি ‘মুজিববাদ’–এর নিশানা দেখা যায়, তাকে ধ্বংস করা? জুলাই আন্দোলনকে প্রলম্বিত করে আন্দোলনকে চালিয়ে যাওয়া? যদি এগুলোই তাদের লক্ষ্য হয়, তবে কি তারা ঠিক পথে চলছে?

অর্পিত ম্যান্ডেট অতিক্রম করলে লক্ষ্য হারিয়ে যায় এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ঠিক এই জিনিসটাই হয়েছে গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জনসভায়। ‘জুলাই পদযাত্রা’ গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রে কেন ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ হয়ে গেল? এটি করে বিনা কারণে ভিমরুলের বাসায় ঢিল ছোড়া হলো। সেনাবাহিনীকে পুলিশি কাজে জড়িয়ে তাদের বন্দুক ছুড়তে হলো। দুঃখের কথা হলো আমাদের দেশের পাঁচজন লোক গুলিতে প্রাণ হারালেন।

তবে সবাই কী দুঃখিত? দিল্লি, লন্ডন, কলকাতা ও নয়াপল্টনে অনেকে তাঁদের জনসংযোগ যন্ত্র খুলে বসেছেন। আওয়ামী লীগাররা বিদেশে বসে মৃতের সংখ্যা গুনছেন—পাঁচজন হলো, আর কয়জন লাগবে?

বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ ‘বাবারা’ সম্বোধন করে এনসিপিকে বলেছেন, গোপালগঞ্জের ঘটনার দায় দলটির রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার।

এনসিপি নেতারা বলছেন, ‘সামনে আরও বড় লড়াইয়ের দিন আসছে।’ তাঁরা মনে হয় ‘লড়াইয়ের’ প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং শত্রু খুঁজছেন। কিন্তু কী লড়াই এবং কিসের লড়াই?

এর মধ্যে বিএনপি খালি মাঠে নির্বাচনী বলটা অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। জামায়াত নেতারাও মুচকি হেসে তাঁদের মনোনয়নের লিস্টে বারবার চোখ বুলাচ্ছেন। এখন বিএনপির একমাত্র চিন্তা—এসব গন্ডগোলে না জানি নির্বাচন পিছিয়ে যায়! এর সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা।

একটা গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন হলো সফলতার মাপকাঠি। একটা দেশ বা একটা দল সফলতার জন্য বারবার আন্দোলনে ফিরে যেতে পারে না। এনসিপিকে বুঝতে হবে, তারা একটা নতুন দল। সামনেই নির্বাচন। এই নির্বাচনে তারা যদি একটা ভালো ফুট-প্রিন্ট না রাখতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। তাদের ভুলগুলো তাদের বুঝতে হবে এবং শোধরাতে হবে।

জুলাই আন্দোলনের ম্যান্ডেটের বাইরে যাওয়া

এনসিপি নেতারা কি জুলাই আন্দোলনের ম্যান্ডেটের সীমারেখা বুঝতে পেরেছিলেন? তাঁরা কি নিজেদের মতো করে ম্যান্ডেটটাকে বাড়াচ্ছেন?

আন্দোলনটা শুরু হয় কোটা আন্দোলন নিয়ে। দেশের তরুণেরা দারুণভাবে ক্রোধান্বিত ছিলেন কোটাকে যেভাবে শেখ হাসিনা রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তরুণদের চাকরির ক্ষেত্র সংকুচিত করছিলেন। হাসিনা তরুণদের ডাক শুনলেন না। তখন তাঁরা শুরু করলেন ‘হাসিনা খেদাও’ আন্দোলন। দেশের আপামর মানুষ তাতে যোগ দিল; কারণ হাসিনার ১৫ বছরের একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসন নিয়ে মানুষ ছিল বীতশ্রদ্ধ ও আতঙ্কিত।

জুলাই আন্দোলনের একমাত্র ম্যান্ডেট ছিল ফ্যাসিবাদকে তাড়িয়ে দেশে একটা নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু নেতারা যে যেমন পারেন নিজেদের এজেন্ডা তৈরি করে আন্দোলনের ম্যান্ডেটটাকে সম্প্রসারিত করতে লাগলেন।

তাঁরা একসময় এটাকে ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করে দ্বিতীয় রিপাবলিক বানাতে চাইলেন। কেউ বললেন একাত্তরের স্বাধীনতার রিসেট, কেউ চাইলেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা, কারও চাওয়া ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। অন্যরা ‘মুজিববাদ’ তাড়াতে মাঠে নামলেন।

