তিস্তা নিয়ে ভারতে কী হলো?
Share on:
শেখ রোকন : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২১-২২ জুন ভারত সফরের মধ্য দিয়ে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনাগত পরিস্থিতি তাহলে কী দাঁড়াল? ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের শিরোনামের মতো সত্যিই দিল্লি কি ‘কনুই মেরে’ বেইজিংকে ঢাকার কাছ থেকে সরিয়ে দিয়েছে? (ইন্ডিয়া এলবোস আউট চায়না ফ্রম রিভার কনজারভেশন প্রজেক্ট ইন বাংলাদেশ, ডেকান হেরাল্ড, ২৩ জুন ২০২৪)। নাকি, এবারও ভারত তিস্তার পানি বণ্টনে সুস্পষ্ট রূপরেখা দিতে না পারায় নদীটির সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পে চীন এক ধাপ এগিয়ে গেল?
সন্দেহ নেই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দিল্লি সফর ‘বিশেষ’ ছিল। এই কারণে নয় যে, টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় এসে তিনি যেমন প্রথম দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সফরে গেলেন, তেমনই টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও প্রথম দ্বিপক্ষীয় কোনো অতিথিকে স্বাগত জানালেন। বরং এই কারণে যে, এবারের সফরে তৃতীয় পক্ষের অদৃশ্য অথচ অনিবার্য উপস্থিতি। সফরের আলোচ্যসূচি, আনুষ্ঠানিক বৈঠক, যৌথ ঘোষণা, যৌথ সংবাদ সম্মেলন– কোথাও চীনের উল্লেখ ছিল না। এমনকি ২২ জুন পররাষ্ট্র দপ্তরের ‘স্পেশাল ব্রিফিং’ চলাকালে একজন সাংবাদিক যখন শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সঙ্গে আসন্ন বেইজিং সফরের সম্পর্ক জানতে চাইছিলেন, তখন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা পত্রপাঠ বলে দিয়েছিলেন, আলোচনা ছিল দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাকেন্দ্রিক; তৃতীয় কোনো দেশ সম্পর্কে ছিল না। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা জানেন, এবারের সফরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পের মতো নিবারণ ও হরসুন্দরীর মাঝখানে দৃশ্যত অনুপস্থিত থেকেও কার্যত প্রবলভাবে উপস্থিত ছিল শৈলবালা।
বস্তুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দিল্লি সফর ভারতেরই প্রবল আগ্রহে নির্ধারিত হয়েছিল। মূলত চীন সফরের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন গত ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে রাষ্ট্রীয় সফরের আমন্ত্রণ পৌঁছে দিয়েছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা ৮ এপ্রিল ঢাকায় এক তড়িঘড়ি সফরে এসে তিস্তা প্রকল্পে ভারতীয় অর্থায়ন এবং বেইজিংয়ের আগেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের প্রস্তাব দেন।
তারও আগে, ২০১৯ সালের জুন মাসে চীনা কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেন্সিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট’ (টিআরসিএমআরপি) বা তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অগ্রসর হয়েছিল বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরই তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরুর বিষয়ে তিনি আশাবাদী। কিন্তু সপ্তাহখানেক পরই, ২৮ ডিসেম্বর (২০২৩) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বলেন, তিস্তা প্রকল্পে চীনের প্রস্তাবে ভারতের আপত্তি থাকলে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় এগোতে হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর চীনা রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ চাইলে তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করার বিষয়ে তৈরি আছে চীন। কিন্তু দিল্লি সফরে গিয়ে হাছান মাহমুদ ৮ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের ভোট মিটে গেলে তিস্তা নিয়ে সমাধানে পৌঁছার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।
বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীন-ভারত দ্বৈরথের প্রেক্ষাপটে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘বিশেষ’ সফরটি শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন হলো। অতীতের মতো ‘যৌথ বিবৃতি’ প্রকাশ না করে এবার ‘শেয়ারড ভিশন’ বা অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে সফরের ‘আউটকাম’ বা ফলাফল তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, দুই পক্ষের মধ্যে ৭টি নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর ও ৩টি পুরোনো সমঝোতা স্মারক নবায়ন করা হয়েছে।
