নিজের জনগণকে ৬৭০ দিনের বেশি সময় ধরে ধ্বংস হতে দেখার বেদনা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। এত কষ্ট, এত অপরাধের সাক্ষী হওয়ার পরও গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আরেক দফা ইসরায়েলি হামলার কথা ভাবা পর্যন্ত কল্পনার বাইরে। অথচ বিশ্বের চোখের সামনেই এটি হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ব কি শুধু দাঁড়িয়ে দেখে যাবে?

ইসরায়েলের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভা গাজায় এই নতুন হামলার ঘোষণা দিয়েছে। গাজা উপত্যকাকে ‘সম্পূর্ণ দখল’ করার জন্যই তারা সেখানকার জনবসতিগুলোয় হামলা চালানোর পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। এ হামলা শুরু হবে গাজা সিটি থেকেই। এর ফলাফল অনুমান করা কঠিন নয়।

২০২৪ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক সতর্কবার্তা ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) নির্দেশ অমান্য করে ইসরায়েল রাফা এলাকায় হামলা চালায়। আজ রাফার কোনো অস্তিত্ব নেই। এরপর ২০২৪ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে তারা উত্তর গাজার বেইত লাহিয়া, বেইত হনুন ও জাবালিয়া শহরে হামলা চালিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে দেয়।

সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালন এ অভিযানকে বলেছেন ‘জাতিগত নিধন’। এরপর ইসরায়েল একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ভেঙে ফেলে, ২০ লাখ বেঁচে থাকা মানুষকে অনাহারে রাখে এবং দক্ষিণের খান ইউনিস শহর ধ্বংস করে দেয়। এসব কাজ ২০২৪ সালের জানুয়ারি, মার্চ ও মে মাসে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের দেওয়া তিনটি গণহত্যাবিরোধী রায়ের সরাসরি লঙ্ঘন।

জানুয়ারিতে আদালত গাজায় গণহত্যার ঝুঁকি আছে বলে জানান এবং তা ঠেকাতে কিছু ব্যবস্থা নিতে বলেন। এর মধ্যে ছিল গাজায় মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু দেখা গেল, ইসরায়েল এই নির্দেশ মানছে না। গাজা সিটিতে হামলা হলে তা এই গণহত্যা অভিযানের শেষ ধাপ হবে।

যুক্তরাজ্যের মতো পশ্চিমা দেশগুলো গত দুই বছরে ইসরায়েলের গণ–অত্যাচারের সহযোগিতার দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবে না। ইসরায়েলকে জবাবদিহি থেকে মুক্তি দিয়ে এবং এই দুষ্ট রাষ্ট্রকে অস্ত্র সরবরাহ করে পশ্চিমারা এই অপরাধগুলোকে সম্ভব করেছে। সম্প্রতি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার যে ঘোষণাগুলো এসেছে, তা কেবল প্রচারমূলক চাল ও মনোযোগ সরানোর কৌশল।

৭ অক্টোবরের পরপরই ইসরায়েলের নেতা, রাজনীতিক, সামরিক কমান্ডার ও সেনারা প্রকাশ্যে বলেছিলেন, তাঁরা গাজাকে ধ্বংস করে দেবেন, পুড়িয়ে দেবেন এবং সমতল করে দেবেন। তাঁরা ঠিক সেটাই করেছেন। তাঁরা গাজার ৯০ শতাংশ এলাকা কার্যত ধ্বংস করে এটিকে জনমানবহীন মরুভূমিতে পরিণত করেছেন। বাকি জনসংখ্যাকে ঠাসা অবস্থায় মাত্র ১২ শতাংশ এলাকায় গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। সেখানে মানুষের বেঁচে থাকার মতো কোনো পরিবেশ নেই। অবরোধ আর বোমাবর্ষণের মাধ্যমে ইসরায়েল গাজায় কোনো নিরাপদ জায়গা রাখেনি। বাইরে যাওয়ারও কোনো পথ রাখেনি।

এখন গাজা সিটি, দেইর আল-বালাহ বা আল-মাওয়াসির বাকি জনবসতিতে হামলার মানে হবে নতুন গণহত্যা, আরও ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি এবং অবশিষ্ট অনাহারগ্রস্ত মানুষকে সরাসরি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। এর মানে ইসরায়েল আসলে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ গড়ার মেসিয়ানি কল্পনা ও অপরাধমূলক প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে—ইসরায়েলের লক্ষ্য ‘সর্বোচ্চ পরিমাণ জমি, সর্বনিম্নসংখ্যক আরব’।

পশ্চিম তীরে চলমান জোরপূর্বক উচ্ছেদ কার্যক্রমে এবং গাজাকে পুনর্বাসনের (অর্থাৎ ইহুদি বসতি স্থাপনের) দাবিতেই ইসরায়েলের এই লক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজাকে হামাসের হাত থেকে মুক্ত করতে চান না। তিনি চান গাজাকে ফিলিস্তিনি জনগণশূন্য করে দিতে।

২০২৪ সালের জানুয়ারির শুরুতেই জাতিসংঘ বলেছিল, গাজা এখন আর মানুষের বসবাসের উপযোগী নয়। একই বছরের নভেম্বরের শুরুতে ইসরায়েলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গালান্ট (যিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযুক্ত) বলেছিলেন, গাজায় সেনাবাহিনীর করার মতো আর কিছুই বাকি নেই। যদি সত্যিই তা–ই হয়, তাহলে সেই সময় থেকে ইসরায়েলি সেনারা গাজায় আসলে কী করছেন?

নেতানিয়াহু যখন বলছেন ‘গাজা থেকে কোনো হুমকি থাকবে না’, তখন তার আসল মানে কী, সেটা বুঝতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে মন্ত্রিসভা এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে গাজায় ফাতাহ-নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কোনো অংশগ্রহণ না থাকে। এটা হামাস নির্মূল বা কোনো সামরিক লক্ষ্য নিয়ে করা হচ্ছে না। আসল কথা হচ্ছে, এটি একটি গণহত্যার মতো অভিযান, যার লক্ষ্য ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা চরমভাবে নাকচ করা এবং গোটা অঞ্চলে ইহুদি আধিপত্য কায়েম করা।

যুক্তরাজ্যের মতো পশ্চিমা দেশগুলো গত দুই বছরে ইসরায়েলের গণ–অত্যাচারের সহযোগিতার দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবে না। ইসরায়েলকে জবাবদিহি থেকে মুক্তি দিয়ে এবং এই দুষ্ট রাষ্ট্রকে অস্ত্র সরবরাহ করে পশ্চিমারা এই অপরাধগুলোকে সম্ভব করেছে। সম্প্রতি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার যে ঘোষণাগুলো এসেছে, তা কেবল প্রচারমূলক চাল ও মনোযোগ সরানোর কৌশল।

এ অবস্থায় ইসরায়েলকে থামাতে সব রাষ্ট্রকে অতি জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে, ইসরায়েলে অস্ত্র বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে, বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করে এবং ইসরায়েলি অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতকে সহযোগিতা করে ইসরায়েলকে থামানো যেতে পারে। যদি এসব পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে গাজা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে।

এখন বিশ্বের সামনে প্রশ্ন, তারা কি কোনো পদক্ষেপ নেবে, নাকি চলমান গণহত্যা নীরবে দাঁড়িয়ে দেখে যাবে?

● নিমের সুলতানি লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক ল’র রিডার (শিক্ষক)

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

সূত্র, প্রথম আলো