বেইজিংয়ে জাঁকালো সামরিক কুচকাওয়াজে চীনের সি চিন পিং, রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার কিম জং–উনকে পাশাপাশি হাঁটতে দেখে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম প্রতিক্রিয়াটা যে তার নিজকেন্দ্রিক হবে, সেটি অনুমেয় ছিল। এই সংহতি ও শক্তিমত্তার প্রদর্শনীকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ বলে অভিযোগ করেছেন।

ট্রাম্প সামরিক কুচকাওয়াজ পছন্দ করেন, কিন্তু সেটা তাঁর নিজের হতে হবে। ট্রাম্প যখন মঞ্চে ওঠেন, তখন নিজেকে সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখতে বেশি পছন্দ করেন। নিজেকে তিনি ভাবতে চান বিশ্বের ১ নম্বর নেতা বলে। তাই এ সপ্তাহে বেইজিং থেকে আসা ছবিগুলো তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানায়।

ট্রাম্পের এই অহংবোধ ফুটো হয়ে যাওয়ায় সি চিন পিং নিশ্চয়ই ভীষণ খুশি হয়েছেন। জানুয়ারি মাস থেকে চীন নিয়ে ট্রাম্পের আচরণ কখনো আক্রমণাত্মক, কখনো প্রতিহিংসাপরায়ণ, আবার কখনো তাচ্ছিল্যপূর্ণ। বিশেষ করে ট্রাম্পের আরোপ করা শাস্তিমূলক বাণিজ্য শুল্ক নজিরবিহীন অস্থিরতা তৈরি করেছে।

ট্রাম্প খুব অস্পষ্টভাবে চীনকে সামনাসামনি বৈঠকে বসার প্রস্তাব দিয়েছেন, যেন তিনি খুব বিরল কোনো উপহার দিচ্ছেন। বেইজিংয়ে তিন শাসকের জোটের এই কুচকাওয়াজই ছিল ট্রাম্পের মুখের উপর স্পষ্ট জবাব।

রেড স্কয়ারের মানদণ্ডে হলেও চীনের রাষ্ট্রপতির এই বাড়াবাড়ি রকমের জাঁকালো সামরিক প্রদর্শনীটি ছিল দৃষ্টিনন্দন। জাতীয় সংগীত, নিখুঁত ছন্দে কুচকাওয়াজ, ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি এমনকি ৮০ হাজার কবুতর ওড়ানো—সবকিছুই ছিল ওয়াশিংটনের সঙ্গে সামরিক সমতার পথে চীন যে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, তারই প্রদর্শন।

পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে মোতায়েন করা মার্কিন নৌবাহিনীর জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ হলো, চীনের হাতে এখন সুপারসনিক, পারমাণবিক সক্ষম ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং পানির নিচে চলতে সক্ষম ড্রোন রয়েছে। সি ঘোষণা দিলেন, চীন ‘অপ্রতিরোধ্য’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিকে স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘মানবজাতিকে আবারও শান্তি অথবা যুদ্ধ, সংলাপ অথবা সংঘর্ষ, দুই পক্ষের জয় অথবা শূন্য ফলাফল—এর মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়ার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

এটি অব্যর্থভাবে ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে ছুড়ে দেওয়া সতর্কবার্তা। তিনি সেটি মেনে নেবেন কি না, সেটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।

চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার শাসকত্রয়ীর মধ্যে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই নেই। এটা সারা বিশ্বের জন্যই চিন্তার বিষয়। সি, পুতিন ও কিমের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী-মূল্যবোধহীন ট্রাম্পকে দেখলে বাইবেলের সেই প্রলয়–সংক্রান্ত চার অশ্বারোহী—জয়, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যুর দৃশ্যকল্পই সামনে আসে।

রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক এই জাঁকালো প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে সি চিন পিং ভবিষ্যৎ বিশ্বে চীন কীভাবে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করবে, সেটি দেখাতে চেয়েছেন। সি চিন পিং এটি নিজের মতো করে কল্পনা ও পরিকল্পনা করেছেন। ২০১২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষে ওঠার পর থেকে সি এই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। মাও সে–তুংয়ের পর যেকোনো নেতার চেয়ে বেশি ক্ষমতা তিনি কেন্দ্রীভূত করেছেন।

অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান, সম্পত্তি সংকট ও দুর্নীতি—এসব বিষয়ে সি চিন পিংয়ের নীতির সমালোচনা হয়েছে নানা সময়ে। তাতে করপোরেট প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যম, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর আরও কঠোর বিধিনিষেধ এসেছে। নজরদারি রাষ্ট্র হিসেবে চীন নিঃসন্দেহে বিশ্বের শীর্ষে। সির বিদেশনীতি (বিশেষ করে তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চল ঘিরে) অত্যন্ত সম্প্রসারণবাদী।

প্রথমে সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সবচেয়ে বড় সম্মেলন, এরপর বেইজিংয়ে বিভিন্ন দেশের নেতাদের একত্র করে সি চিন পিং এমন একটি বার্তা দিলেন, যা হোয়াইট হাউসের বাইরে অনেক দূর পর্যন্ত প্রভাব ফেলবে। তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ইরানসহ অনেক দেশ চীনের ক্ষমতার প্রতি সম্মান দেখাল।

ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে ক্ষুব্ধ হলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও চীনের সঙ্গে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব কমিয়ে অংশ নিলেন। এসসিওর যৌথ ঘোষণা একটি নতুন বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার স্বীকৃতি দিল, যা ১৯৪৫ সালের পরের বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে। একুশ শতকে চীন বিশ্বের প্রধান শক্তি হয়ে উঠবে, এই প্রদর্শনী ছিল সি চিন পিংয়ের সেই দৃষ্টিভঙ্গির সর্বশেষ প্রকাশ।

ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হওয়াটা মোটেও অদ্ভুত কোনো বিষয় নয়। ট্রাম্প তাঁর বন্ধু ও শত্রু—দুই পক্ষকেই বোকার মতো ও উসকানিমূলকভাবে বিরক্ত করেছে। তার এই নব্য ঔপনিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গির রণে অনেক দেশ চীনের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে কেউই ঘোরতরভাবে দ্বিমত করবেন না। তবে বেইজিংয়ের এই তিন শাসকের জোট দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকবে এবং একটি গঠনমূলক ও শান্তিপূর্ণ সহযোগিতার পথ খুঁজে পাবে, সেটি নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে।

এই মুহূর্তে পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সি চিন পিংয়ের সহায়তার ওপর নির্ভর করছেন; কিন্তু চীনের সম্প্রসারণবাদের প্রতি বরাবরই চীনের একটি গভীর ভয় রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার কিমও চীনের আধিপত্য নিয়ে ভয় করেন। আবার পুতিন ও সি দুজনের বয়স এখন সত্তরের কোঠায়; তাঁরা চিরকাল ক্ষমতায় থাকবেন না। তাঁদের শাসন অত্যন্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তাঁদের অনুপস্থিতিতে দুটি দেশেই ক্ষমতার শূন্যতা দেখা দিতে পারে। বর্তমানে দমন করা হলেও ভবিষ্যতে বিক্ষোভ বা অসন্তোষের বিস্ফোরণের আশঙ্কা ব্যাপক।

এই জোট মূলত সুবিধাবাদী। এখানে কোনো আদর্শ বা নৈতিক ভিত্তি নেই। আমেরিকার প্রাধান্য, ডলারের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত পশ্চিমা অর্থনীতি এবং মানবাধিকার–সংক্রান্ত ‘অপ্রীতিকর’ মানদণ্ডের বিরুদ্ধে একত্রিত। তাঁরা স্বৈরাচারী ও গণতন্ত্রবিরোধী।

১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ ও বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা গড়ার সময় পশ্চিমা শক্তিগুলো ঠিক করেছিলেন—দুই বিশ্বযুদ্ধের বিপর্যয় পুনরায় ঘটতে দেবেন না।

চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার শাসকত্রয়ীর মধ্যে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই নেই। এটা সারা বিশ্বের জন্যই চিন্তার বিষয়। সি, পুতিন ও কিমের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী-মূল্যবোধহীন ট্রাম্পকে দেখলে বাইবেলের সেই প্রলয়–সংক্রান্ত চার অশ্বারোহী—জয়, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যুর দৃশ্যকল্পই সামনে আসে।

সাইমন টিসডাল দ্য গার্ডিয়ান–এর পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশ্লেষক

গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

সূত্র, প্রথম আলো