মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: সোমবার ২৯, জানুয়ারী ২০২৪

বিএনপির ব্যর্থতা নয় বরং কাদের মদদে নির্বাচন হলো সেটির সুলুক সন্ধান করুন

Share on:

বন্ধুপ্রতীম শক্তির সমর্থনের আশ্বাস পেয়ে আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনের বিস্তারিত রণকৌশল প্রণীত হয়। তাই দেখা যায়, ২৮ অক্টোবর বিএনপির ১০ লক্ষ লোকের সভায় হেভি পুলিশী ক্র্যাকডাউন। ২৮ অক্টোবর রাত থেকেই একই সঙ্গে শুরু হয় সারা দেশব্যাপী ব্যাপক ধরপাকড়। হাজার হাজার বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মী আজও মাঠে ঘাটে প্রান্তরে রাত কাটাচ্ছেন।


ইংরেজিতে একটি বহুল প্রচারিত প্রবাদ রয়েছে। সেটি হলো, Success has many fathers, but failure is an orphan. অর্থাৎ সাফল্যের দাবিদার অনেক, কিন্তু ব্যর্থতার দায় কেউ নেয় না। অর্থাৎ ব্যর্থতার দায় কারোর নয়। প্রবাদটি মনে পড়লো এই কারণে যে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকার যে এই নির্বাচনে নজিরবিহীন অনিয়ম করেছে সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা না করে এক শ্রেণীর গণমাধ্যমে বিএনপির তথাকথিত ব্যর্থতার কারণ সন্ধান করা হচ্ছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনটি হয়ে গেল। এটি কি বিএনপির ব্যর্থতা? এই নির্বাচনকে ঠেকাতে হলে প্রতিটি কেন্দ্রে বিএনপি বলুন আর যারাই বলুন, ভোট প্রদানে কঠোরভাবে বাধা দেওয়া লাগতো। 

এছাড়া ভোট ঠেকানোর আর কোনো উপায় ছিল না। বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল যদি তাই করতো তাহলে, বলার অপেক্ষা রাখে না, ৩০০ টি আসনের কয়েক হাজার কেন্দ্রে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটতো। আজকে যারা বিএনপির তথাকথিত ব্যর্থতার সুলুক সন্ধান করছেন তারা সেদিন বলতেন যে বিএনপি একটি টেররিস্ট পার্টি। এই দলকে রাজনীতি করার অধিকার দেওয়া যায় না। অবিলম্বে এই দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। 

এই ধরনের আংশিক পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে নেওয়া হয়েছে। বলা হয় যে ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। কয়েক দিন আগে একটি বাংলা দৈনিকে একজন পরিচিত কলামিস্টের কলাম পড়লাম। তিনি সেক্যুলার ঘরানার কলামিস্ট বলে পরিচিত। তিনি লিখেছেন যে যারা জামায়াতে ইসলামীকে এবং ছাত্রশিবিরকে মাঝে মাঝেই নিষিদ্ধ করার আওয়াজ তোলেন তারা ভুলে যান যে বাংলাদেশ ৫৩ বছর হলো স্বাধীন হয়েছে। ছাত্রশিবিরের একজন নেতা তো দূরের কথা, একজন কর্মীও নেই যিনি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পূর্বে জন্মগ্রহণ করেছেন। সুতরাং এই দলটিকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নই আসে না। এখনও যে শিবিরের প্রতি সর্বত্র বিমাতাসূলভ আচরণ করা হচ্ছে এবং শিবিরকে তথাকথিত এলিট সমাজে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে ট্রিট করা হচ্ছে সেটিও শুধু বেআইনিই নয়, একেবারে নজিরবিহীন। 

অনুরূপভাবে জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বে দলটিতে এমন কেউ নেই যিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন। স্বাধীনতা বিরোধী বলে যাদেরকে আওয়ামী লীগ চিহ্নিত করেছিল তাদেরকে ইতোমধ্যেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছে (এই বিচার ও ফাঁসি নিয়ে এখন কেউ কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করতে শুরু করেছেন)। যাই হোক, জামায়াতের নির্বাচনী প্রতীক কেড়ে নেওয়াকে সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক কাজ হয়নি বলে আরেক শ্রেণীর মানুষ মনে করেন। 

দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো এই যে চতুর্থ মেয়াদে মন্ত্রীত্ব গ্রহণের পরেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে বিএনপি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন এবং তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। তাদেরকে নিষিদ্ধ করা উচিত। রাজনীতিতে ইংরেজি ভাষায় রেটোরিক এবং ডেমাগোগি বলে দুটো পরিভাষা রয়েছে। রেটোরিক বা ডেমাগোগি বলতে আমরা সাধারণত বুঝি মেঠো বক্তৃতা। পলিটিক্যাল ডেমাগোগিতে এই ধরনের বক্তব্য হয়েই থাকে। আমরাও অস্বীকার করি না যে জনতুষ্টিবাদ (Populism) বলে একটি পরিভাষা আছে। জনসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে এবং সামনে হাজার হাজার লোক দেখতে পেয়ে বক্তা অনেক সময় জনসাধারণের মনোভাব আঁচ করতে পেরে এমন ধরনের বক্তৃতা করেন যেটি তিনি করবেন বলে সভায় আসার আগে ভাবেননি। এটিকে বলা হয় Playing to the gallery. তো, মেঠো বক্তৃতা বলুন আর জনতুষ্টিবাদ বলুন, দেশের নীতি নির্ধারকদের মেঠো বক্তৃতা মোটেই সমীচীন নয়। বিএনপি যে সন্ত্রাসী দল সেটি সরকার প্রমাণ করবে কিভাবে? আজ পর্যন্ত অকাট্য দালিলিক প্রমাণসহ জামায়াতে ইসলামীকেও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। এত সব কথা বলতে হলো যখন দেখা যাচ্ছে যে সাম্প্রতিককালে সরকারের নির্বাচন পূর্ব এবং নির্বাচনকালীন ভূমিকার সমালোচনার চেয়েও বিএনপির তথাকথিত ব্যর্থতা নিয়ে বেশি সমালোচনা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। 

