হঠাৎ কেন গ্যাস সংকট
Share on:
বিশেষজ্ঞদের মতে তাৎক্ষণিক সংকট মেটাতে জ্বালানি আমদানি করা ছাড়া উপায় নেই তবে সেটিও নির্ভর করছে ডলারের মজুদ, বিশ্ববাজারে দাম এবং দেশের আর্থিক সক্ষমতার ওপর ।
রান্নার গ্যাস ছাড়াও সিএনজি, শিল্পকারখানা এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে চলছে তীব্র গ্যাস সংকট।
ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে অর্থনীতির জন্য ৫টি ঝুঁকির মধ্যে জ্বালানি স্বল্পতাকে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্যাস সংকটের কারণ নিজস্ব জ্বালানির উৎপাদন কমেছে আর আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে।
ডলার সংকটের কারণে অতিরিক্ত আমদানি করাও সম্ভব হচ্ছে না। আগামীতে জ্বালানি সংকট মোকাবেলা এবং আমদানি করে চাহিদা পূরণ করাই হবে বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ।
জ্বালানি সংকট কতটা
দেশে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। পেট্রোবাংলার পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ, শিল্প, সার গৃহস্থলি, সিএনজিসহ সাতটি সেক্টরে মোট চাহিদা দাঁড়াবে ৩,৭১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
পেট্রোবাংলার হিসেবেই বর্তমানে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাসের ঘাটতি আছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্যাসের ঘাটতি আরো বেশি যা দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের মতো।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বলছেন দিনে দিনে আমাদের উৎপাদন কমে আসছে। উৎপাদন বাড়ানোর একটা চেষ্টা হয়েছিল তাতে কিছু জায়গায় উৎপাদন বেড়েছে কিন্তু অন্য জায়গায় কমে গিয়ে নেট উৎপাদন কমে গেছে।
"আমদানির ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা স্থবিরতা আছে। এই মুহূর্তে কোনো স্বল্পকালীন সমাধান নাই। এই জ্বালানি সংকট যেটা সেটা ডলারের সংকট না কাটলে স্বল্পকালীন কোনো সমাধান নাই," বিবিসি বাংলাকে বলেন অধ্যাপক তামিম।
উদ্বেগ কোথায়
বাংলাদেশে গ্যাস সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। পেট্রোবাংলার হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের চাহিদাই হবে এবার দেড় হাজার মিলিয়ন ঘটফুটের মতো।
তবে উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সার্বিক চাহিদা হলো ২২৪০ এমএমসিএফডি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা হচ্ছে সাড়ে সাতশ-আটশ এমএমসিএফডি গ্যাস।
অর্থাৎ গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের যে চাহিদা রয়েছে সেটির বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ৪০ শতাংশের মতো।
মি, তামিম বলছেন, গত বছর তেল-গ্যাস-কয়লা সব মিলিয়ে ১৩-১৫ বিলিয়ন ডলার লেগেছে। এবছর জ্বালানির দাম একই থাকলে প্রতি মাসে ১.২ বিলিয়ন ডলার লাগবে। অর্থাৎ এক বছরে ১৮বিলিয়ন লাগতে পারে। এ বিষয়টি প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করবে।
"আমাদের তো শুধু জ্বালানি আমদানি করলেই হবে না। শিল্প কারখানা চালাতে গেলে কাঁচামাল টোটাল আমদানির যে চাপ সেটা তো আছেই। সেখানে জ্বালানি অতিরিক্ত চাপ চলে এসেছে কারণ আমাদের জ্বালানি পুরো পরিকল্পনাটাই আমদানি নির্ভর হয়েছে।”
সরকারি হিসেবে এ বছর গরমে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা হতে পারে ১৭,৫০০ মেগাওয়াটের মতো। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেল, গ্যাস ও বিপুল পরিমাণ কয়লা প্রয়োজন হবে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমদানিসহ জ্বালানির জন্য ব্যয় করতে হয়েছে ৬১ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা।
