লগি-বৈঠার তাণ্ডবে লাশের ওপর নৃত্যকারী বাপ্পাদিত্য প্রতারণা মামলায় কারাগারে
Share on:
এই ধরনের সমাজবিরোধী ব্যক্তিদেরকে আওয়ামী ঘরানার একশ্রেণীর মানুষ, যারা বাম রাজনীতির দিকে ঝুঁকে আছে, তারা এদেরকে হিরো বানাতে চাইলেও এরা যে লুটেরা এবং প্রতারক সে বিষয়টি হাইলাইট করে না। অর্থঋণ মেরে দেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে কারাদন্ড দেওয়া হয়। গত ১৬ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতার করা হয়।
আসিফ আরসালান
ভেবেছিলাম আজ বাংলাদেশের সদ্যসমাপ্ত তথাকথিত নির্বাচন সম্পর্কে আমেরিকার সর্বশেষ অবস্থান নিয়ে কিছু লিখবো। কারণ ইতোমধ্যেই এই নির্বাচন সম্পর্কে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে সরকারি ও বিরোধী মহল শুধু নয়, দেশের বিভিন্ন স্তরে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে নতুন সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী এবং একজন পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রীর সাথে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দেখা সাক্ষাৎ। এর আগে নির্বাচনের ঠিক পরদিন প্রেস ব্রিফিংয়ের নামে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন একটি পিঠাপুলি খাওয়ার উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে পিটার হাস যান। তিনি গিয়ে দেখেন যে সাড়ে ৩০০ অতিথি বৈকালিক নাশতা গ্রহণের কাজে ব্যস্ত। নাশতার আইটেমের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সনাতনী কিছু পিঠা। পিটার হাস বুঝতে পারলেন যে, এটা আসলে কোনো প্রেস ব্রিফিং নয়। প্রেস ব্রিফিংয়ে সাড়ে ৩০০ মেহমান থাকতে পারে না। আধা ঘন্টা অবস্থানের পর তিনি ঐ অনুষ্ঠান থেকে চলে আসেন। এটি ছিল ইলেকশনের ঠিক পরের দিন অর্থাৎ ৮ জানুয়ারি সোমবার। এই অনুষ্ঠানে মি. হাসের যাওয়া নিয়ে মৃদু আলোচনা হয়েছিল। এরপর নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পিটার হাস এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারা কুক অংশগ্রহণ করেন। তাদের এই অংশগ্রহণ নিয়েও কিছু কথা ওঠে। বলা হয় যে, যেখানে আমেরিকা বিবৃতি দিয়ে বলেছে যে ৭ জানুয়ারির ইলেকশন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি, সেখানে সেই ইলেকশনের ভিত্তিতে গঠিত মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে তারা যান কিভাবে? কিন্তু সেই আলোচনাও সহসাই থেমে যায়।
কিন্তু এরপরে ঘটে বড় দুটি ঘটনা। একটি হলো তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের অফিসে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গমন। দ্বিতীয়টি হলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদের সাথে তার অফিসে পিটার হাসের সাক্ষাৎ। পলকের সাথে সাক্ষাতের পর মি. হাস বেরিয়ে আসেন এবং সাংবাদিকদের সাথে কোনো কথা বলতে অস্বীকার করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত চলে গেলে মন্ত্রী পলক বলেন যে, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বাংলা-মার্কিন সহযোগিতা কিভাবে আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত করা যায় সে ব্যাপারে তারা কথা বলেছেন। এই বক্তব্যেও কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এরপর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদের সাথে দেখা করেন। সংবাদপত্রের রিপোর্ট মোতাবেক, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসে এবার পিটার হাসই বলেন যে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক আরো গভীর করা এবং বর্তমান সম্পর্ককে কিভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেই বিষয়টি নিয়ে তারা আলোচনা করেন। পিটার হাস নাকি আরো বলেন যে, বাংলাদেশের সাথে আরো গভীর ও ব্যাপক বিস্তৃত সম্পর্কের অপেক্ষায় রয়েছে আমেরিকা।
তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দেখা সাক্ষাৎ এবং কথিত বক্তব্য নিয়ে আলোচনা এবং সমালোচনার ঝড় উঠেছে। শুধু তাই নয়, সরকার বিরোধী গণতন্ত্রকামী শিবিরের মধ্যেও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে এবং আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিএনপি এই লেখা পর্যন্ত পিটার হাসের বক্তব্যের ওপর কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। একইভাবে জামায়াতে ইসলামীও ঐ সময় পর্যন্ত কোনো বক্তব্য দেয়নি। বিরোধী শিবিরের অপর জোট গণতন্ত্র মঞ্চ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কিন্তু ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তাদের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ হতাশা ব্যক্ত করেছেন। আবার কেউ কেউ নাম গোপন করার শর্তে বলেছেন যে, নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের ৩৬ ঘন্টার মধ্যে ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ সময় রাত আড়াইটায় এবং আমেরিকান সময় বেলা দেড়টায় মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর স্পষ্ট ভাষায় বলে যে, বাংলাদেশে একটি নির্বাচন হয়েছে, ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল মেজরিটি পেয়েছে। পরবর্তী বাক্যে তারা বলে যে, এই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। সেই দেশের রাষ্ট্রদূত কেমন করে ঐসব কথা বলতে পারেন সেগুলো নিয়েও অনেক জল্পনা-কল্পনা চলছে। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, জাতিসংঘ হাসিনাকে টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় কংগ্রাচুলেট করেছেন। এছাড়া ১৮ জানুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্রদূতের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।
॥ দুই ॥
এই জল্পনা-কল্পনার সম্পূর্ণ অবসান ঘটতে কিছু সময় লাগবে। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাতেই কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন যে, আমেরিকা যদি আগের অবস্থান থেকে ইউটার্ন করেই থাকে তাহলে এনডিআই এবং আইআরআই এবং ইইউ নির্বাচন কমিশনের নিকট থেকে ফলাফলের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ চায় কেন? আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক্যাল পয়েন্ট এখানে জড়িত। সেটি হলো, নির্বাচন কমিশন যখন তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ রেজাল্ট দিতে চায় তখন তারা সারা দেশের প্রতিটি কেন্দ্রের আওয়ার বাই আওয়ার অর্থাৎ প্রতি ঘন্টার ফলাফল জানতে চায়। প্রতি ঘন্টায় নির্বাচনী ফলাফল ড্যাশবোর্ডে যেভাবে আপলোডেড হয়েছে সেইটি তারা চায়। এক্ষেত্রে যেসব সার্ভার থেকে এসব ফলাফল আসছিল সেই সব সার্ভার ঐসব টেকনিক্যাল টিম নাকি পরীক্ষা করতে চায়। এত টেকনিক্যাল ডিটেইলস আমরা বুঝি না। কিন্তু ঢাকার সবগুলো প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যায় যে, এসব প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। আমরা এটুকু বুঝেছি যে এই বিতর্কের চূড়ান্ত অবসান হতে সময় লাগবে। তাই আমরা আজ আর ঐ বিষয়ে আলোচনায় গেলাম না। আমরা তার বদলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। বিষয়টি হলো বাপ্পাদিত্য বসুর গ্রেফতার। খবরটি শুনে অনেকে হয়তো চমকে উঠবেন। কিন্তু খবরটি সত্য এবং চাঞ্চল্যকর। আসুন, সেই খবরে যাই।
ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের ১৮ জানুয়ারির শেষ পৃষ্ঠায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটির শিরোনাম, Ex-Chatra Maitri president Bappaditya Basu arrested on pending on conviction. অর্থাৎ কারাদন্ড প্রাপ্ত প্রাক্তন ছাত্র মৈত্রীর প্রেসিডেন্ট বাপ্পাদিত্য বসু গ্রেফতার। খবরে বলা হয়েছে, যশোরে একটি মামলায় ছাত্র মৈত্রীর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বাপ্পাদিত্য বসুকে আদালত ৩ বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন। কিন্তু বাপ্পাদিত্য বসু তার আগে থেকেই পলাতক। তাই তার বিরুদ্ধে গ্রেফাতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এই গ্রেফতারি পরোয়ানার অধীনে গত ১৭ জানুয়ারি বুধবার ঢাকার নিউমার্কেট এলাকা থেকে র্যাব তাকে গ্রেফতার করেছে।
এই সেই বাপ্পাদিত্য বসু যে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে অনুষ্ঠিত জামায়াতের ইসলামীর বিশাল জনসভায় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সহায়তায় ঐ জনসভায় প্রকাশ্যে হামলা চালায়। যদিও বাপ্পাদিত্য বসু সিপিবি ঘরানার পান্ডা, কিন্তু ঐ সময় বিএনপি এবং জামায়াতকে মোকাবেলা করার জন্য ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন এক হয়ে যায়। কারণ তাদের প্যারেন্ট সংগঠন আওয়ামী লীগ ও সিপিবি এক হয়ে কাজ করে।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের ৩/৪ দিন আগে এক জনসভায় শেখ হাসিনা তার ঘরানার লোকজনদেরকে লগি ও বৈঠাসহ ঢাকায় আসার আহ্বান জানান। শেখ হাসিনার নির্দেশে লগি-বৈঠা হাতে নিয়ে শত শত আওয়ামী ও বামপন্থী সন্ত্রাসী ঢাকায় আসে। রমনা ভবনের সামনে অবস্থিত আওয়ামী লীগের সমাবেশে যোগদানের পর লগি-বৈঠাধারী সন্ত্রাসীরা হাজার হাজার লোকের সামনে প্রকাশ্যে জামায়াতের সভায় হামলা করে। তৎকালীন জামায়াতের আমীর মরহুম মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন। জামায়াত সূত্র দাবি করেন যে, মাওলানা নিজামী ঐ মঞ্চ থেকেই পুলিশের তৎকালীন আইজিকে সভায় নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। অথচ পুলিশের আইজি হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। পুলিশের প্রকাশ্য নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে বাপ্পাদিত্যের নেতৃত্বে আওয়ামী সিপিবি সন্ত্রাসীরা সভায় ভয়াবহ হামলা করে। তাদের লাঠিপেটায় ৭ জন জামায়াত শিবির কর্মী তৎক্ষণাৎ নিহত হন। পাষন্ড বাপ্পাদিত্য বসু নিহত ব্যক্তিদের লাশের ওপর বীভৎস নৃত্য করে। পল্টন থেকে দৈনিক বাংলার মোড় পর্যন্ত যখন পুলিশের টিয়ার গ্যাসে আচ্ছন্ন তখন অসংখ্য আওয়ামী সিপিবি সন্ত্রাসীকে জামায়াতের সভাস্থলে নারকীয় তান্ডব করতে দেখা যায়। এভাবে খুনি বাপ্পাদিত্য বসু আওয়ামী সিবিপির চোখে হিরো হয়ে ওঠে। ২০১২ সালে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে জামায়াত নেতা মরহুম আব্দুল কাদের মোল্লার বিচার নিয়ে যে গণজাগরণ মঞ্চ করা হয় সেখানে আওয়ামী ঘরানা যে অরাজকতার সৃষ্টি করে সেখানেও সেই অরাজকতার অন্যতম হোতা ছিল এই বাপ্পাদিত্য বসু।
॥ তিন ॥
কর্তৃপক্ষীয় সূত্রে জানা যায়, অর্থঋণের তিনটি মামলায় বাপ্পাদিত্য বসুকে ৩ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। কারাদন্ড পাওয়ার পর থেকেই সে ছিল পলাতক আসামী। নিউ মার্কেট এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতারের পর যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়। পরে পুলিশ আদালতে সোপর্দ করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা যায় যে, ছাত্র জীবন শেষ করার পর বাপ্পাদিত্য যশোরে চরমপন্থীদের নিয়ে একটি জঙ্গী গ্রুপ গড়ে তোলে। তার মামা পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) দুর্ধর্ষ ক্যাডার ছিলেন।
দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো এই যে, এমন একজন ব্যক্তিকে শুধুমাত্র অন্ধ বিএনপি-জামায়াত বিদ্বেষের কারণে আওয়ামী ঘরানার মিডিয়া পাবলিসিটি দিয়ে নেতৃত্বের লাইমলাইটে নিয়ে আসে। সে ২০০২-২০০৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হয়। অভিযোগ রয়েছে যে, ক্লাসে অনুপস্থিতি এবং পরীক্ষা না দেওয়ার কারণে তার ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়। অসমর্থিত খবরে জানা যায় যে, পরবর্তীতে সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যলয় থেকে পাস কোর্সে বিএস পাস করে।
গভীর পরিতাপের বিষয় এই যে, এই ধরনের সমাজবিরোধী ব্যক্তিদেরকে আওয়ামী ঘরানার একশ্রেণীর মানুষ, যারা বাম রাজনীতির দিকে ঝুঁকে আছে, তারা এদেরকে হিরো বানাতে চাইলেও এরা যে লুটেরা এবং প্রতারক সে বিষয়টি হাইলাইট করে না। অর্থঋণ মেরে দেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে কারাদন্ড দেওয়া হয়। গত ১৬ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতার করা হয়। এখন সে কারাবাস করছে। অথচ এমন একটি খবর বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত গণমাধ্যম ব্ল্যাকআউট করেছে। অথচ ইংরেজি দৈনিক এই খবর ছাপার সময় তার ছবিও প্রকাশ করেছে।
সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম