মিয়ামি পুনর্মিলন ভেঙেছে সীমান্ত
Share on:
আমি সেদিন অবাক হয়েছিলাম মারিয়া এবং তার প্রিয় বান্ধবী হ্যানসনের মানবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ দেখে। মনে হচ্ছিল সেদিন ‘জীবে দয়া করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’ আনালোই মারিয়ার বান্ধবীর পাসপোর্টে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রওয়ানা দিলো স্টকহোম আরলান্ডা টু মিয়ামি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, ফ্লোরিডাতে।
রহমান মৃধা, সুইডেন, থেকে:
বেশ বড় কয়েকটি দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে কিউবা। কিউবার দক্ষিণে জ্যামাইকা ও দক্ষিণ-পূর্বে হাইতি। আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হলে আটলান্টিক মহাসাগর। পশ্চিমে মেক্সিকো উপসাগর এবং আরও পশ্চিমে মেক্সিকো। বিশ্বমঞ্চে কিউবা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর দেশ নামেই পরিচিত। তিনি প্রচার করেন সমাজতন্ত্রের সাম্যবাদ। বেশিরভাগ জনগণ তার মতবাদকে স্বাগত জানান। পুঁজিবাদের মোড়ল আমেরিকার ঠিক পেটের ভেতরে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ বেড়ে উঠবে, এটা কল্পনা করা যায় না।
ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও তার মতবাদকে যেসব কিউবান মেনে নিতে পারেননি, তারা ছেড়েছেন কিউবা, ছেড়েছেন প্রিয়জন, নিয়েছে আশ্রয় ভিন্ন দেশে, নতুন জীবনের আশায়।
হাভানার দুই নতুন প্রজন্ম আলেক্স ও আনালোই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন, একে অপরের প্রেমে আসক্ত। তাদের স্বপ্ন ফ্লোরিডাতে যেতে হবে নতুন জীবনের সন্ধানে, যেখানে খুঁজে পাবেন স্বাধীনতা ও মানবতার মৌলিক অধিকার। কিন্তু ফ্লোরিডাতে তো ঢোকা কঠিন? কী করা? পরিকল্পনা হলো আনালোইকে প্রথমে সুইডেনে পাঠানোর। এক বছর টাকা জমিয়ে আনালোইকে সুইডেনে পাঠানো হয়েছে দালালের মাধ্যমে। এক মাস হতে চলেছে আনালোই সুইডেনে।
এরই মধ্যে আনালোই জানতে পেরেছেন, সুইডেনে তার পারমিশন হবে না, বসবাস করতে পারবেন না। তাই মন খারাপ। আলেক্সকে ছেড়ে একাকী জীবনে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এসেছেন ডাক্তারের কাছে। ঠিক একই সময় সহধর্মিণী মারিয়াও এসেছেন। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতেই ভাষাগত সমস্যার কারণে ঠিকমতো তার সমস্যা বোঝাতে পারছেন না। তিনি ইংরেজি বা সুইডিশ জানেন না, স্প্যানিশ ভাষায় চেষ্টা করছেন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু কেউ কারও কথা বুঝতে পারছেন না। এমতাবস্থায় ডাক্তার মারিয়াকে দোভাষী হিসেবে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেন।
আনালোই মারিয়ার সাহায্যে আপ্লুত হন এবং স্বল্প সময়ের পরিচয়ে তাদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়। সুইডেনে থাকার ব্যবস্থা না হওয়ার কারণে মারিয়া তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন এবং তার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আনা হ্যানসনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আনালোই দেখতে অনেকটা হ্যানসনের মতো, শুধু চুল ও চোখের রং শুধু ভিন্ন। হ্যানসন আনালোইয়ের সব জানতে পেরে তার পাসপোর্ট দিয়ে বলল, তুমি দেখতে যখন আমার মতো, তাই পুলিশের কন্ট্রোল ছাড়াই সুইডেন থেকে চলে যেতে পারবে।
তাছাড়া সুইডেন থেকে বের হতে সচরাচর পুলিশের চেক হয় না। তোমার চুলের রং কালো, তাই লম্বা চুলকে কালার করলে এবং চোখে ব্লু-রংয়ের লেন্স লাগালে কোনো অসুবিধা হবে না।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আনালোই স্টকহোম থেকে সরাসরি মিয়ামিতে (মিয়ামি, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের একটি শহর) যাবে সুইডিশ হিসেবে।
আমি সেদিন অবাক হয়েছিলাম মারিয়া এবং তার প্রিয় বান্ধবী হ্যানসনের মানবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ দেখে। মনে হচ্ছিল সেদিন ‘জীবে দয়া করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’ আনালোই মারিয়ার বান্ধবীর পাসপোর্টে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রওয়ানা দিলো স্টকহোম আরলান্ডা টু মিয়ামি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, ফ্লোরিডাতে।
আনালোই মিয়ামি বিমানবন্দরে নাসতেই বাথরুমে ঢুকে সুইডিশ পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে কাঁচি দিয়ে চুল কেটে ছোট করেন, চোখের লেন্স ফেলে দিয়ে তার কিউবার পাসপোর্ট এবং নিজের চেহারায় ফিরে ইমিগ্রেশনে হাজির কিউবান হিসেবে। পুলিশের সন্দেহ থাকার কথা নয়, কারণ, পারফেক্ট স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলা থেকে শুরু করে সবকিছু ঠিকঠাক। পুলিশের প্রশ্ন কীভাবে কোথা থেকে এবং কোনো এয়ারলাইন্সে তিনি এলেন? আনালোই পুলিশকে জানিয়েছেন, দালালের মাধ্যমে এবং তাদের সহায়তায় তিনি এসেছেন। ১৯৯৬ সালের কথা, নিয়ম অনুযায়ী যদি কোনো কিউবান আমেরিকার বর্ডারে একবার ঢোকেন, তবে তাকে ফেরত দেবার নিয়ম নেই বিধায় আনালোই ঢুকে গেলেন সেদিন ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকাতে।
খবর পৌঁছে গেল হাভানাতে, আলেক্স খুশি যে তার বান্ধবী ঢুকেছেন আমেরিকাতে। এখন আলেক্সের পালা। আনালোইয়ের আমেরিকান গ্রিন কার্ড রেডি হতে সময় লাগবে কয়েক বছর। আর দেরি নয়, রিস্ক নিতে হবে। ভালোবাসার পুনর্মিলনের জন্য জীবন দিতে বাধা নেই আলেক্সের। রাতের আঁধারে আলেক্স প্ল্যান করেছে ছোট্ট নৌকা করে সাগর (হাভানা থেকে কি-ওয়েস্টের দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার) পাড়ি দেবে।
আটলান্টিক এবং গালফ অব মেক্সিকোর সমন্বয়ে এই সাগর, যার মধ্যে রয়েছে হাঙ্গর, তারপর রয়েছে সাগরে বর্ডার গার্ড পুলিশ। সবকিছু জেনেশুনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতের আঁধারে ভালোবাসার ওপর বিশ্বাস করে এই প্রেমিক রওনা দিলো সেদিন তার প্রেমিকার সান্নিধ্য পেতে, যে বসে আছে পথ চেয়ে কি-ওয়েস্টের সাগরপারে। দীর্ঘ তিন দিন তিন রাত ছোট্ট নৌকায় করে পথ চলতে তিনি দেখেছিলেন ক্ষুধার্ত হাঙ্গর, ভয়কে জয় করেছিলেন শুধু ভালোবাসা দিয়ে এবং শেষে ঢুকেছিলেন প্রথমে কি-ওয়েস্টে এবং পরে তার প্রিয় বান্ধবী আনালোইয়ের মনের মধ্যে। কিছু ঝামেলা হয়েছিল ইমিগ্রেশনের শুরুতে, পরে সব ঠিকঠাকমতো হয়ে যায় এবং দুজন তাদের ভালোবাসার জীবন খুঁজে পায় একে ওপরের মাঝে।
আমাদের সঙ্গে আলেক্স এবং আনালোইয়ের অতীতের স্মৃতি থেকে যোগাযোগ এখনও রয়েছে। আলেক্স ও আনালোইয়ের আমেরিকাতে পারমিশনের এক বছর পরে (১৯৯৮) গিয়েছিলাম বেড়াতে তাদের বাড়িতে। দুজনই প্রকৌশলী, সুন্দর জীবনযাপন করছেন তাঁর আমেরিকাতে। আমাদের পেয়ে তারা হয়েছে দিশাহারা, মনে হচ্ছে ভালোবাসার ঋণ শোধ করতে এমনটি আয়োজন। এমন কৃতজ্ঞতাবোধ অনুভব করিনি এর আগে কখনো। কারণ, উপকার তো নিজের আপনদেরও করেছি, কিন্তু তারা কেন অকৃতজ্ঞ হলো? ভাবনায় এসেছিল ক্ষণিকের তরে সেদিন!