মূল প্রশ্ন হচ্ছে, এই সফরে মধ্য দিয়ে তিস্তা পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? দুই পক্ষের ‘অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি’ সংক্রান্ত ঘোষণার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বের স্বীকৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘উন্নয়ন সহযোগিতার অংশ হিসেবে পারস্পরিক সম্মত সময়সীমার মধ্যে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমরা তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনাগত উদ্যোগ গ্রহণ করব।’ এ ছাড়া ‘আউটকাম’ তালিকায় যেসব ঘোষণা রয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, ‘ভারতের একটি কারিগরি প্রতিনিধি দল তিস্তার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা (সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখতে) বাংলাদেশ সফর করবে।’
তার মানে, এবারের সফরে তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুটি কার্যত হিমাগারে চলে গেল। বরং উজানের দেশ থেকে পানিপ্রাপ্যতার অনিশ্চয়তায় বাংলাদেশ যে নিজস্ব সীমানার মধ্যে চীনের সহায়তায় একটি কারিগরি সমাধানের কথা ভাবছিল, সেটাই ভারত বাস্তবায়ন করে দিতে চাইছে। বলা বাহুল্য, চীনকে সরিয়ে দিয়ে। এমনকি অনেক বছর ধরে বিশেষজ্ঞরা পানি বণ্টনের বদলে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার যে কথা বলে আসছেন, এই প্রস্তাবে সেটাও নাকচ হয়ে গেছে। কারণ প্রকল্পটি ভারত বাস্তবায়ন করতে চাইছে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে’। তিস্তা অববাহিকাজুড়ে, বাংলাদেশ-ভারত মিলিয়ে নয়।
এটা ঠিক, এবারের সফরে উত্তরবঙ্গ তথা তিস্তা অববাহিকায় সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে চেয়েছে ভারত। ‘আউটকাম’ তালিকায় ১৩টি ঘোষণা রয়েছে, তার ৭টির মধ্যেই ‘উত্তরবঙ্গীয় ঝোঁক’ স্পষ্ট। যেমন রংপুরে নতুন উপ-হাইকমিশন স্থাপন; কোচবিহারের হলদিবাড়ী থেকে নীলফামারীর চিলাহাটী হয়ে আসামের ডালগাঁও পর্যন্ত মালবাহী ট্রেন সার্ভিস চালু; ভারতীয় অনুদানে সিরাজগঞ্জে অভ্যন্তরীণ নৌপথের কনটেইনার ডিপো স্থাপন; নেপাল থেকে উত্তরবঙ্গে বিদ্যুৎ রপ্তানি।
এখন ভারতের এই প্রস্তাবকে বাংলাদেশ কীভাবে নিয়েছে বা নেবে? আমার শিক্ষক অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে যথার্থই বলেছেন, নয়াদিল্লির এমন প্রস্তাব বরং ‘সময়ক্ষেপণ কৌশল’ হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তিনি বলেছেন, দ্বিমুখী উদ্যোগ, পানি বণ্টন ব্যবস্থা এবং পুনরুদ্ধার ও ব্যবস্থাপনা ছাড়া এই প্রস্তাব বাংলাদেশকে বরং সন্দিহান করে তুলবে। (দ্য টেলিগ্রাফ, ২৩ জুন ২০২৪)।
আমি নিজেও ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমে বলেছি, প্রথম ধাপে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় পানি বণ্টন চুক্তি হতে হবে, যাতে উভয় দেশের অববাহিকাভিত্তিক অধিকার নিশ্চিত হয়। তারপর একটি বহুপক্ষীয় প্রকল্পের মাধ্যমে তিস্তা সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা হতে পারে। সেখানে ভারত, চীন ছাড়াও বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো আন্তর্জাতিক অর্থকরী সংস্থাগুলো থাকতে পারে। (ইটিভি ভারত, ২২ জুন ২০২৪)।
আমরা জানি, পিকচার আভি বাকি হ্যায়। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিং যাচ্ছেন। যদিও আলোচ্যসূচি এখনও প্রকাশ্য হয়নি, সেখানে অনিবার্যভাবেই তিস্তা সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প নিয়ে কথা হবে। অন্তত ওই সফরের আগেই দিল্লি সফর নিয়ে ভারতের জোরাজুরি এবং দেশটির সংবাদমাধ্যমে তিস্তা সংক্রান্ত সংবাদ ও শিরোনাম দেখে তাই মনে হয়। আমার ধারণা, প্রধানমন্ত্রী ভারত ও চীনের প্রস্তাব দুটি তুলনা করেই সিদ্ধান্ত নেবেন। অন্তত গত ১২ জুন জাতীয় সংসদে তিনি ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট।