২৪ জুলাই ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। এটি কার্যকর হলে কাউকে গ্রেপ্তার করে থানায় নেওয়ার সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির পরিবার, বন্ধু বা আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তা জানাতে হবে। কোনো অবস্থায় এ সময় ১২ ঘণ্টার বেশি নেওয়া যাবে না। (গ্রেপ্তারের ১২ ঘণ্টার মধ্যে পরিবারকে জানাতে হবে, প্রথম আলো, ২৫ জুলাই ২০২৪)

ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করার পরেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। এই প্রশ্নগুলো হলো, গ্রেপ্তারের পর গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির পরিবার বা স্বজনদের তা জানানোর জন্য ‘সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা’ কি অনেক বেশি সময় নয়? এই ১২ ঘণ্টা সময় নির্ধারণ করা হলো কোন যুক্তিতে? সরকার চাইলে এটি আরও কম হতে পারত কি না?

২.

বাংলাদেশের সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু পরিবার ও স্বজনদের তা জানানোর ক্ষেত্রে আইনে কিছু বলা হয়নি। তবে এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের একাধিক নির্দেশনা রয়েছে।

২০০৩ সালে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের জন্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ‘যুগান্তকারী’ রায় ঘোষণা করেছিলেন। রায়ে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রচলিত বিধান সংশোধন করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ওই ধারা সংশোধনের আগে কয়েক দফা নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সরকারকে বলা হয়েছিল। সেখানে একটি নির্দেশনা ছিল: বাসা বা কর্মক্ষেত্র ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তার করলে ওই ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে।

হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছিল। ২০১৬ সালে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়টি বহাল রাখলেও নির্দেশনায় কিছু পরিবর্তন আনেন। সেই নির্দেশনায় গ্রেপ্তারের বিষয়টি পরিবার ও স্বজনদের জানানোর ক্ষেত্রে ১ ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করা হয়।

লক্ষণীয় হলো, ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের বিষয়বস্তু সাংবাদিকদের জানানোর সময় আদালতের রায় এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের কথা উল্লেখ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। (প্রথম আলো, ২৫ জুলাই ২০২৫)। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে অন্তর্বর্তী সরকার ২০১৬ সালে দেওয়া আপিল বিভাগের নির্দেশনাকে আমলে নিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের চেয়ে আপিল বিভাগ ‘উচ্চতর’; এ কারণে আপিল বিভাগের দেওয়া সর্বশেষ নির্দেশনাই সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা হিসেবে গণ্য হয়। তাহলে এ ক্ষেত্রে সমস্যাটা কোথায়?

৩.

২০০৩ সালে বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থা ২০১৬ সালের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। এ ছাড়া তখন অল্পসংখ্যক মানুষ মুঠোফোন ব্যবহার করতেন। ইন্টারনেট ব্যবহার করে যোগাযোগের সুযোগ ছিল আরও কম। এরপরও হাইকোর্টের নির্দেশনা থেকে বোঝা যায়, গ্রেপ্তার ব্যক্তির পরিবার ও স্বজনদের গ্রেপ্তারের বিষয়টা জানানোর জন্য আদালত তখন এক ঘণ্টা সময়ই যথেষ্ট মনে করেছিলেন।

অন্যদিকে ২০১৬ সালে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি দৃশ্যমান হয়েছিল; সেই সময় মুঠোফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তারপরও কেন আপিল বিভাগের নির্দেশনায় গ্রেপ্তারের বিষয়টা স্বজনদের জানানোর জন্য ১ ঘণ্টাকে বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করা হলো?

সুনির্দিষ্ট কোন কারণে হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনায় দেওয়া ১ ঘণ্টার সময়সীমা বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করা হয়েছিল, সেটার কোনো ব্যাখ্যা আপিল বিভাগের রায়ে নেই। তবে কিছু ইঙ্গিত আমরা রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সময়ের প্রেক্ষাপটে খুঁজে পাই।

২০১৬ সালের প্রেক্ষাপটে আদালতের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পর্কের বিষয়টা তাদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। এ কারণে এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, অন্তর্বর্তী সরকার কেন গণতান্ত্রিক আমলে দেওয়া হাইকোর্টের নির্দেশনার চেয়ে ‘ফ্যাসিবাদী’ আমলে দেওয়া আপিল বিভাগের নির্দেশনাকে বেশি গুরুত্ব দিল?

লক্ষণীয় হলো, হাইকোর্টের রায় দেওয়া হয়েছিল ২০০৩ সালে। অন্যদিকে আপিল বিভাগের রায় এসেছিল ২০১৬ সালে; শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরাচারী সরকার তখন ক্ষমতায়।

২০০৩ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে বাংলাদেশ অনেক বেশি ‘পুলিশি রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়েছিল। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে জঙ্গিবাদ নির্মূল এবং বিরোধী দল দমনের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘বার্গেইনিং পাওয়ার’ (দর–কষাকষির ক্ষমতা) তখন অনেক বেড়ে গিয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, সেই সময় উচ্চ আদালতেও এসব বাহিনীর প্রভাব তৈরি হয়েছিল। এ রকম প্রেক্ষাপটেই আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনায় দেওয়া ১ ঘণ্টার সময়সীমা বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করেন।

৪.

প্রশ্ন হচ্ছে, কাউকে গ্রেপ্তারের পর সেই খবর তাঁর আত্মীয়স্বজন বা পরিবারকে জানাতে ১২ ঘণ্টা কেন লাগবে? দু–একটা ব্যতিক্রম বাদে এটা তো তাৎক্ষণিকভাবেই জানানো সম্ভব; সে ক্ষেত্রে এক ঘণ্টাই যথেষ্ট। তাহলে ‘সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা’ কতটা যৌক্তিক?

সরকারের পক্ষ থেকে একটা যুক্তি হতে পারে, সর্বোচ্চ অদালত অর্থাৎ আপিল বিভাগের নির্দেশনা মেনে তারা ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করেছে। সাধারণভাবে এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ২০১৬ সালের প্রেক্ষাপটে আদালতের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পর্কের বিষয়টা তাদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। এ কারণে এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, অন্তর্বর্তী সরকার কেন গণতান্ত্রিক আমলে দেওয়া হাইকোর্টের নির্দেশনার চেয়ে ‘ফ্যাসিবাদী’ আমলে দেওয়া আপিল বিভাগের নির্দেশনাকে বেশি গুরুত্ব দিল?

একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, আপিল বিভাগের নির্দেশনা যা–ই থাকুক, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সেটা সরকারের জন্য কোনো বাধা নয়। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে এ ক্ষেত্রে সময়সীমা ১২ ঘণ্টা না করে ১ ঘণ্টা করতেই পারত এবং সেটা সব দিক থেকে অনেক বেশি যৌক্তিক হতো।

৫.

ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন নিয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমরা মনে করি, এই আইন যদি সঠিকভাবে প্রতিপালন করা যায়, তাহলে ইচ্ছেমতো মানুষকে গ্রেপ্তার করে হয়রানি, গ্রেপ্তার করে অস্বীকার করা, মানুষকে গুম করা, সেগুলো বন্ধের ক্ষেত্রে এটি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।’ (প্রথম আলো, ২৫ জুলাই ২০২৫)

উপদেষ্টার এই ইতিবাচক আকাঙ্ক্ষাকে আমরাও সমর্থন করি। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে পরিণত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আইনে কোনো ফাঁকফোকর থাকলে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আরও কঠিন, অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের সে রকম শিক্ষাই দিয়েছে।

মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সূত্র, প্রথম আলো