তারপর অনেকবার আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য, শহরে বেড়িয়েছি, কাজের সুবাদে, ছেলে-মেয়ের টেনিসের সুবাদে; ছোট বোন জলি থাকে লস এঞ্জেলসে, সেই সুবাদে। তবে ছেলে-মেয়ের টেনিসের সুবাদে মিয়ামি ভ্রমণ করেছি বহুবার। যেমন একবার মিয়ামি ট্যুর শেষে আমরা সবাই গিয়েছিলাম বড় ভাই মান্নান মৃধার বন্ধু ফিরোজ ভাই ও সালমা ভাবির বাড়ি টাম্পাতে। টাম্পা মিয়ামি থেকে গাড়িতে চার ঘণ্টার পথ। তারা থাকেন টাম্পার ফোর্ট মায়ারে।
ওয়েস্ট পাম বিচ থেকে সকাল সকালে গাড়িতে করে রওনা দিয়েছি, পথে হঠাৎ দেখি রাস্তার দুই ধারে লেক বয়ে চলেছে এবং শত শত এলিগেটর বা কুমির পাড়ের ওপরে মনের আনন্দে সূর্যের তাপে বিশ্রামে মগ্ন। কুমিরের নাম শুনেছি এবং দেখেছি, সি-ওয়ার্ল্ডে বা বিশ্বের বিভিন্ন চিড়িয়াখানাতে ঠিকই কিন্তু এভাবে রাস্তার দুই ধারে শত শত কুমির এ জীবনে প্রথম দেখলাম। পথে হরেক রকম মজার মজার পশুপক্ষী দেখতে দেখতে চার ঘণ্টা পার হয়ে গেছে এবং আমরা হাজির টাম্পাতে।
ফোর্ট মায়ার সৈকতের সঙ্গেই ফিরোজ ভাই করেছে সুন্দর বাড়ি। আশেপাশে সবুজে ভরা। বাড়ির বাগানে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, নারকেল, লিচু, আখ, শাকসবজি— সবকিছুতে ভরা।
সবাই খুব আনন্দ–ফুর্তির মধ্যে আছি। ফিরোজ ভাই ও সালমা ভাবির আদর-যত্ন মুগ্ধ করে তুলেছে। ফিরোজ ভাই এবং সালমা ভাবী সুইডেনে এক কনফারেন্সে এসেছিলেন স্টকহোমে। তাই সবাই সবাইকে চেনাজানার কারণে মেলামেশাটা জমে উঠেছিল তখন।
ফোর্ট মাইয়ারের পারে গড়ে উঠেছে লি কাউন্টি শহর যেখানে ফিরোজ ভাইয়ের ক্লিনিক। আমরা শহর ঘুরতে হঠাৎ চোখে পড়ে গেল বিজ্ঞানী টমাস এডিসনের বাগানবাড়ি। এডিসন অন্ধকার জগতে আলোর সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন বাল্ব আবিষ্কার দিয়ে। টমাস এডিসনের আদি বসতবাড়ি ওয়েস্ট অরেঞ্জ, নিউ জার্সিতে। তবে জীবনের অনেক সময় এবং শেষের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন এই ফ্লোরিডাতে।
পাঠক কেন আজ হঠাৎ এসব কথা? দীর্ঘদিন ধরে আমি লেখালেখি করছি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে এবং তাদের বর্তমান সমস্যার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি নানাভাবে, যাতে করে তাদেরও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। প্রতিবন্ধী হতে পারে বা দিতে পারে পরিবর্তন করে গোটা বিশ্বকে, যদি তারাও একটু সহানুভূতি পায়। এমন ঘটনা পৃথিবীতে রয়েছে যা জানা বা অজানা থাকতে পারে।
যাই হোক না কেন, আজ বলব আমার ফোর্ট মাইয়ারে লি কাউন্টি শহরের ওপর গড়ে ওঠা টমাস এডিসনের রহস্যময় জীবনকাহিনির একটু অংশ এবং তার বাগানবাড়ি ভ্রমণের গল্পের সঙ্গে বাল্ব আবিষ্কার নিয়ে কিছু কথা।
টমাস আলভা এডিসন জন্ম ১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৭, মৃত্যু ১৮ অক্টোবর ১৯৩১। টমাস বিশ্বের মানব কল্যাণে এবং বিশ্বের কলকারখানাতে রেভল্যুশন সৃষ্টি করেছিলেন ইলেকট্রিক বাল্ব তৈরি করে। টমাস স্কুল জীবন শুরু করেছে। বেশিদিন না যেতেই স্কুলের শিক্ষক তার হাতে একটি চিঠি তুলে দিয়ে বলেছিল, ‘টমাস, চিঠিখানা তোমার মাকে দেবে।’
