বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে চুক্তির ফাঁকফোকর
Share on:
জলবায়ু সঙ্কটের ভয়াবহতা অনুধাবনের পর থেকে অভিযোগের আঙুল জীবাশ্ম জ্বালানির দিকে; তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা। সব গুঁতাগুঁতি ওখানে। আদর্শগত দ্বন্দ্ব কেবল জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার আধিক্য।
সমাধানহীন নানা তর্ক আর অবৈজ্ঞানিক বিতর্ক শেষে অন্তত একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে সদ্যসমাপ্ত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে। ২৮তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮ এবার বসেছিল চার দিকে দালান আর দালানের শহর দুবাইয়ে। ৩০ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১২ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দরাদরির টানাপড়েনে পরে তা আরো এক দিন বাড়াতে হয়। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সম্প্রসারিত ভোগবাদের দুর্নিবার আকাক্সক্ষার কাছে জলবায়ুর বৈশ্বিক চেহারা যখন অসহায়, তখন এ সম্মেলন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে বৈকি।
১৯৯৫ সালে বার্লিনে পৃথিবী সুরক্ষা ভাবনার প্রথম সম্মেলন দিয়ে শুরু। এবারের আগে কার্যকর ২৭টি জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতারা নানা অঙ্গীকার করলেও জোরদার বিশেষ অগ্রগতি চুক্তিনামাতে সীমাবদ্ধ। সম্পাদিত চুক্তি প্রশ্নহীনভাবে বরখেলাপ হয়েছে। প্রতিনিয়ত হচ্ছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ সংশ্লিষ্ট নতুন নতুন বিষয় নিয়ে জোরালো যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বেড়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা সোচ্চার হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। ক্ষতির কারণ ও পরিমাণ নির্ণয় করে সুনির্দিষ্টভাবে জানানোর সুযোগ অবারিত হয়েছে। সান্ত্বনা এতটুকু।
এবারো জোরদার তর্ক, বাহাস, সক্রিয় প্রমাণ, অনমনীয় দেনদরবার, গালগল্প, দায়িত্বশীল তৎপরতা, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও শেষে সংহতি প্রকাশ করে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারো ‘জলবায়ু সমাধানের মিথ্যা আশ্বাস’ শীর্ষক চুক্তি এমনই পর্যবসিত হোক, তা কেউ চায় না।
পৃথিবী নামের গ্রহটি অসুস্থ ও ভঙ্গুর হয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। প্রকৃতির যে ভয়াবহ রুদ্রমূর্তি বা যে রূপে খরা, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, প্লাবন, সাইক্লোন, সব ঘটছে প্রকৃতির ওপরে মানুষের অত্যাচারে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে প্রান্তীয় মানুষের বসবাসের উপযোগিতা হারানো পৃথিবী এখন বড় অসহায়; এক কঠিন যন্ত্রণায় নিপতিত।
‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ বা পৃথিবীর উষ্ণায়ন মূলত অত্যধিক কার্বন নিঃসরণে ঘটে থাকে। আমরা যাদের উন্নত রাষ্ট্র বলি, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী সমৃদ্ধ দেশ বলে জানি, শিল্পায়ন ও খাদ্যাভ্যাসসহ বিভিন্ন কারণে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা সেসব দেশ থেকে বেশি পরিমাণে হয়। তৃতীয় বিশ্বের সব দেশকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয়। এসব দেশ অর্থনেতিকভাবে উন্নতসমৃদ্ধ হতে পারেনি শিল্পায়নের অভাবে। বর্তমান যুগপরিক্রমায় দ্রুত সমৃদ্ধি অর্জনে প্রয়োজন শিল্প। বৃহৎ শিল্পকারখানা। অথচ এ শিল্পকারখানা পরিবেশ বিধ্বংসী কাণ্ডকারখানার জন্য দায়ী। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতায় সরাসরি যুক্ত এসব শিল্প থেকে নিঃসৃত কার্বন ডাই-অক্সাইড।
অনুন্নত-প্রান্তীয়-উন্নয়নশীল-দরিদ্র নামের দেশগুলোয় ক্ষতিকর শিল্পায়ন না হলেও তারা কিন্তু পরিবেশবান্ধব কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জড়িত। সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় বসবাসের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন এসব দেশের সাধারণ মানুষ। জানমাল, জীবনমান, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্য-পুষ্টিসহ সবসময় নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে থাকে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসে সমতল কৃষিজমি প্লাবিত হয়। তলিয়ে যায়। লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে জমির উর্বরাশক্তি নষ্ট করে। কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়। কখনোবা ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী করে ফেলে। কর্মহীন জীবন, অর্থহীন সংসার শেষে ঠাঁই হয় শহরের বস্তিতে। ঐতিহ্যের পরিবার নিঃস্ব হয়ে লাঞ্ছনার জীবনযাত্রায় নিপতিত হতে বাধ্য হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জীবনের জটিল হিসাব-নিকাশের জালে বন্দী হয়। সম্ভাবনায় মোড়ানো সংসার দরিদ্র আর সাহায্যনির্ভর হয়ে পঙ্কিল স্রোতে গা ভাসায়।