॥ দুই ॥

বিএনপির ব্যর্থতার সমালোচনা করার আগে আওয়ামী ঘরানার রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে একটি প্রশ্ন, বাংলাদেশে যে কিম্ভুৎকিমাকার নির্বাচন হলো সেটার ব্লু প্রিন্ট কোথায় হয়েছে? ২০২৩ সালের ১০ নভেম্বর দিল্লিতে আমেরিকা ও ভারতের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ভারতের তরফ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং আমেরিকার পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনি ব্লিংকেন এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন অংশগ্রহণ করেন। দুই দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের বৈঠক শেষে প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা যে প্রেস ব্রিফিং করেন সেখানে তিনি ইংরেজিতে যা বলেন তার হুবহু বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় নি¤œরূপ, “এই বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই স্পষ্ট করে তুলে ধরেছি আমরা। বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে দেশের মানুষ তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। একটি বন্ধু এবং সঙ্গী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান জানাই আমরা।” বিনয় কোয়াত্রার এই বক্তব্য মার্কিন অবস্থানের সাথে মোটেই খাপ খায় না। কারণ মার্কিনীরা বলে আসছে যে তারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এই নির্বাচনে কেউ সহিংসতা করলে অথবা নির্বাচনের আগে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কেউ বাধা দান করলে তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। 

বিনয় কোয়াত্রার বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক জনাব তৌহিদ হোসেন, হুমায়ুন কবির, মেজর জেনারেল (অব) মুনিরুজ্জামান সহ আরো অনেক কূটনীতিক ও পন্ডিত ব্যক্তি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, বিনয় কোয়াত্রা জানিয়ে দিলেন এই নির্বাচনে ভারত স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায়। অর্থাৎ তারা চায় যে বর্তমান সরকার পরবর্তী মেয়াদেও ক্ষমতায় থাকুক। বিনয় কোয়াত্রার এই বক্তব্যে উল্লসিত হয়ে দুই অক্টোবর সাংবাদিকদেরকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তলে তলে আপোষ হয়ে গেছে। দিল্লি আছে, আমেরিকারও দিল্লিকে দরকার। দিল্লি আছে, আমরা আছি (ডেইলি স্টার, ৩ অক্টোবর ২০২৩)।’ 

॥ তিন ॥

বন্ধুপ্রতীম শক্তির সমর্থনের আশ্বাস পেয়ে আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনের বিস্তারিত রণকৌশল প্রণীত হয়। তাই দেখা যায়, ২৮ অক্টোবর বিএনপির ১০ লক্ষ লোকের সভায় হেভি পুলিশী ক্র্যাকডাউন। ২৮ অক্টোবর রাত থেকেই একই সঙ্গে শুরু হয় সারা দেশব্যাপী ব্যাপক ধরপাকড়। ২৮ অক্টোবর রাত থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সহ ২৭ হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরমধ্যে সাড়ে ৩ হাজার জামায়াতের নেতাকর্মী রয়েছেন। ২৭ হাজার গ্রেফতার ছাড়াও তার চেয়েও বেশি সংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। ফলে হাজার হাজার বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মী আজও মাঠে ঘাটে প্রান্তরে রাত কাটাচ্ছেন। ২৫ অক্টোবর ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি করুণ ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ছবিতে দেখা যায়, সুপ্রিম কোর্টের সামনে বিএনপির নেতাকর্মীরা সারারাত বসে আছেন এই আশায় যে পরদিন তাদের জামিনের আবেদন আদালতে উঠবে। উঠেও ছিল। কয়েক জন জামিন পেয়েছেন। অনেকে পাননি। অনেকের আবেদন ঝুলে আছে। 

২৮ অক্টোবর থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত রাজপথে বিএনপি জামায়াতের কোনো নেতাকর্মী ছিলেন না। রাজপথ একতরফাভাবে দখল করে রেখেছিল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হেলমেট বাহিনী। তাদের মাথার ওপর নিরাপত্তার ছাতা বিস্তার করে রেখেছিল পুলিশ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিএনপির এ পর্যন্ত ৩৭ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এত কিছুর পর কেমন নির্বাচন হয়েছে সেটি বিজেপি ঘনিষ্ঠ থিংক ট্যাংক শ্রী রাধা দত্ত বলেছেন। তিনি বলেছেন যে নির্বাচনে ১০ শতাংশও ভোট পড়েছে কিনা তাতে তিনি সন্দিহান (দৈনিক প্রথম আলো, ১০ জানুয়ারি ২০২৪)। কেমন ইলেকশন হয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলার জায়গা নেই। তবে ডেইলি স্টারের মালিক সম্পাদক মাহফুজ আনাম স্বনামে লিখিত কলামে বলেছেন, From one party to one person : What was de facto is now de jure. অর্থাৎ এক দল থেকে এক ব্যক্তির শাসন : যেটি ছিল অলিখিত সেটি হলো বাস্তব (ডেইলি স্টার, ১২ জানুয়ারি ২০২৪)। 

  • আসিফ আরসালান

সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম