মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: মঙ্গলবার ৩০, এপ্রিল ২০২৪

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী হচ্ছে?

Share on:

দীর্ঘদিন ধরে ইয়েল, কলম্বিয়া ও প্রিন্সটনের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে আন্দোলন চলছে। এই বাস্তবতা ইসরায়েলে অর্থ সহায়তা ও অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে গণমানুষের প্রতিবাদের রাস্তা খুলে দিয়েছে। কলম্বিয়ার আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দেয়: ‘ইসরায়েল থেকে নিজেদের বিযুক্ত না করা পর্যন্ত আমরা থামব না। ফিলিস্তিনিরা মুক্ত, বিশ্বব্যাপী সব নিপীড়িতের জন্য স্বাধীনতা অর্জিত হোক।’


যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ এ আন্দোলনে হাজার হাজার শিক্ষার্থী, গবেষক ও শিক্ষককে আটক করা হয়। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সশস্ত্র অবস্থায় টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সময় তারা ডানপন্থি গভর্নর গ্রেগ অ্যাবটের নির্দেশে ডজনখানেক ব্যক্তিকে আটক করে। এই গভর্নরই ঘোষণা দিয়েছিলেন– ‘এসব প্রতিবাদী হাজতে যাওয়ার উপযোগী।’ ১৮ এপ্রিল এক পুলিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ‘গাজা সংহতি শিবির’-এর বিরুদ্ধে একজনকে অপরাধ সংঘটনে উৎসাহ দিয়েছিল। এক অধ্যাপক বলেছিলেন, ‘হাস্যকর ব্যাপার হলো, ঘটনা শান্ত ও শিবিরের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য প্রশাসন এই ধ্বংসাত্মক কাজের অনুমোদন দিয়েছিল।’ ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, কানাডা ও অন্যান্য জায়গায় একই ধরনের প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে।

শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ও তাদের আন্দোলনের প্রভাব স্পষ্ট। এ আন্দোলন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে অল্প সময়ের জন্য হলেও গণহত্যা থেকে বিরত থাকতে প্রভাবিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স, যিনি ইহুদি– জোরালোভাবে বলেছেন, ‘আপনাদের চরমপন্থি ও জাতিবাদী সরকারের অনৈতিক ও বেআইনি নীতি নিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করার পদক্ষেপ নিয়ে আমেরিকানদের অপমান করবেন না।… আপনাদের নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য আপনাদের দায়ী করা ইহুদিবিরোধী কার্যকলাপ নয়।’

গণমাধ্যম ভাষ্যকাররা শিক্ষার্থীদের উপহাস করেছেন। অন্যরা চটজলদি আন্দোলনকে ‘উগ্র ইসলামপন্থি’ ফ্রন্ট বলে তুলে ধরেছে। অথচ গাজায় ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুসংখ্যা যেখানে ৪০ হাজার ছুঁই ছুঁই, তবে তারা প্রতিবাদ করছে না কেন?

ডানপন্থিরা আন্দোলন ইহুদিবিরোধী পক্ষপাতমূলক বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। ইহুদি ও মুসলিম উভয় শিক্ষার্থীদের ভয় দেখানোর ঘটনা বারবার ঘটছে। কিন্তু এখানে ইহুদিবিরোধী স্লোগানের কথা বলে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের নজির রয়েছে, যেগুলো দিয়ে ইসরায়েলপন্থি আগ্রাসনকারীদের সহিংসতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে নির্দেশ করা হয়েছিল। বোস্টনের নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ‘ইহুদি হত্যা করো’ স্লোগানটি বেশ জোরেশোরে প্রচার করেছিল সংবাদমাধ্যম। অথচ এই আক্রমণাত্মক স্লোগানটি ইসরায়েলপন্থিরা জনসমাগমের উদ্দেশে শুরু করেছিল বলে প্রমাণিত।

পর্যবেক্ষকরা যদিও অভিযোগের সুরে বলছেন, শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ডে গাজা পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ইতিহাসবিদদের মতে, এসব আন্দোলন আধুনিক সময়ের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ষাটের দশকের নাগরিক আন্দোলন ও শিক্ষার্থী বিক্ষোভের সঙ্গে তুলনাযোগ্য। ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন আন্দোলন তখন এই গ্রহে বেশ কাঁপুনি ধরিয়েছিল। সেটা তিয়েনআনমেন স্কয়ার থেকে আরব বিশ্ব, লাতিন আমেরিকা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত। এসব আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক বলে উড়িয়ে দেওয়ার কিছু নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি, সরকারি চাকরি, ব্যবসায় ও আইন পেশাধারীদের শীর্ষস্থানীয়রা এসেছেন ইয়েল, হার্ভার্ড ও কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে। আর বিশ্বের এই শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজ যারা বিক্ষোভ করছেন, তারা আগামী দিনের অভিজাত। এই অভিজাতদের আগে ইসরায়েলপন্থি মনোভাবাপন্ন বলে চিহ্নিত করা হতো। এখন তারাই ইসরায়েলের নির্লজ্জভাবে যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করে ফিলিস্তিনে হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। এখন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রগতিশীল শাখাকে ফিলিস্তিনপন্থি বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, যেখানে রয়েছে প্রমীলা জয়পাল, আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ, করি বুশ ও রাশিদা তালিবের মতো স্পষ্টভাষী ব্যক্তিত্ব। ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র্যময় আমেরিকায় তারাই হলেন মার্কিন রাজনীতির ভবিষ্যৎ।

গাজা সংঘাতের সাত মাসে লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্কসহ অন্যান্য শহরে আন্দোলনকারীরা সড়কে নেমে বিক্ষোভ করেছেন। সাংবিধানিকভাবে ইউরোপীয় গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র হিসেবে স্বাধীনতাকে গ্রহণ করার পরও অনেকে এ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। তর্ক ও আন্দোলন করার অধিকার ইসরায়েলপন্থিসহ সবার জন্য অবশ্য সুরক্ষিত থাকবে। ন্যান্সি পেলোসি গত সপ্তাহে উল্লেখ করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাসগুলোর প্রতিবাদী চিত্র জীবনের অংশ ছিল। আর গাজার গণহত্যা নিয়ে অভিযোগ তোলা পুরোপুরি ন্যায্য। তিনি এ সময় বলেছিলেন, ‘গাজায় যা ঘটছে, তাতে বিশ্ববিবেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে।’

বিশ্বব্যাপী আমরা যা প্রত্যক্ষ করছি, তা ভালো বনাম মন্দ, ন্যায়বিচার বনাম অন্যায়ের লড়াই থেকে কম কিছু নয়। কেননা, শিক্ষার্থী, কর্মচারী, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে আমরাই রাজনৈতিক বিবাদের পুনঃআবিষ্কার করি। কয়েক দশক পর যখন শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক ও উদাসীন বলে অভিযুক্ত করা হবে, তখন আমরা গভীরভাবে এই প্রজন্ম নিয়ে গৌরবান্বিত হবো। তারাই আমাদের ভবিষ্যতের নেতা। কেননা, যারা গণহত্যা, নির্যাতন ও অন্যায়ের শিকার হয়েছেন, এমন মানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে জেল খাটছেন; কালো তালিকাভুক্ত হচ্ছেন, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কারেরও ঝুঁকি নিচ্ছেন।

বারিয়া আলামুদ্দিন: সাংবাদিক; আরব নিউজ

সূত্র: দৈনিক সমকাল