বাংলাদেশ জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রলোর মধ্যে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি দেশের মধ্যে সপ্তম অবস্থানে। অথচ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয়। যন্ত্রসভ্যতার দুঃসহ এ কালে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলো গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ করে মাত্র ৫ শতাংশ। কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইডের মতো মারাত্মক ক্ষতিকর ৯৫ শতাংশ গ্যাস নিঃসারিত হয় প্রযুক্তিবিদ্যায় সমৃদ্ধ, উচ্চাভিলাষী উন্নত দেশগুলো থেকে। পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত এ চার দেশের সম্মিলিত কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ মোট নিঃসরণের ৫৫ শতাংশ।
পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অন্তত ১ দশমিক ৬২ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে কেবল অপরিসীম দুর্ভোগ আর জলবায়ু বিশৃঙ্খলার শিখা উসকে দেবে তা নয়, হিসাব পরিষ্কার। একবিংশ শতাব্দী শেষে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে প্রায় অর্ধশত দেশ। আমাজান শুকিয়ে যাবে, পৃথিবীর বৃহত্তম বরফখণ্ড অ্যান্টার্কটিকা গলে যাবে, অস্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী মানুষ হিটস্ট্রোকে মারা যাবে আর সমুদ্রপৃষ্ঠে তলিয়ে যাবে পঞ্চাশের অধিক স্বাধীন রাষ্ট্র। এসব তথ্য জানিয়েছে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোট-এওএসআইএস।
জলবায়ুসংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ দিন ধরে সতর্ক করলেও তা ছিল অন্তঃসারশূন্য। তারা সুনির্দিষ্ট করে দেখিয়েছেন গত এক শতাব্দীতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণের পরিমাণ বেড়েছে ২৩ শতাংশ। মিথেন গ্যাস নির্গমন পরিমাণ বেড়েছে শতভাগ আর নাইট্রাস অক্সাইডের নিঃসরণ বেড়েছে ১৯ শতাংশ হারে। ফল দৃশ্যমান। পৃথিবীব্যাপী মানুষের বেঁচে থাকার প্রতিকূল সংগ্রাম অনেক বেড়েছে। টিকে থাকার লড়াই আরো কঠিন হচ্ছে।
জলবায়ু সঙ্কটের ভয়াবহতা অনুধাবনের পর থেকে অভিযোগের আঙুল জীবাশ্ম জ্বালানির দিকে; তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা। সব গুঁতাগুঁতি ওখানে। আদর্শগত দ্বন্দ্ব কেবল জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার আধিক্য। ভুক্তভোগী হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ুসংক্রান্ত বিশ্ব ফোরামে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তিযুক্ত প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছে। বাংলাদেশের দাবি-প্রস্তাবনা ও নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়েছে। পুরস্কৃত হয়েছে।
এবারের সর্বকালের সবচেয়ে বড় জলবায়ু সম্মেলনে দুই শতাধিক দেশের ৮৪ হাজারের বেশি প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক এবং অধিকারকর্মীর অংশগ্রহণে সম্মেলনস্থলে বেশ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও শেষে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। দীর্ঘ বিতর্ক আর কঠিন দরকষাকষির পর ২০৫০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে এসে দূষণমুক্ত জ্বালানি ব্যবহারের ঐকমত্য চুক্তি কিছুটা স্বস্তি ও উচ্ছ্বাসের জন্ম দিয়েছে। অপেক্ষা এখন বাস্তবায়ন। তেল উৎপাদন দেশগুলোর অগ্রাহ্য তদবির, তেল-গ্যাস-কয়লা রফতানিকারক দেশের নাখোশ মনোভাবের পরিণতি শেষ পর্যন্ত আবেগ ও আন্তরিকতাপূর্ণ হবে এমনটার দিকে বিশ্ব তাকিয়ে আছে।
ত্রিয়মা রায়
শিক্ষার্থী, পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চুয়েট
সূত্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত
তারিখ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