অধ্যাপক ম তামিম বলছেন, বর্তমানে একহাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতেই সরকার হিমশিম খাচ্ছে। ভবিষ্যত পরিকল্পনা অনুযায়ী জ্বালানি আমদানি ব্যয় মেটানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রাথমিক জ্বালানির অভাবে ২০২২ সালে ব্যাপক লোডশেডিং করতে হয়েছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এলএনজি, কয়লার ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় জ্বালানি আমদানির জন্য অতিরিক্ত ১৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছিল বলে জানিয়েছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। এক পর্যায়ে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি গ্যাস আমদানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি চাহিদা পূরণ করতে ডলারের ওপর একটা ব্যাপক চাপ পড়ছে। বর্তমান সংকটের কারণে এ বছর জ্বালানি সংকট পূরণ আরো চ্যালেঞ্জিং হবে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক ও গবেষক মাহা মির্জা বলছেন আমদানি নির্ভর হওয়ায় পরিস্থিতি উদ্বেগের হয়েছে।
“আমাকে এটা পুরো ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এবং আপনারা জানেন যে আমাদের ডলারের যে রিজার্ভ আমাদের সেটা কমে আসছে খুবই আশঙ্কাজনকভাবে। এখনই কিন্তু আমি বিল পরিশোধ করতে পারছি না। আপনি দেখবেন বিভিন্ন প্রতিবেদনে বিপিসি পেট্রোবাংলা বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না জ্বালানির,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মাহা মির্জা।
এই সংকট কীভাবে হলো
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ না থাকা এবং আমদানি নির্ভরতা বৃদ্ধির কারণেই সংকটের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা হয়েছে কিন্তু নিজস্ব কয়লা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা যায়নি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম সমস্যার পেছনে প্রধানত বাংলাদেশে স্থলভাগ ও সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান তৎপরতায় ঘাটতি দেখেন।
তিনি বলেন, সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে ভারত ও মিয়ানমার ভালোভাবে করলেও বাংলাদেশের সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন হয়নি, অনুসন্ধানও হয়নি। গ্যাসের সংকট সহসা কাটবে না বলে তিনি মনে করেন।
"দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি আমরা ওইভাবে দেখছি না। বরং মনে হচ্ছে যে এটা যে কমতির দিকে যাচ্ছে সেটাকে উঠায় নিয়ে আসার পর্যাপ্ত অনুসন্ধান এবং কূপ খননের কাজগুলো যতটা দরকার ততটা হচ্ছে না,” বলছেন অধ্যাপক ইমাম।
পেট্রোবাংলার হিসেবে বাংলাদেশের আবিস্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে প্রমাণিত উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ আছে ৮.৬৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।
বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে বছরে এখন গ্যাসের চাহিদা এক টিসিএফ এর কাছাকাছি সেই হিসেবে এই গ্যাস দিয়ে দশ বছরের মতো চলতে পারে।
গ্যাসের মজুদ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন অনুসন্ধান এবং উত্তোলন বৃদ্ধি করা। অধ্যাপক ম তামিম বলছেন পেট্রোবাংলা অতীতে পরিকল্পনা গ্রহণ করেও সেটি থেকে সরে এসেছে। গ্যাস যে দেশে নাই এটা তো পেট্রোবাংলা ২০০৭ সাল থেকেই জানে।
ড. ম তামিম বলছেন, ২০১০ সালে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যেসব পরিকল্পনা ছিল সেগুলো সব ঝেড়ে ফেলা হয়েছে এবং পুরোটাই এলএনজি গ্যাস পরিকল্পনায় চলে গেছে ২০১২-১৩ সাল থেকে।
"পেট্রোবাংলা তার নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা থেকে সরে গিয়ে আমরা দেখছি যে তাদের যে গ্যাস সরবরাহ চাহিদা ছিল সেটা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করবে। এবং আমরা সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আগাচ্ছি,” বলেন অধ্যাপক তামিম।
জ্বালানি খাতে এ রকম একটা পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে সরকারের নীতিগত অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন রাখেন গবেষক মাহা মির্জা।
তিনি মনে করেন, সরকার মহাপরিকল্পনা করেই আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছে, যে কারণেই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
মাহা মির্জা বলেন, ২০১৬ সালে সরকার যে মাস্টারপ্ল্যান করেছে সেখানে পুরো জ্বালানি খাতটাকে সাজানো হয়েছে আমদানি নির্ভর করে। তাদের মাস্টারপ্ল্যানেই বলা ছিল যে সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের খরচ কমে আসবে আর কয়লা ও এলএনজির দাম বৃদ্ধি পাবে। এটা এমন না যে এটা তাদের কাছে অজানা তথ্য। এলএনজি স্পট মার্কেট সবসময়ই একটা অনিশ্চিত বিষয়।
মাহা মির্জা বলছেন, “যে আন্তরিকতা, দক্ষতা এবং যে প্যাশনের সাথে তারা কয়লা এবং এলএনজি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো করেছে সেই একই দক্ষতা একই প্যাশন দিয়ে যদি তারা নবায়নযোগ্য এবং দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলন করতেন তাহলে আমাদের আজকে এই সংকটের মধ্যে পড়তে হতো না।”
সমাধান কীভাবে
এই মুহুর্তে দেশের ২২টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক উত্তোলন হচ্ছে কমবেশি দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস। আর পাঁচশ এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এলএনজি আমদানির সক্ষমতা অনুযায়ী দৈনিক সর্বোচ্চ ৮শ থেকে ৯৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি সম্ভব। এখনকার চাহিদা পূরণে আমদানি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই তবে দীর্ঘ মেয়াদে সমাধানের জন্য সাগরে এবং স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলছেন অনুসন্ধান বাড়ানোটাই হবে দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের সর্বোত্তম উপায়
“যথেষ্ট পরিমাণ অনুসন্ধান করতে হবে। কূপ খনন করে যেতে হবে। দশটা কূপ খনন করে যদি তিনটাতেও পান তাহলেও কিন্তু ভাল। এই কাজটা না করলে এই গ্যাস সংকট থেকে কখনোই উত্তরণ ঘটাতে পারবো না। স্থলভাগেও জরুরি ভিত্তিতে বাপেক্স এবং এর সঙ্গে বিদেশি কোম্পানিকে এনগেজ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে আমাদের অনুসন্ধান কাজকে আরো জোরালো করতে হবে,” বলেন অধ্যাপক ইমাম।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, জ্বালানি সংকট সমাধানের জন্য সরকার বহুমূখী জ্বালানি ব্যবহার করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে জোর তৎপরতা আছে।
এ বছরই সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে। এছাড়া পরিবেশ ও কৃষিজমি রক্ষা করে নিজস্ব কয়লা উত্তোলনের জন্যেও পদক্ষেপ নেয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার।
বিবিসিকে মি. হামিদ বলেন, “আমাদের স্ট্রাকচার যেগুলো আছে সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করতেছি। আমাদের আরো ড্রিলিং করতে হবে। এবং তার জন্য অর্থযোগানও দিতে হবে। অর্থটাও কিন্তু একটা বড় বিষয়।
"এবার ৪৬টা কূপ খনন করবো দুই বছরে। আরো একশ কূপ খনন করবো পঁচিশ সালের মধ্যে। তাতে আমি আশাবাদী যে দুই বছরের মধ্যে আমরা আরো ৫শ মিলিয়ন যোগ করবো। কিন্তু ডিমান্ডতো আরো বেশি। দেড় হাজার এমএমসিএফ।”
গ্যাস অনুসন্ধান এবং জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় আশ্বাস দিচ্ছে ২০২৬ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে তাৎক্ষণিক সংকট মেটাতে জ্বালানি আমদানি করা ছাড়া উপায় নেই তবে সেটিও নির্ভর করছে ডলারের মজুদ, বিশ্ববাজারে দাম এবং দেশের আর্থিক সক্ষমতার ওপর ।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।