সাক্ষাৎকার প্রকাশনার সময়: শনিবার ১০, ফেব্রুয়ারি ২০২৪

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার মূলে কী?

Share on:

ড. নাদিন শান্তা মুরশিদ যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব বাফালোর স্কুল অব সোশ্যাল ওয়ার্কের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি পিএইচডি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের রোটগো’জ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁর কাজের এলাকা হলো সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিংসতা, গার্হস্থ্য সহিংসতা, ক্ষুদ্রঋণে নারী। সম্প্রতি তিনি অভিবাসী শ্রমিক এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়েও গবেষণায় জড়িত থেকেছেন।


1-1707420387

প্রশ্ন : সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, দেশে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ক্ষেত্রে ‘অভিমান’ প্রধান কারণ। এর ব্যাখ্যা কী?

উত্তর : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-ডব্লিউএইচও আত্মহত্যা বা আত্মঘাতকে গভীর জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রায় আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে এবং ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। কেন করে? অনেক কিছুই আমরা ‘না ভেবে করেছি’ বলে মনে করি। তবে মনের ভেতর চিন্তা কিন্তু থাকে। খুব স্পষ্ট করে না হলেও থাকে। শুধু একটি কারণে আমরা খুব বেশি কিছু করি না। নিজের জীবন নেওয়ার বেলায়ও তা-ই। আমার ধারণা, আমাদের শিক্ষার্থীদের অভিমান আমাদের প্রতি– আমরা যারা মা-বাবা, অভিভাবক, রাজনীতিবিদ, পুঁজিবাদী, পাড়ার লোক, দেশের নেতা। আমরা তাদের জন্য যে জীবন, যে বিশ্ব তৈরি করেছি, তাতে তারা সন্তুষ্ট নয়। কীভাবে হবে? পুঁজিবাদী সমাজে উন্নতি করতে পারার সীমা কিছু মানুষের জন্য খাটো থেকেই যাবে। কারণ এটিই পুঁজির নিয়ম। আমাদের পড়ালেখা নিয়ে এত রাজনীতি হয়েছে; আমরা না পারি বাংলা, না পারি ইংরেজি, না পারি আরবি। কিন্তু বড়লোকের বড় বড় কথা আমাদের শুনতে হয়; যদিও তারা ওই তিন ভাষার একটিও ঠিকমতো পারেন না। আমরা প্রতিনিয়ত শুনি, আমাদের দেশ এবং গোটা পৃথিবী ডুবে যাবে ২০ বছরের মধ্যে। আমাদের শ্রদ্ধাভাজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব এখন হাতেগোনা। সবাই শুধু দলাদলি, পক্ষপাত নিয়ে আছে। এভাবে বাঁচার ইচ্ছা কি আমরা আমাদের সন্তানদের দিচ্ছি? বরং তাদের দিচ্ছি নির্দয়তা ও নিঃসঙ্গতার এক জীবন। এসবই শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যাকে উস্কে দিচ্ছে।

প্রশ্ন : কেউ যখন আত্মহননের পথ বেছে নেয়; এটি হঠাৎ ঘটে, নাকি দীর্ঘদিনের মানসিক পীড়ন থেকে? এর পূর্বলক্ষণ আছে কি?

উত্তর : আমার গবেষণায় আমি দেখেছি, ‘suicide ideation’ বা পরিকল্পনা দিয়ে শুরু হয়। মানুষ চিন্তা করে– ‘এই শেষ, আর পারছি না।’ তার মানে এই না, তারা নিজের জীবন নেবেই নেবে। অনেকেই এ নিয়ে একবার অন্তত চিন্তা করে বা ভাবে। সেটা তাদের সাহায্য করে নিজেদের জীবনের মূল্য বুঝতে। এই ভাবুকদের মধ্যে একটা অংশ চেষ্টা করে নিজের জীবন নিতে; তার মাঝে তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। অনেকেই অক্ষম হয়।
আমি আমার এক ছাত্রের সঙ্গে এ রকম একটি উদাহরণ নিয়ে কাজ করেছিলাম। আমাদের গবেষণায় দেখি, অন্তত একজন ভালো বন্ধু থাকলে বাচ্চারা আত্মহত্যার পরিকল্পনা থাকলেও তা বাস্তবায়নের প্রয়াস রাখে না। উল্লেখ্য, যারা অন্য শিক্ষার্থী দ্বারা নিপীড়িত হয়, তাদের মানসিক অবস্থা এক পর্যায়ে আত্মহত্যার দিকে চলে যায়। যাদের বন্ধু থাকে, একজন হলেও, তাদের মধ্যে নিপীড়িত হওয়ার আশঙ্কাও কম। এ ব্যাপারে খেয়াল রাখা দরকার। আরেকটি হলো উদ্বেগ। আমাদের স্যাম্পলে যারা বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল, তাদের মধ্যে শুধু আত্মহত্যা নিয়ে পরিকল্পনা নয়; প্রয়াসও ছিল। সে কারণে আমি মনে করি, মানসিক অবস্থার দিকে খেয়াল রাখা খুব জরুরি। এটি শুধু বাড়িতে না; স্কুলেও।

প্রশ্ন : আত্মহত্যা প্রতিরোধে মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বলা হয়। মানসিক স্বাস্থ্য কি ব্যক্তির একার বিষয়?

উত্তর : মানসিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ। সমাজ যদি বাসযোগ্য না হয়, মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা খুব কঠিন। আমার বেশির ভাগ বন্ধু মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য ওষুধ খায়। তা খেয়ে অবস্থা ঠিক হয় না। তাই তাদের ওষুধ খেয়েই যেতে হয়। এভাবে তারা জীবনকে সহনীয় করে তোলে যতটুকু সম্ভব। পুঁজিবাদের মাঝে এটিই আমাদের জীবন। একটি কারখানা। আমরা সেখানে খেটেই চলব। লাভ হবে অন্য কারও।

প্রশ্ন : আমাদের সংকট কোনটা? প্রত্যাশা বেশি থাকলে না পাওয়ার বেদনা থেকে অভিমান, নাকি টিকে থাকার সংগ্রাম?

উত্তর : এটা কোনো কোনো শ্রেণির মানুষের প্রশ্ন, না? উঠতি মধ্যবিত্তের প্রত্যাশা বেশি। আর গরিবের বেঁচে থাকাই দায়। জিনিসপত্র, খাবারের দাম বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে আমরা শুনি, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো। তাতে কি এটা দাঁড়ায় না যে, আমি যে অভাব অনুভব করছি, তার দোষ আমার? আমি যে উচ্চস্তরে যেতে পারছি না, তার কারণ আমি নিজেই? সবার আকাঙ্ক্ষাই তো এক– যেমন আছি, তার থেকে ভালো কীভাবে থাকা যায়। জীবনের পেছনে ছুটছি মানে টাকা-পয়সার পেছনে ছুটছি। এই করেই চলে যাচ্ছে আমার শখ, সাধ, কাঙ্ক্ষিত জীবনের স্বপ্ন। সামাজিক স্ট্যাটাস বৃদ্ধির খেলায় তো আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলছি। মনে করছি, আমার ক্রয়শক্তিই আমার বাজারের মূল্য ঠিক করবে। এর মানে কী? মানে হলো, আমার মূল্যবোধ পাল্টেছে। আমাদের যে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ছিল– পড়ালেখা করতে হবে, মানুষ হতে হবে, সৎ হতে হবে– এসব আমরা পুঁজির বাজারে বেচে দিয়েছি। এ রকম বিশ্বে যে আমাদের ছেলেমেয়েরা থাকতে চায় না– এই আত্মহত্যার হার তার প্রমাণ।

প্রশ্ন : সাধারণত মানুষ যখন কোনো আশা দেখতে পায় না, তখন আমাদের সমাজ কি তাকে কোনো বিকল্প দেখাতে পারছে?

উত্তর : না। যদি পথ খোলা থাকে সেটা একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য। আর, সবাই ভীষণ অসহায়। তবে আমরা তা অগ্রাহ্য করি। আমাদের সমাজে সহমর্মিতার চাইতে পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা বেশি। যদি সমাজে ন্যায়বিচার না থাকে; আপস-মীমাংসার রীতি বা প্রতিষ্ঠান কাজ না করে; যদি মানসিক বা শারীরিক বা আর্থিকভাবে সংকটাপন্ন মানুষের জন্য ভরসা না থাকে; তারা বেঁচে থাকবে কী করে? দৈনন্দিন যন্ত্রণা, অসম প্রতিযোগিতা, হতাশা তখন বড় হয়ে দেখা দেয়।

প্রশ্ন : সামাজিক বৈষম্য, অস্থিরতা, মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা আত্মহত্যায় কতটা ভূমিকা রাখছে?

উত্তর : আমি বলব প্রায় পুরোটাই। এখানে দেখা যাবে, আত্মহত্যার কারণগুলো এক দিনে তৈরি হয়নি। ধরুন, আপনি ছোটবেলায় একবার যৌন নিপীড়ন বা অন্য কোনো ধরনের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। হয়তো তার রেশও কাটিয়ে উঠেছেন। কিন্তু একটা সময় আবার তেমন বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটল অথবা বারবার ঘটল। তখন তার মধ্যে যেটা হয়, ট্রমা-অ্যাকুমুলেশন—মানসিক আঘাতের পুঞ্জীভূত চাপ। এই চাপ অনেকের মানসিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ভেঙে ফেলে। তারা তখন হয়তো আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রশ্ন : সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, নারীদের মধ্যে এবং ঢাকা বিভাগে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এর কারণ কী?

উত্তর : যেখানে সামাজিক বৈষম্য এত, সেখানে নারীদের জন্য তা আরও বেশি। দেখুন, আজকাল মেয়েরা খুব ভালো করছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, কাজকর্ম, কথাবার্তায়। কিন্তু তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। যখন হয় তা টোকেনিজম বা লোক দেখানো বললেই চলে। মূল্যায়নের অভাব কিন্তু প্রচুর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে আমাদের উঠতি পুঁজিবাদী কালচারে।

প্রশ্ন : আত্মহত্যা বিশ্লেষণে অনেকে একে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবও কি যথেষ্ট শক্তিশালী নয়?

উত্তর : একদম। যে উদারপন্থি সমাজে আমরা এখন বাস করি, সেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি সব জড়িত। আলাদা করে দেখার কিছুই নেই। রাজনৈতিক দায়িত্ব হলো পুঁজিবাদকে সহায়তা করা। মার্গারেট থ্যাচার বলেছিলেন, ‘দেয়ার ইজ নো সোসাইটি, অনলি ইন্ডিভিজুয়ালস’। অর্থাৎ ব্যক্তি বলতে কিছু নেই, সবাই সমাজের অংশ। আমরা এখন ওই সমাজে বাস করি। আমাদের মানসিক অবস্থা, আত্মহত্যা করার প্রয়াস– এসব তার সঙ্গেই যুক্ত। কেননা, আমরা নিজেদের না পারি চিনতে, না আমরা কোনো কিছুর অংশ। পুঁজি আমাদের একতা কেড়ে নিয়েছে। বলেছে আমাদের একলা লড়াই করতে; আমাদের মর্যাদা বাড়াতে উন্নয়নের মাধ্যমে। শুধু দেশের না; নিজের। স্ট্যাটাস, মূল্য সব এখন প্রথমত অর্থনৈতিক, তারপর সব। এটি অবশ্যই একটি রাজনৈতিক আশঙ্কা।  

প্রশ্ন : জীবন-জগৎ সম্পর্কে বোঝাপড়া কি স্কুল থেকেই দেওয়া উচিত, নাকি পরিবারের ভূমিকাই মুখ্য হওয়া উচিত?

উত্তর :সবখানে এসব আলাপ হওয়া দরকার– স্কুল, বাসা, বই, নাটক, সিনেমা, টকশো, আড্ডা। আমার মনে হয়, আমরা যদি বাক্‌স্বাধীনতা রোধ না করে মানুষের কথা শুনতাম; তাদের মনের বাসনা, কষ্ট, বোঝার ঘাটতি সব নিয়ে খোলাখুলিভাবে কথা বলার স্বাধীনতা বোধ করতাম; মানুষ কী বলবে তা নিয়ে বিচলিত না হতাম; তাহলে আমরা মানসিকভাবে আরেকটু সুস্থ হতাম। তাতেই অনেকটা লাভ হতো আমাদের ও সন্তানদের।

প্রশ্ন : শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে করণীয় কী?

উত্তর :সামাজিক বৈষম্য দূর, পরস্পরকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা। আমি মনে করি, আমাদের দেশে এক ধরনের মানবাধিকার রেজিম আছে, যেটা এনজিও দ্বারা গড়া। তৃণমূল থেকে গড়া মানবতা যেহেতু নেই, বরং ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া– আমাদের একটি মানবতার ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে। আমরা পাশ্চাত্যের দেশ থেকে শিখেছি কীভাবে মানুষকে ম্যাস বা গণমানুষে পরিণত করা যায়। এভাবে আমরা শিখেছি কীভাবে আমাদের দেশের মানুষের মানবিকতা, মানবতা তুলে নেওয়া যায়। আমাদের এই মানবিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে। সবাইকে আলাদা মানুষ হিসেবে গণ্য করতে হবে, মর্যাদা দিতে হবে। আমি মনে করি, যারা নিজের জীবন নিয়ে নেয়, তারা হয়তো অনেকেই মর্যাদাহীনতায় ভোগে। আমরাই অর্থাৎ তাদের আশপাশের লোক এই ব্যবস্থা মেনে নিয়ে সেটাকে প্রশ্রয় দিই।

সূত্র: দৈনিক সমকাল