মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ২০, জানুয়ারী ২০২৪

সরকারের তোষামোদ আর মোসাহেবি : ড. আসিফ নজরুল

Share on:

সরকারের সমালোচনা না করা হলে, ভিন্নমত সমাজে না থাকলে কোন দেশের কী পরিণতি হয়, তার উদাহরণ আমাদের আশপাশে রয়েছে।


আমি প্রায়ই সরকারের সমালোচনা করি। সেটা যে অন্যায্য নয়, তা মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝতে পারি। যেমন ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের তিন দিন পর বিবিসি বাংলার একটি আলোচনায় অংশ নিলাম। অনলাইনে হাজার পাঁচেক মন্তব্য করা হলো এটি নিয়ে; এর প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে প্রশংসাসূচক।

আমি এতে অবাক হইনি। কে না জানে, বাংলাদেশের মতো সমস্যাপীড়িত দেশে সরকারের প্রতি মানুষের অসন্তুষ্টি (অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি) থাকে বেশি। সরকারের ওপর রাগ থাকলে মানুষ ভোট দিয়ে এর উত্তর দেয়। সেই ভোট দেওয়ার অধিকারই না থাকলে মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের বাহন হয়ে ওঠে ভিন্নমতাবলম্বীরা। কাজেই আমার মতো কারও প্রতি প্রশংসা যতটা না আমার কৃতিত্ব, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে সরকারের ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া।

সমালোচনা করা নিজে যে খুব উপভোগ করি তা নয়। আমারও ইচ্ছা করে সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করতে। দুর্নীতির অভিযোগে সমালোচিত স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সরিয়ে সরকার সামন্ত লাল সেনের মতো একজন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসককে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বানিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, এটি প্রশংসা করার মতো কাজ। বিভিন্ন অভিযোগ ছিল—এমন মন্ত্রীদের মধ্যে আরও দু-একজনকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বা কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে সরানো হয়েছে। এগুলো জেনেও ভালো লেগেছে।

তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে কিছুদিন আগে মেট্রোরেলে চড়ে। আমি ১৫ থেকে ২০টি দেশের মেট্রোরেলে চড়েছি। তারপরও নিজ দেশের মেট্রোরেলে চড়ে মুগ্ধ হয়েছি। রাজধানী শহরের যানজটের ভোগান্তি এবং অর্থনৈতিক মাশুল লাঘব করতে এটি বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। এর আগে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পদ্মা সেতু আর কর্ণফুলীর টানেলে গেছি। কমবেশি সবকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে হয়েছে।

এর পাশাপাশি গত ১৫ বছরে সরকার আরও কিছু ভালো কাজ করেছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অনেক সম্প্রসারণ হয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি চাহিদা বহুগুণে মেটানো গেছে, বিনিয়োগবান্ধব কিছু নীতি ও বিশেষ জোন তৈরি করা হয়েছে, আইটি খাতেও উন্নতি হয়েছে। গত বছর হজ করতে গিয়ে বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনায় উন্নতি দেখে খুব ভালো লেগেছে।

এসব বলে থেমে যেতে পারলে কিছু লোক খুশি হতো, সরকার সন্তুষ্ট হতো। কিন্তু বিনা প্রশ্নে একতরফা প্রশংসা তোষামোদকারীদের কাজ। সরকারের তোষামোদকারীর অভাব নেই, বরং দিনে দিনে নানান সুবিধা পেয়ে এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এমনকি রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিযুক্ত ব্যক্তিদেরও কেউ কেউ আইন ও আচরণবিধি ভেঙে সরকারের তোষামোদে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে।

সরকারের তোষামোদ আর মোসাহেবির তাই প্রয়োজন নেই বলে মনে করি। সরকারের প্রয়োজন বরং সমালোচনাকারীর, নির্মোহ দৃষ্টিতে ভালোমন্দ আলোচনা করতে পারে—এমন মানুষের।

২.

সরকারের জন্য আরও বেশি প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে এই কাজ করার দায়িত্ব হচ্ছে জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর (ফরমাল ইনস্টিটিউশন অব অ্যাকাউন্টেবিলিটি)। সেটা অনুযায়ী সংসদে যদি প্রকৃত বিরোধী দল থাকত, সংসদীয় কমিটিগুলো ঠিকমতো কাজ করত, বিচার বিভাগ স্বাধীন হতো, বিভিন্ন কমিশন (দুর্নীতি দমন, মানবাধিকার, তথ্য) সরকারের লোকজনের ওপর জোরালো নজর রাখত, তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারকে অনেক বেশি নিষ্ঠাবান থাকতে হতো।

এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে রয়েছে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের মতো ইনফরমাল ইনস্টিটিউশন অব অ্যাকাউন্টেবিলিটি। এখানেও রয়েছে নিপীড়নমূলক আইনের নানা নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারের পক্ষে নানা বেআইনি চাপ প্রয়োগের সুযোগ। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার কারণে সমালোচনার কাজটি নাগরিকদের বেশি করে করতে হবে।

সরকারের সমালোচনা না করা হলে, ভিন্নমত সমাজে না থাকলে কোন দেশের কী পরিণতি হয়, তার উদাহরণ আমাদের আশপাশে রয়েছে। সে রকম কোনো দেশ গঠন করার জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আমরা চীন, কম্বোডিয়া বা ফিলিপাইনের মতো রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা ঘুণাক্ষরেও বলিনি।

আমরা তখন মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি ভোটাধিকার, বহুদলীয় গণতন্ত্র, বাক্‌স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলেছি। আমরা সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে বৈষম্যহীনতা, শোষণমুক্তি আর দুর্নীতির মূলোৎপাটন বুঝিয়েছি। ১৯৭২ সালের সংবিধান আর গণপরিষদ বিতর্কে এসব বলা আছে খুবই স্পষ্ট করে। এসবের ব্যত্যয় দেখলে নাগরিকদের প্রতিবাদ করার অধিকারের কথাও সেখানে স্বীকৃত হয়েছে জোরালোভাবে।

সরকারের প্রশংসা করার পাশাপাশি তাই ভিন্নমতের চর্চাও সমাজে রাখতে হবে। প্রশংসা করার কাজেও প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকতে হবে। সমাজে বহু দল, বহু মত, বহু পথ রাখতে হবে। এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

৩.

সরকারের প্রশংসামূলক বিভিন্ন কাজে প্রশ্ন করার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করি। যেমন মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, পদ্মা সেতুর মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাজগুলোর কথা বলি। আমরা পত্রিকায় বহুবার পড়েছি, এসব প্রকল্প নির্মাণে ব্যয় হয়েছে এমনকি উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি এবং এতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এই অভিযোগগুলোর কোনো তদন্ত হয়নি।

বলা বাহুল্য, এসব প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের করের টাকায়। বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি বিরল দেশ, যেখানে প্রত্যক্ষ করের (যেমন আয়কর) তুলনায় পরোক্ষ করের (যেমন মূল্য সংযোজন কর) পরিমাণ বেশি। তার মানে হচ্ছে, এসব প্রকল্পে সমাজের উচ্চবিত্তদের তুলনায় অন্যদের অবদান অনেক বেশি। কাজেই এসব প্রকল্পে দুর্নীতির মানে হচ্ছে সাধারণ মানুষের অর্থ কতিপয় ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া। পদ্মা সেতুর মতো স্থাপনা দেখে মুগ্ধ হওয়ার সময়, এতে কেন এত বেশি ব্যয় হলো, কারা এতে লাভবান হলো—এসব প্রশ্ন মনে আসা তাই স্বাভাবিক। প্রশ্নগুলো যদি কেউ তোলে, তাহলে তার প্রতি রুষ্ট না হয়ে সরকারকে সদুত্তর দিতে হবে।

আমি সামন্ত লাল সেনের মন্ত্রী হওয়ার প্রশংসা করেছি। একই সঙ্গে এ প্রশ্নও কাঁটার মতো মনে বিঁধছে, তিনি কি সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন? আমি জানি, সরকারের লোকজন বলবেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলে কী করার আছে তাঁদের? কিন্তু আমার প্রশ্ন, ২০১৮ সালের নৈশ নির্বাচনের পর দলীয় সরকারব্যবস্থায় নির্বাচনে কারও আস্থা রাখা উচিত কি? তা ছাড়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের গণহারে সাজাদান (এবং গ্রেপ্তার ও হয়রানি) ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আপিল চলাকালে নির্বাচন করতে পারবে না—হাইকোর্টের সাম্প্রতিক এই রায়ের পর দলটির অবাধ অংশগ্রহণের সুযোগ আর ছিল কি?

সরকার এখন ৪১ শতাংশ ভোট পড়ার কথা বলে এটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল দেখাতে চাইছে। কিন্তু এই সংখ্যা অনেকের মতে অবিশ্বাস্য এবং এর মধ্যেও রয়েছে শিশু ভোটারসহ জাল ভোটদানের বহু তথ্য। রয়েছে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগও।

উন্নয়ন আর সাফল্যের অধিকাংশ পর্বে রয়েছে এমন বহু প্রশ্ন। ভয়ভীতি দেখিয়ে এসব প্রশ্ন ধামাচাপা দেওয়া যায়, কিন্তু তাতে প্রশ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না। সরকারের বরং বোঝো উচিত, চারদিকে সুসময়ের মাছিদের গুনগুন শব্দের মধ্যে কিছু বাস্তবতার কণ্ঠ থাকা জরুরি।

৪.

তোষামোদ তৃপ্তিকর কিন্তু এটি ক্ষতিকর। কারণ, এতে তোষামোদকারীদের প্রতিদান ও দায়মুক্তি দিতে হয়, সরকারও বিভ্রান্ত হয়। ভিন্নমত অস্বস্তিকর কিন্তু এটি লাভজনক। কারণ, এতে সরকার কিছুটা হলেও পথের দিশা খুঁজে পায়।

তোষামোদকারীরা স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ভিন্নমতপোষণকারী আর প্রতিবাদীরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল। এরশাদ আর এক-এগারোর সরকারের আমলে গণতন্ত্রের সংগ্রামের সময় একই ঘটনা ঘটেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হলে আমাদের তাই ভিন্নমতকে লালন করতে হবে।