মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ২০, জানুয়ারী ২০২৪

পরিবেশ বিপর্যয় ও বাংলাদেশ

Share on:

পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তার জন্য গঠিত লস্ট অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড থেকে সহায়তা নেয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে এর সূচকগুলোর পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করা প্রয়োজন।


অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম

পরিবেশ বিপর্যয় একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া। এর প্রতিক্রিয়া বহুমাত্রিক, অনেক ক্ষেত্রে জীবন বিপন্নকারী। ‘পরিবেশ বিপর্যয় ও ভবিষ্যৎ পৃথিবী’ সম্পর্কিত ষষ্ঠ প্রতিবেদনে আন্তঃসরকার পরিবেশ গ্রুপ পরিবেশ বিপর্যয় রোধে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর অবস্থা সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টির মতো অবস্থায় পৃথিবী এক ভয়াবহ পরিবেশ দুর্যোগের কবলে পড়বে।

বিশ্বব্যাপী এল-নিনোর প্রভাব এবং সাথে ক্রমবর্ধমান কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশ বহুমুখী এবং ক্রমবর্ধমান পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর সাথে অতিরিক্ত ঝুঁকি বাড়িয়েছে এর ভৌগোলিক অবস্থান। ৩১ অক্টোবর ২০২২ অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ‘কান্ট্রি অ্যান্ড ক্লাইমেট ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ফর বাংলাদেশ’ নামক প্রতিবেদনে এটি জানানো হয়েছে।
যদিও বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের অবস্থান পেছনের সারিতে, বার্ষিক কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় ১৪০ মিলিয়ন টন; তবু পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে এর অবস্থান সপ্তম। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্বল্পোন্নত বা মাঝারি উন্নত দেশগুলো। এসব দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার ঘনত্ব, জমির বিরূপ ব্যবহার, বাধা ও পরিকল্পনাহীন নগরায়ন, দ্রুত মরুকরণ প্রক্রিয়া, অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে বনাঞ্চল ধ্বংস, জলাধার ভরাট, কয়লা, কাঠ, জীবাশ্ম জ্বালানি এই বিপর্যয়কে আরো দ্রুততা দান করেছে। অস্বাস্থ্যকর ইটভাটা এবং মান নিয়ন্ত্রণবিহীন সিমেন্টের উৎপাদন ও ব্যবহার পরিবেশ-বিপর্যয়কে ক্রমে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে সবার অগোচরে।

বাংলাদেশে এখন ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ও ফসলহানির যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা বিপর্যস্ত বেপথু পরিবেশের কারণে। বৈশ্বিক তাপমাত্রার ক্রমবৃদ্ধির কারণে পরিবেশবিজ্ঞানীরা সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন। ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। বিশ্ব ২০২৪ সালে শতাব্দীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মুখোমুখি হবে, এর আভাস দিয়েছেন। ২০ ডিসেম্বর ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত ‘বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন-২৮, প্রত্যাশা বনাম প্রাপ্তি’ শিরোনামে এবং সেন্টার ফর পারটিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আয়োজিত সেমিনারে পরিবেশবিজ্ঞানীরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের জোর তাগিদ দিয়েছেন। একই সাথে বিশ্বজুড়ে ক্রমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে দাবি জানিয়ে আসছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা ও পরিবেশসম্পর্কিত সংগঠনগুলো। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ, বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো কার্বন ফুটপ্রিন্ট ও এর প্রতিরোধ সম্পর্কিত কলাকৌশল নিয়ে সোচ্চার হয়েছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালে কার্বন নিঃসরণ-সংক্রান্ত সম্মেলনে নীতিমালা ও কার্যক্রম ঘোষিত হবে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি যাই হোক না কেন জার্মান ওয়াচ ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী পরিবেশ বিপর্যয়ে ক্ষতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে রয়েছে।

পরিবেশ বিপর্যয় ঝুঁকির ক্ষতি এড়াতে উদ্যোগ নেয়ার সময় এখনই। যদিও ২০৩০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণ ২১ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনায় অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। পরিবেশ বিপর্যয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা, বিপর্যয়ের ক্ষেত্রগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করার ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব পারে কার্বন নিঃসরণকে সীমিত বলয়ে রাখতে। প্রজন্মের ওপর পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব সম্পর্কেও রাজনৈতিক নেতাদের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। এ ব্যাপারে প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকরী সমন্বয়। একই সাথে গণসম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। কারণ গরিব, নিম্নবিত্ত ও চরাঞ্চলের অধিবাসীরা পরিবেশ বিপর্যয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকেন। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন মৎস্যজীবীরা ও সমুদ্র এবং নদীপাড়ের জনপদ।

এদের সম্পৃক্ততা ও কার্যকর অংশগ্রহণ ছাড়া এ ধরনের কার্যক্রম ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম। এ ক্ষেত্রে সফলতার উদাহরণ দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এ কর্মসূচির কারণে এখন সাইক্লোন টর্নেডোতে প্রাণ এবং সম্পদহানির পরিমাণ কমেছে। এরপরও গ্রামীণ পর্যায়ে সহজলভ্য বাসস্থান নির্মাণ, পরিবহনব্যবস্থায় সুপেয় পানি ব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য নিষ্কাশন, বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যায় প্রণোদনা, পরিবেশবান্ধব চুলার ব্যবহার কার্বন ফুটপ্রিন্টকে বদলে দেবে নিঃসন্দেহে। একই সাথে যানবাহন শিল্প-কারখানা কৃষি ও দৈনন্দিন জীবনাচার কার্বন নিঃসরণ এবং তা কমিয়ে আনার ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করার ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যাপক উদ্যোগের প্রয়োজন। শিল্পোদ্যোক্তা ও পরিবেশবিদ সমন্বয়ে টাস্কফোর্স তৈরি করে বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ প্রাথমিকভাবে সীমিত ও পরবর্তীতে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কার্যক্রম গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি কম কার্বন নিঃসরণ শক্তির ব্যবহার বিশেষ করে কমপ্যাক্ট ফ্লুরোসেন্ট ল্যাম্প ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহিত করা; যা এককভাবে ৯০ হাজার টন গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাবে প্রতি বছর।

কলকারখানা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং বাড়ি-ঘরের বর্জ্য পানি পরিশোধন করে পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্যরে পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা। প্লাস্টিকের ব্যবহার, অস্বাস্থ্যকর ইটভাটা, কৃষি ক্ষেত্রে, গবাদিপশু পালনে, মাছচাষে অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছ রাসায়নিকের ব্যবহার কঠোরভাবে বন্ধ করা দরকার। একই সাথে কালো ধোঁয়া উদ্গিরণকারী সমস্ত যানবাহনকে রাস্তায় চলাচলে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা দরকার।

পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তার জন্য গঠিত লস্ট অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড থেকে সহায়তা নেয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে এর সূচকগুলোর পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ যেহেতু বার্ষিক কার্বন নিঃসরণ একেবারে পেছনের সারিতে, সঠিক ও কার্যকর কার্যক্রমে সফলতার সম্ভাবনা অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। প্রয়োজন কার্যকর ও সঠিক পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন।

সূত্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত

তারিখ: ০১ জানুয়ারি ২০২৪