টমাস বাড়িতে এসে তার মার হাতে চিঠি দিতেই মা তৎক্ষণাৎ পড়তে শুরু করেন। টমাসের মায়ের চোখ ভরা জল যা শুধু ঝরছে। চোখে জল দেখে টমাস মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার চোখে জল কেন? তুমি কাঁদছ কেন? কী এমন কথা লিখেছে যে তুমি কাঁদছ?’ মা চোখ মুছে টমাসকে বলে, বাবা আমার গর্ব লাগছে তোমার শিক্ষকের চিঠি পড়ে।
কী লিখেছেন শিক্ষক? লিখেছেন তুমি তোমার স্কুলের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র, তারা তোমাকে যুগোপযোগী এবং তোমার প্রয়োজন মতো শিক্ষা দিতে পারবেন না। কারণ, তেমন যোগ্যতাসম্পন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তাদের নেই, এমনকি যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকও নেই। তাই তারা লিখেছে, আমি তোমার একমাত্র শিক্ষক এবং মা, যে পারবে তোমাকে সুশিক্ষা দিতে।
টমাস বলেছিল তার মাকে, তাহলে তো ভালোই হবে মা, আমি তোমার থেকে শুধু ভালোবাসা নয় এখন থেকে প্রশিক্ষণও পাব। কী মজাই না হবে! টমাস শুধু শিক্ষা নয়, সুশিক্ষা পেয়েছিল জীবনে। পৃথিবীর অন্ধকারকে আলোময় করেছিলেন তিনি ইলেকট্রিক বাল্ব তৈরি করে। অনেক বছর পার হয়েছে, তার মা মারা গেছেন। আজ হঠাৎ তার কেন একটু অস্থিরতা লাগছে, টমাস পুরনো স্মৃতিচারণার সঙ্গে খুঁজছে ঘরের অনেক পুরনো কাগজপত্র। হঠাৎ আলমারির কোণে তার নজরে পড়ে ছোটবেলা তাঁর মাকে দেওয়া শিক্ষকের সেই চিঠি। টমাস চিঠিখানা খুলে পড়তে অবাক, হতভম্ব এবং দিশাহারা হয়ে পড়েন। মা যা তাকে বলেছিল, তার কোনো কথাই তো এখানে লেখা নেই। স্কুলশিক্ষক লিখেছিল, তোমার ছেলে প্রতিবন্ধী, সে খুবই দুর্বল সব বিষয়ে, তাকে দিয়ে শিক্ষা হবে না। তাই পারলে তুমি নিজেই তোমার ছেলের দায়িত্ব নাও। আমরা পারব না এমন গাধাকে শিক্ষা দিতে।
শিক্ষকের ওই কথা বিশ্বাস করেনি টমাসের মা সেদিন। স্কুলশিক্ষক সেদিন টমাসের জীবনের আলোর ইতি ঘটিয়েছিলেন কিন্তু টমাসের মা তা হতে দেননি সেদিন। বরং দিয়েছিলেন সেদিন হৃদয় ভরে বিশ্বাস আর আশ্বাস টমাসের জীবনে। এক বিস্ময়কর মা এবং তার চমৎকার নেতৃত্ব দিয়েছিল দ্বীপ জ্বেলে টমাসের জীবনে।
ফোর্ট মাইয়ারে টমাসের বাড়িতে তার ডায়েরি পড়তে চোখের জল এসেছিল এবং মনে পড়ে গেল লাখো প্রতিবন্ধীদের কথা। অনেক মধুর স্মৃতি জড়িত রয়েছে এই শহরকে এবং মিয়ামিকে ঘিরে, তারপর অনেক দিন ধরে আলেক্স ধরেছে আমাদের নিয়ে যাবে কি-ওয়েস্টে, যেখানে প্রথম মিলন হয়েছিল দুজনার দুজনায়। আলেক্সের মুখে তন্ময় হয়ে শুনলাম তার হাভানা থেকে কি-ওয়েস্টে আসতে নৌকাভ্রমণের ভয়ংকর কাহিনি, শুনলাম সাগরের বর্ডারগার্ড পুলিশের সঙ্গে প্রথম দর্শনের বর্ণনা।