তাদের বুঝতে হবে, জনগণ কী চায়। একটা আন্দোলন অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে না। ম্যান্ডেটের বাইরে গেলে আন্দোলনের সুফল বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

একাত্তরের স্বাধীনতায় প্রত্যয়হীনতা

গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণেরা স্বাধীনতাযুদ্ধের গুরুত্ব কমানোর পথ ধরেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ তাঁরা দেখেননি, এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য কতটা অনুধাবন করতে পেরেছেন তাঁরা সেই প্রশ্ন ওঠে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের নেতারা একাত্তরের স্বাধীনতাকে সাতচল্লিশের পাকিস্তান জন্মের একটা ধারাবাহিকতা বা বিবর্তন হিসেবে দেখেছেন।

আমাদের স্বাধীনতার নেতা খুঁজতে গিয়ে তাঁরা শেখ মুজিবকে পেছনে ফেলে অনেককে সামনে এনে বসিয়ে দিলেন। হাসিনাকে শাস্তি দিতে গিয়ে চরম শাস্তি দেওয়া হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। শেখ মুজিব তো হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা বানিয়ে উত্তরাধিকারী করে যাননি; একজন লোককে কতবার মারা যায়?

মুজিবের ছবি সব অফিস থেকে নামিয়ে ভেঙে ফেলা হলো। অ স ম আবদুর রব, যাঁর জাসদ কর্মীরা ছিলেন শেখ মুজিবের শাসনের সময়ে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত। প্রচণ্ড ভয়ংকর পরিবেশেও তিনি তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেছিলেন। কারণ, তিনি নিজেও ছিলেন স্বাধীনতার সংগঠক এবং স্বচক্ষে দেখেছেন, কে ছিলেন এই দেশের স্বাধীনতার স্থপতি।

দলের ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচিতে এনসিপির নেতা–কর্মীরা।

দলের ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচিতে এনসিপির নেতা–কর্মীরা।ছবি: প্রথম আলো

জুলাইয়ের নেতারা স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবের স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে, স্বাধীনতা–পরবর্তী শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের বাকশালি দুঃশাসন ও ব্যর্থতাকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। চরম অপমান করা হলো জাতির প্রতিষ্ঠাতাকে। সবই করা হয়েছিল একটা স্বাধীনতাবিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে।

তাই বুদ্ধিজীবী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, ‘ছাত্রদের নেতৃত্বে যে পার্টি হয়েছে, সে পার্টি ভাবছে ধর্মকে ব্যবহার করবে। সে জন্য তাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।’

১৯৬৯ সালের আন্দোলনে নাহিদের বয়সী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পাকিস্তানি ট্যাংকের সামনে চিৎকার করে স্বাধীনতার স্লোগান তুলেছিল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। তরুণেরা বন্দুক ধরে যুদ্ধ করেছেন। তাঁদের অনেকে এখনো বেঁচে আছেন।

বাংলাদেশিরা কীভাবে ভুলবে একাত্তরকে, লাখ লাখ শহীদকে এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের স্থপতিকে! সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হবে, একাত্তরের স্বাধীনতা নিয়ে বিভ্রান্তিগুলো ছিল অনভিপ্রেত এবং অপ্রয়োজনীয়। স্কুলের বই পরিবর্তন করা যায়, কিন্তু ইতিহাস তো পরিবর্তন করা যায় না।

সামনের নির্বাচনে বিএনপিই একমাত্র দল, যারা একাত্তরকে ধারণ করে নির্বাচন করবে। বিএনপি এর মধ্যে বলে দিয়েছে, ‘একাত্তর নিয়ে কোনো আপস নয়।’

আওয়ামী লীগের মধ্যপন্থী গ্রুপকে বিএনপির দিকে ঠেলে দেওয়া

সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে এনসিপির দুই নেতার আলাপচারিতার বিষয় নিয়ে কেউ অস্বীকার করেননি। বলা হয়েছে, সেনাপ্রধান আওয়ামী লীগ সমর্থক ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠী কীভাবে তাদের অভিমত প্রকাশ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন। বিষয়টাকে এনসিপির কিছু নেতা আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন হিসেবে দেখেছেন। সম্ভবত তাঁরা সেনাপ্রধানের এই কথাগুলো বুঝতে পারেননি। যদি বুঝতেন, এটা তাঁদের কাজে দিত। এই ভোটগুলো তো উবে যাবে না!

আওয়ামী লীগের যে ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে একটা অংশ হলো শেখ হাসিনার কট্টর সমর্থক, বলা যায় ‘হাসিনা গার্ড’—যাঁরা হাসিনার ১৫ বছর শাসনের সুবিধাভোগী বা যাঁরা হাসিনার উত্থানের পর আওয়ামী লীগে মুগ্ধ হয়েছেন। এর বাইরে বিরাটসংখ্যক লোক আছেন, যাঁরা শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের লোক—এঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধ দেখেছেন, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন বা নেহাতই মুজিব ভক্ত; শেখ হাসিনার সময় তাঁরা ছিলেন ঢিলেঢালা বা নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগার। তখন তাঁদের জন্য অন্য কোনো মুজিববান্ধব বিকল্প দল ছিল না।

জেনারেল মঈনের সময় তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমুসহ আরও কয়জন নেতা তাঁদের সংগঠিত করে হাসিনাবলয়ের বাইরে চলে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তোফায়েলরা যথেষ্ট সময় ও সুযোগ পাননি।

এনসিপির সুযোগ ছিল এই মধ্যপন্থী ভোটারদের কাছে টানতে। কিন্তু এনসিপি নেতারা ভোটের অঙ্ক সম্ভবত এখনো বুঝতে শেখেননি। এই মধ্যপন্থীরা ভোট দেওয়ার জন্য সম্ভবত এমন বিকল্প দল খুঁজবেন—যারা একাত্তরকে ধারণ করছেন এবং জামায়াত–বলয়ের বাইরে। কোনটা হতে পারে সেই দল? ঘটনাক্রমে গোপালগঞ্জে ‘নিরীহ নাগরিকদের’ হয়রানি না করতে আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি।

বিএনপিকে ফ্রি পাস

বদরুদ্দীন উমর এক আলোচনায় বলেছেন, ‘দুঃখজনক হচ্ছে, বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি হয়েছে, তাতে বিএনপিকে সবচেয়ে প্রগতিশীল মনে হচ্ছে। তারাই কথাবার্তা বলছে।’

তাঁর এই বক্তব্য যত না বিএনপিকে নিয়ে, তার চেয়ে বেশি বলা হয়েছে এনসিপির জন্য। তরুণদের একটা দল, যাদের সদস্যরা এত বড় একটা সফল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা কেন প্রগতিশীল হবে না? তাই তো তিনি তাঁর বক্তব্যে ‘দুঃখজনক’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে নাহিদদের হয়তো বিএনপির সঙ্গে শক্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে, নতুবা অন্য অনেক দলের মতো বিএনপি থেকে আসন চেয়ে রাজনীতিতে নিজেদের নাম টিকিয়ে রাখতে হবে।

কিন্তু এনসিপি সম্ভবত বিএনপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়েও এখনো অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সময় ও শক্তি বেশি ব্যয় করছে। তাদের কথাবার্তায় বিএনপিকে নিয়ে কোনো হোমওয়ার্ক নেই। বিএনপির দুর্বলতাগুলো তাদের জানতে হবে। অনেকের মতে, বিএনপি ফ্রি পাস পাচ্ছে।

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলবেন, বিএনপি দীর্ঘদিন এ দেশে ক্ষমতায় ছিল। দীর্ঘ ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর মতো বিএনপি শাসনের অনেক নেতিবাচক রেকর্ড আছে, আছে কাঠামোগত দুর্বলতা। এনসিপির নেতাদের বিএনপির ইতিহাস জানতে হবে। যদি তাঁরা ‘হাওয়া ভবনের’ নাম না শুনে থাকেন, তাহলে তারা বিএনপির যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী নন।

ভোটের ফলাফল যা–ই হোক না কেন, এনসিপি নেতারা অবশ্যই বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে তাঁদের সফল নেতৃত্বের জন্য। তবে একটা ভয়ও আছে—যারা ক্ষমতায় আসবেন, হয়তো পাঠ্যবইয়ে নতুন করে লিখবেন জুলাইয়ের ইতিহাস; সামনে চলে আসবেন নতুন ‘নায়কেরা’।

ইতিহাস বলে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটা আন্দোলনের নেতারা তাঁদের অর্জন নিয়ে এত বেশি আচ্ছন্ন থাকেন যে পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বে তাঁরা প্রায়ই ভুল করেন।

ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, আলজেরিয়ার বেন বেল্লাহ এবং বাংলাদেশের শেখ মুজিব—তাঁরা সবাই ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেশ পরিচালনায় তাঁদের কেউই সফল হতে পারেননি।

ভবিষ্যৎই জানান দেবে, জুলাই আন্দোলনের নেতারা দেশের পরবর্তী প্রয়োজনে কতটুকু কাজে আসবেন।

সূত্র, প্রথম আলো