ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন আবার দেখা করলেন। তবে এবার জায়গাটা ছিল আলাস্কা। এই আলাস্কা একসময় রাশিয়ার ভূখণ্ড ছিল। এখানে দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মুখোমুখি হওয়া অনেকটা প্রতীকী বার্তাই বহন করে, যেন ইতিহাস ঘুরে গিয়ে আবার ঠান্ডা যুদ্ধ-পূর্ব যুগে ফিরে এসেছে।
সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও একই সঙ্গে তারা ছিল বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণকারী দুই সুপারপাওয়ার। কিন্তু এ বৈঠক কেবল অতীতের স্মৃতিচারণা নয়, এর ভেতরে আরও বড় বার্তা লুকিয়ে আছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এমন এক পোশাক পরে এসেছিলেন, যা সবার দৃষ্টি কাড়ে। তাঁর বুকজুড়ে লেখা ছিল ‘সিসিসিপি’ (সোভিয়েত ইউনিয়নের রুশ সংক্ষিপ্ত রূপ)। এটা যদি রসিকতাও হয়ে থাকে, তবু এর মধ্যে হুমকির সুর ছিল স্পষ্ট। যাঁরা লাভরভকে চেনেন, তাঁরা জানেন তিনি মজা করার মানুষ নন, আর গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ বৈঠকে কোনো খুঁটিনাটি ব্যাপার তিনি হেলাফেলা করেন না। তাই তাঁর এ পোশাকের নির্বাচন পুরোপুরিই ইচ্ছাকৃত। তিনি জানাতে চেয়েছেন, ‘মহান রাশিয়া’ আবার বিশ্বরাজনীতির শীর্ষ টেবিলে ফিরে এসেছে।
১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর পূর্ব ইউরোপের সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। কিন্তু এখন সেই অপমান কাটিয়ে ওঠা হয়েছে। সাম্রাজ্য আবার ফিরে এসেছে এবং হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার শুরু করেছে। এই ভূখণ্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইউক্রেন। সাবেক মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্ববিগনিউ ব্রেজিনস্কি ১৯৯৪ সালে বলেছিলেন, ইউক্রেন ছাড়া রাশিয়া আর সাম্রাজ্য হতে পারে না।
ট্রাম্প যখন পুতিনকে (যিনি একজন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী) মার্কিন মাটিতে বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন, তখন তিনি মূলত সেই রুশ সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকেই বৈধতা দিলেন। লাল কার্পেটে করমর্দন, একসঙ্গে লিমুজিনে যাত্রা—এসবের মাধ্যমে পুতিন গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিলেন, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাশিয়ার সর্বোচ্চ দাবিগুলো থেকে একবিন্দুও না সরেও তিনি আবার সমান মর্যাদার বিশ্বশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। ফলে তিন বছরের বেশি সময় ধরে যে কূটনৈতিক একঘরে অবস্থায় ছিলেন, তা তিনি ভেঙে ফেলতে সক্ষম হলেন।
ইউরোপকে এখন নিজের মতো করে একটি শক্তিশালী বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত হতে হবে। এর জন্য দ্রুত ও উদ্যমের সঙ্গে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। মহাকাশ, গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুরো ডিজিটাল খাতের মতো বিভিন্ন খাতে তাদের একলা চলতে হবে।
এই বৈঠক ইউক্রেনের জন্যও খুব স্পষ্ট এক বার্তা দিল। ইউক্রেনকে বার্তা দেওয়া হলো, দেখো, মার্কিন প্রেসিডেন্টও মেনে নিয়েছেন যে রুশ সাম্রাজ্য আবার ফিরে এসেছে। তোমরা পশ্চিমে ঝুঁকে রেহাই পাবে না। তোমাদের যেখানে থাকার কথা, সেখানেই থাকতে হবে। এই কঠিন সত্য না মানলে শান্তি আসবে না। তোমাদের পাশে কেউ নেই। যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করবে না, আর একা ইউরোপও পারবে না। তবে ইউরোপীয়রা আলাস্কার এ বৈঠকের আড়ালের বার্তাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে উপকৃত হবেন। কারণ, এই বৈঠকও দেখিয়ে দিয়েছে, বিশ্বব্যবস্থার প্রধান চালিকা শক্তি হলো বড় শক্তিগুলোর স্বার্থ আর ছোট বা মধ্যম শক্তির জন্য সেখানে কোনো গুরুত্ব নেই।
ইউরোপীয়দের নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে হবে। আপাতত হয়তো যুক্তরাষ্ট্র তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক পরিবর্তন করছে না, তবে ট্রাম্প নিশ্চিতভাবে ইউরোপীয় নেতাদের কথা শুনবেন, প্রশংসায় হাসিমুখ দেখাবেন, তারপরও উপেক্ষা করবেন। সুতরাং ইউরোপীয়দের বুঝতে হবে, নতুন এ বিশ্বব্যবস্থায় তারা একা। নিরাপত্তা বা বাণিজ্য—কোনো ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থকে আর বিবেচনা করবে না।
ইউরোপকে এখন নিজের মতো করে একটি শক্তিশালী বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত হতে হবে। এর জন্য দ্রুত ও উদ্যমের সঙ্গে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। মহাকাশ, গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুরো ডিজিটাল খাতের মতো বিভিন্ন খাতে তাদের একলা চলতে হবে।
আলাস্কার বৈঠক ইউরোপকে এ বার্তাই দিয়েছে, বর্তমান বিশ্বে নিজের নিরাপত্তা ও স্বার্থের রক্ষা করতে হলে শুধু প্রচলিত অস্ত্র বা সামরিক শক্তি নয়, এক সমন্বিত ও আধুনিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। অর্থাৎ ইউরোপকে কেবল রক্ষা নয়; বরং শক্তিশালী ও স্বাধীন বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে হবে।
এবার প্রশ্ন হলো, ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র কেন এত স্পষ্টভাবে নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে? অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া ছাড়া, পুতিন এ বৈঠক থেকে তাঁর চাওয়া প্রায় সবই পেয়ে গেছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, তিনি কূটনৈতিক একঘরে অবস্থার বাইরে এসেছেন, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে সমান বিশ্বশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ইউক্রেনের ভাগ্যকে ‘রুশকি মির’ বা রাশিয়ার বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতের অংশ হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে। তাহলে কোনো বিনিময় ছাড়াই ট্রাম্প কেন রাশিয়াকে শক্তিশালী করছেন?
এ ধরনের প্রশ্ন যতই ইউরোপীয়দের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, এর উত্তর মিলবে কেবল মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রেক্ষাপটে। তাই এখন ইউরোপকে নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হবে।
জোশকা ফিশার জার্মানির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাবেক ডেপুটি চ্যান্সেলর
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