ফিচার নিউজ প্রকাশনার সময়: শনিবার ১০, ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সড়কে বিশ্ব রেকর্ড

Share on:

গাজীপুর-বিমানবন্দর ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বাস্তবায়িত এ ধরনের প্রকল্পের চেয়ে ৬ গুণ বেশি সময় চলে গেলেও এখনো কাজ শেষ হয়নি। শুধু তাই নয়, ব্যয়ের ক্ষেত্রেও শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে প্রকল্পটি। এমন দৈর্ঘের বিশ্বের অন্য বিআরটির প্রকল্পের চেয়ে ৪ গুণের বেশি ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সময় ও ব্যয়ের দিক থেকে ইতোমধ্যেই প্রকল্পটি এক রকম ‘বিশ্ব রেকর্ড’ করেছে-এমন মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।


পদ্ধতিগতভাবে বিআরটির সারিতে শুধু বিশেষ বাস চলাচল করে। বাংলাদেশের প্রথম বিআরটি প্রকল্পে বিশেষায়িত বাসের পাশাপাশি সাধারণ বাস চলাচলের সুযোগ রাখা হয়েছে। এতে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে-এমন আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, গাজীপুর-বিমানবন্দর করিডরে দেশের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিআরটির ত্রুটিপূর্ণ বাস্তবায়ন বা পরিচালনার কারণে যানজট বাড়বে শিল্প অঞ্চলটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য তারা, বিআরটি করিডরে বিশেষায়িত বাস কিনে আরও অর্থের অপচয় না করে সাধারণ বাস চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এটা হলে ওই সড়কে নির্বিঘ্নে গাড়ি চলাচল করতে পারবে। প্রকল্পে অর্থের অপচয় হলেও নতুন ভোগান্তি বাড়বে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের প্রায় ২০০টি শহরে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এটা খুব সহজ ও কম খরচের প্রকল্প। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বাস্তবায়িত এসব প্রকল্প সমতল সড়কে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। গাজীপুর-বিমানবন্দর সড়কে অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইওভার নির্মাণ করে প্রকল্পের খরচ বাড়ানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, অন্য সব পরিবহণ সচল রেখে বিআরটি হয় না, তবুও সেই চিন্তায় করিডর বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য শহরে বিআরটি প্রকল্প নির্মাণে সময় লাগে ৯ মাস থেকে ১৫ মাস পর্যন্ত। তবে বেশি দৈর্ঘ্যরে কয়েকটি বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে দুই থেকে আড়াই বছর পর্যন্ত সময় লেগেছে; সেগুলো দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার বা তার চেয়েও বেশি দৈর্ঘ্যরে। ঢাকা বিআরটি প্রকল্পের প্রথম বাস্তবায়নের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই সময়ে প্রকল্পের কাজ শুরুই করতে পারেনি বিআরটি। তিন দফা প্রকল্প সংশোধন করে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে, বিশ্বে ৫০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের রেকর্ড রয়েছে। ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বিআরটি প্রকল্পের খরচ আরও কিছু বেশি হওয়ার রেকর্ড আছে। তবে সেটা ঢাকা বিআরটি প্রকল্পে চেয়ে অনেক কম। শুরুতে বিআরটি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৩৯৮ কোটি ৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের তিন দফা সংশোধনের পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, বিআরটি প্রকল্পের জন্য বাস না কিনলে আমি খুশি হব।

কেননা এই টাকা গচ্চা যাবে। বিআরটি প্রকল্প যেভাবে পরিচালনা করার কথা, সেভাবে পরিচালনা না হলে এখানে যানজট বাড়বে। বিমানবন্দর-জয়দেবপুর করিডরের শিল্পাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গাজীপুর-বিমানবন্দর করিডরের বিআরটি খণ্ডিত ও ক্রটিপূর্ণ, এই করিডরের জন্য বিশেষায়িত বাস না কিনে সাধারণ বাস চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেই বরং ভালো হবে।

তিনি বলেন, বিআরটি একটি খণ্ডিত প্রকল্প হলেও এখানে গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ায় যানজট থেকে স্বস্তি মিলেছে। সেই জায়গাটা পুরোপুরি বাসের জন্য চলে গেলে তখন ওই করিডরের পরিবহণ পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হবে। দীর্ঘসময় ও অতিরিক্ত খরচে বিআরটি প্রকল্প বিশ্বরেকর্ড করেছে। বাস নামালে পরিচালনায় ব্যর্থতার নতুন রেকর্ড তৈরি করবে। কেননা এই ধরনের করিডরে বিশ্বের অন্যান্য শহরে অন্য বাস চলাচল করে না। কিন্তু এই করিডরে অন্যান্য বাস চলাচলের সুযোগ রাখা হচ্ছে। এটা হলে এই উদ্যোগ, ঢাকা নগর পরিবহণের মতো মুখ থুবড়ে পড়বে।

তিনি জানান, সরকারের এই উদ্যোগকে বিআরটি না ভেবে এখন যদি করিডর উন্নয়ন চিন্তা করা হয়, তাহলে তা সফল হবে। এভাবে মনে করতে হবে, একটি অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে, সেখানে কিছু ক্ষতি হয়েছে। বিআরটির নামে খণ্ডিত ও ত্রুটিপূর্ণ বিআরটিতে বাস চালালে আরও বড় ক্ষতির মুখে পড়বে সরকার। এই ঘটনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরও অনেক বদনাম হবে। বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে; বাংলাদেশের চায়নিজের মতো অর্থাৎ মসলা দেওয়া চায়নিজ। সঠিক চায়নিজ হবে না। শুধু করিডর হিসেবে ব্যবহার হলে যানজট সহনীয় থাকবে।

ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. এসএম সালেহ উদ্দিন বলেন, গাজীপুর-বিমানবন্দর করিডরে বিআরটি প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। বিশ্বের কোথাও বিআরটি প্রকল্পের জন্য ফ্লাইওভার নির্মাণ করে না। কোনো নদী, খাল না থাকার পরও ফ্লাইওভার তৈরি অপ্রয়োজনীয়।

তিনি বলেন, বিআরটি সহজ কাজ হলেও ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকল্পটিকে জটিল করা হয়েছে। দীর্ঘসময় নিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে এসেছে। এই করিডরে অন্যান্য বাসের সঙ্গে বিশেষায়িত বাস চালালে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ নতুন বাস না কিনে ওই রুটকে ‘ঢাকা নগর পরিবহণের’ সঙ্গে সমন্বয় পরিচালনা করলে সরকারের অর্থের অপচয় রোধ হবে। নইলে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এই করিডরে যানজট বাড়বে। যেটা ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি গণপরিবহণ চলাচল মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করবে।

নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, গণপরিবহণ হিসেবে বিআরটি খুবই ভালো পরিবহণ। এটা কম সময়ে, কম খরচে ও খুব সহজে করা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন শহর তার দৃষ্টান্ত করেছে। ভারতের আহমেদাবাদে চমৎকারভাবে চলছে বিআরটি প্রকল্প। কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন জটিলতা তৈরি করা হয়েছে, সেটা বিরল ঘটনা। একটা ভালো পদ্ধতির নেতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করা হয়েছে; যার নাম শুনলে মানুষের সামনে ভোগান্তির চিত্র ফুটে ওঠে।

তিনি বলেন, বিআরটি করিডরে শুধু বিশেষায়িত বাস চলাচল করে। এখানে অন্য পরিবহণ চলাচল করে না। কিন্তু বিআরটির ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। আট সারির সড়কের দুটি সারি বিআরটির জন্য রেখে চার সারি সাধারণ পরিবহণের জন্য রাখা হয়েছে। বাকি দুই সারি আঞ্চলিক সড়ক হিসাবে ব্যবহার করা হবে।

তিনি জানান, বিআরটি করিডরকে সফল করতে হলে অন্যান্য বাস চলাচল বন্ধ করতে হবে। শুধু বিশেষায়িত বাস চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে ঢাকা নগর পরিবহণের মতো বিআরটি প্রকল্পের উদ্যোগও ব্যর্থ হবে।

বিআরটি প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, গাজীপুর মহানগরী এলাকার জনগণের ঢাকা মহানগরীতে চলাচল সহজ ও নিরাপদ করতে গাজীপুর-বিমানবন্দর বিআরটি প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। এই প্রকল্পের আওতায় গাজীপুর থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত মহাসড়কের মিডিয়ামের উভয় পাশে একটি করে সারি শুধু বিআরটি প্রকল্পের বাস চলাচলের জন্য ব্যবহার করা হবে। সংক্ষিপ্ত সারি কিছু সময় পরপর অধিক যাত্রী ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন আর্টিকুলেটেড বাস চলাচল করবে এমন পরিকল্পনা প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়।

তারা আরও জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী যাত্রীদের সুবিধার্থে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা এবং বাস স্টেশনে স্বয়ংক্রিয় টিকিট কাউন্টার ও বাস আগমনের তথ্য প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে। বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এটি হবে গাজীপুর মহানগর ও ঢাকা মহানগরীর মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও পরিবেশবান্ধব প্রথম বাসভিত্তিক আধুনিক গণপরিবহণ ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় প্রতি ঘণ্টায় উভয় দিকে ২৫ হাজার যাত্রী পরিবহণ করবে। চারটি প্যাকেজের আওতায় বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে দুটি প্যাকেজের কাজ শেষ হয়েছে, বাকি দুটি প্যাকেজের কাজ চলমান রয়েছে।

বিআরটি প্রকল্পের রুট : বিমানবন্দর টার্মিনাল, জসিম উদ্দিন সরণি, আজমপুর, হাউস বিল্ডিং, আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গী ব্রিজ, স্টেশন রোড, মিল গেইট, চেরাগ আলী মার্কেট, টঙ্গী কলেজ, হোসেন মার্কেট (এরশাদ নগর), গাজীপুরা, তারগাছ, বড়বাড়ী বাজার, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বোর্ডবাজার, হাজীর পুকুর, মালেকের বাড়ী, ভোগরা দক্ষিণ, ভোগরা উত্তর, চৌরাস্তা, বিআরটিসি ডিপো, আড়ং মিল্ক ফ্যাক্টরি, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং গাজীপুর টার্মিনাল।

সার্বিক বিষয়ে বিআরটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বিআরটি প্রকল্পটি সরকারের অনুমোদিত প্রকল্প। অনুমোদিত পরিকল্পনা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে কোনো পরিবর্তন করার ক্ষমতা বিআরটি কর্তৃপক্ষের নেই। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে যদি কোনো পরিবর্তন করতে চায়, সেটা হতে পারে। তবে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে বিআরটির সব ধরনের কার্যক্রম চলমান রেখেছি। বাস কেনার প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে।

তিনি বলেন, বিআরটি প্রকল্পের শুরু থেকে নানা প্রতিকূলতার কারণে কিছুটা দেরি হয়েছে। এটার বিশ্বের কি অবস্থান সে বিষয়ে কিছু বলতে চায় না। কয়েকদিন হলো আমি এই পদে যোগদান করেছি। বাকি কাজগুলো সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর