মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ২০, জানুয়ারী ২০২৪

চিকিৎসাবর্জ্য এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি

Share on:

চিকিৎসাবর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা দরকার। দরকার এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্মী ও জনসাধারণের ভেতর সচেতনতা সৃষ্টি। সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে সমন্বিত ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে।


অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম

বাংলাদেশে দ্রুত জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নগরায়ন এবং স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে বেড়েছে চিকিৎসাসুবিধার চাহিদা। আয়ু বৃদ্ধির সাথে বেড়েছে বয়সজনিত অসুস্থতা। দেশে সরকারি ৬০০ হাসপাতালসহ বেসরকারি চার হাজার ৪৫২টি হাসপাতাল, দুই হাজার ২৩৬টি ক্লিনিক, ১৬ হাজার ৯৭৯টি রোগ নির্ণয় এবং সেবাদানকেন্দ্র জনগণের বাড়তি চিকিৎসা-চাহিদার জোগান দিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান একদিকে জনগণের চিকিৎসাসেবা এবং বিশাল এক জনগোষ্ঠীর জীবিকার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে; অন্যদিকে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ দূষণেরও একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব, পরিবেশদূষণ, রোগ সংক্রমণ ও বিস্তারের সহায়ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের আশপাশে বসবাসকারী জনপদের। বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠানে বিকিরণ ব্যবস্থাপনার রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে।

সারা দেশের এসব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে দৈনিক রোগীপ্রতি ১ দশমিক ১৬ কেজি বর্জ্য তৈরি হয়। বর্তমান এক লাখ ৫৮ হাজার রোগীর বেড হিসাব করলে প্রতিদিন এক লাখ ৮৩ হাজার ২৬২ কেজি বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ সাধারণ বর্জ্য, ১৫ শতাংশ সংক্রামক বর্জ্য। সংক্রামক অংশের মধ্যে একটি অংশ তরল বর্জ্য। এসব বর্জ্য সংগ্রহ এবং ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত রয়েছে এক বিশাল কর্মীবাহিনী। এসব কর্মীর ওপর জরিপ চালিয়ে টিআইবি জানিয়েছে, ৪০ শতাংশ বর্জ্যকর্মীর যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই। ৬০ শতাংশ বর্জ্যকর্মীর জানা নেই তাদের দায়িত্বের গুরুত্বপূর্ণ দায় ও তথ্য। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বহু হাসপাতালে বর্জ্য সংরক্ষণের সঠিক ব্যবস্থা নেই। নেই প্রয়োজনীয় নির্দিষ্ট কর্মী। অনুপস্থিত বর্জ্য শোধনাগার। এসব বর্জ্য হাসপাতালের আশপাশে পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে, তরল বর্জ্য মাটিতে দ্রবীভূত হয়ে দূষিত করছে পানি। দূষিত করছে আশপাশের বায়ু। হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী এলাকায় দীর্ঘদিন বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে হৃদরোগ, প্রজননতন্ত্রের ত্রুটি, গর্ভস্থিত শিশুর অপুষ্টি, শারীরিক বিকৃতি ও গর্ভপাত, ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের অসুস্থতাসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। বর্জ্যকর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।

অপর এক গবেষণাপত্রে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক জানিয়েছে, বাংলাদেশের চিকিৎসাবর্জ্যরে ৯৩ শতাংশ রয়েছে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বাইরে। একই গবেষণাপত্রে জানানো হয়েছে, দেশের খুব কম মানুষই, যার প্রায় সবাই শিক্ষিত; চিকিৎসাবর্জ্য এবং এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানেন না। জানেন না এর ক্ষতিকর প্রভাব।

আরেকটি তথ্যপত্রে জানানো হয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে চিকিৎসাবর্জ্যরে পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ হাজার টন। এর পরিমাণ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চিকিৎসাবর্জ্যকে জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। সংস্থাটির মতে, এ পর্যায়ের ১৫ শতাংশ সংক্রামক বিপজ্জনক, বিষাক্ত, অনেক সময় প্রাণঘাতী। এর মধ্যে বিকিরণজনিত বর্জ্যও রয়েছে, যার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুরূহ। সংস্থাটি সেফ ম্যানেজমেন্ট অব ওয়েস্টেজ ফ্রম হেলথকেয়ার অ্যাকটিভিটিজের ব্যাপারে পরামর্শপত্র তৈরি করেছে এবং সদস্য দেশগুলোর মধ্যে তা প্রচার করেছে। এ ছাড়াও এ ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক নীতিমালাও ঘোষণা করেছে। যার ভেতর রয়েছে ইনজেকশনের সুঁইয়ের যথাযথ ব্যবস্থাপনা, খোলা জায়গায় চিকিৎসাবর্জ্য না পোড়ানো, যেন ডায়োক্সিন, ফুরান্স ও ভারী কণাবিশিষ্ট পদার্থ ছড়িয়ে পড়তে না পারে। এ ছাড়াও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর চিকিৎসাবর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে। যা ভবিষ্যতে একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বর্জ্যকর্মী, হাসপাতালের রোগী, রোগীর সাথে আগত সাহায্যকারী, চিকিৎসক, সেবক-সেবিকা, হাসপাতালে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের জনশক্তি ও আশপাশে বসবাসরত জনগোষ্ঠী সবার জন্য বিপজ্জনক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এ ব্যাপারে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। প্রয়োজনে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করে প্রতিটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের জন্য নিরাপদ চিকিৎসাবর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাধ্যতামূলক করা উচিত। প্রয়োজনীয় সংখ্যক বর্জ্যকর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা ক্লিনিক ও হাসপাতাল অনুমোদনের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। বর্জ্যকর্মীদের সঠিক প্রশিক্ষণ, দায় ও ঝুঁকির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্য জানানো দরকার। সাথে সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত নীতিমালা সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে কিনা নিবিড় তত্ত্বাবধান প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আইনি দুর্বলতা দূর করা দরকার। চিকিৎসাবর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা দরকার। দরকার এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্মী ও জনসাধারণের ভেতর সচেতনতা সৃষ্টি। সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে সমন্বিত ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে।

চিকিৎসাবর্জ্য ব্যবস্থাপনা অভীষ্টপানে পৌঁছাতে হলে জরুরি কর্মসূচি প্রণয়ন এবং নিরবচ্ছিন্ন বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন অবকাঠামো তৈরি প্রাথমিক বিবেচ্য বিষয়। কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক ব্যবস্থাপনা জরুরি। জরুরি বিকিরণজনিত বর্জ্য ঠেকানো।

প্রাথমিকভাবে চিকিৎসাবর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যয়বহুল ও কষ্টকর মনে হলেও শুরু হলে দেখা যাবে প্রান্তিক ব্যয় অনেক কম। বর্জ্যকর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি, চিকিৎসাসেবার সাথে জড়িতদের স্বাস্থ্যঝুঁকি, রোগী ও রোগীর সাথে আগতদের ঝুঁকি, আশপাশে বসবাসরতদের স্বাস্থ্যঝুঁকি, পরিবেশ দূষণের যে আর্থিক দায় সঠিক চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তার চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী, রোগীবান্ধব ও পরিবেশবান্ধব।

সূত্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত

তারিখ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৪