গত বছর এ সময় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে গেছি। এবার মেয়ে জেসিকা পরিকল্পনা করেছে ছুটিতে মিয়ামি ভ্রমণের। জেসিকার সঙ্গে তার সেই বাল্যবন্ধু ভেন্ডেলাও যাবে। এ খবরে ছোট বোন জলিও পরিকল্পনা করেছে আসবে মিয়ামিতে। এর মধ্যে আমার এলাকার এক ছোট ভাই, অমীয় দাশ (ফার্মাসিস্ট, ওষুধ প্রস্তুতকারক, বোকা রেতন, যুক্তরাষ্ট্র), সেও জেনেছে আমরা আসছি, সেও একটি ছোটখাটো প্ল্যান রয়েছে আমাদের ঘিরে। সব জল্পনা–কল্পনা শেষে গত ২৮ নভেম্বর সকালে গাড়ি করে স্টকহোম আরলান্ডা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই সুইডেনের কনকনে শীত সঙ্গে মারাত্মক তুষারপাতের কবলে পড়লাম।
যেমন ঠান্ডা তেমন বাতাশ এবং প্রচন্ড তুষারপাত, সব মিলে প্লেন ছাড়তে চার ঘণ্টা বিলম্ব। প্লেনে সবাই চুপচাপ বসে আছে, সঙ্গে আমরাও। চার ঘণ্টা দেরির কারণে কানেক্টিং ফ্লাইট কোপেনহেগেন থেকে বাতিল হয়ে গেল, স্টকহোমে থাকতেই। পরবর্তী ফ্লাইট সাড়ে তিনটায় কোপেনহেগেন টু মিয়ামি, এমনটি আশ্বাস দিয়ে প্লেন উড়াল দিল। যথা সময়ে কোপেনহেগেনে পৌঁছে ফাইনাল চেকআপ সেরে রওনা দিলাম মিয়ামির উদ্দেশ্যে। টানা ১০ ঘণ্টা পর মিয়ামি লোকাল টাইম রাত সাড়ে ৮টায় মিয়ামি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম।
উবার ধরে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে হাজির হতেই কেয়ারটেকার সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিল। সুইডেন থেকে মিয়ামির সময়ের ব্যবধান ৬ ঘণ্টা বিধায় মিয়ামির রাত ৮:৩০ আমাদের কাছে রাত আড়াইটা। কিছুক্ষণ ঘুমের পর উঠে দেখি সকাল ৯টা বেজে গেছে। বড় বড় জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি মহাশূন্যের ওপর বসবাস, যার একদিকজুড়ে রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের ভিউ, অন্য দিকগুলোজুড়ে রয়েছে আকাশছোঁয়া ভবন। সকালে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গেলাম খাবারের সন্ধানে, দেখার সন্ধানে, সাগরের সন্ধানে। এবারের ভ্রমণে জেসিকা আমাদের ট্যুর গাইড।
ছুটি শুরু হয়েছে কেনাকাটির মধ্য দিয়ে। কারণ, ওয়েদার মনঃপূত নয়, আকাশ মেঘে ঢাকা। সাগরে গোসল হয়নি আজ, তাই সারাদিন দোকান ঘোরা এবং কেনাকাটার মধ্য দিয়ে দিনটি গেছে। সবকিছুর দাম চড়া, যুদ্ধ এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণেই এটা হয়েছে। সবাই মোটামুটি কিছু না কিছু কিনেছে। ছোট বোন জলি এসেছে, সকালে মিয়ামি সৈকতে যাব এবং গোসল করব এমনটি পরিকল্পনাও রয়েছে। শপিংমল ছাড়াও শহরটি হেঁটে হেঁটে ঘুরেছি।
মাঝেমধ্যে ভিডিও করে ফেসবুকেও দিয়েছি। একটা জিনিস কিছুতেই মেলাতে পারিনি, সেটা হলো এত নারকেলগাছ অথচ ডাব পাওয়া দুষ্কর। তবে বটগাছের দেখা মিলেছে এখানে এসে। দেখে মনে পড়ে গেল ‘কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।’ নদীর পরিবর্তে আটলান্টিক মহাসাগর এটাই শুধু পার্থক্য। যাই হোক দিন শেষে সন্ধ্যা তারপর রাত, ডিনারের সন্ধানে। কে কী খাবে, এটা একটা জটিল বিষয়।
আমেরিকা যে মজার দেশ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেন বলছি একথা, জানুন তাহলে। সবাই এখন সাগর পার থেকে শুরু করে অলিতে–গলিতে হেলদি খাবারের ছোট–বড় রেস্তোরাঁ খুলেছে। ভাতের পরিবর্তে গম সেদ্ধ, নানা রকম ডাল এবং বিনস হলো এখন এ যুগের নতুন প্রজন্মের খাবার। স্বাদ-গন্ধের বালাই নেই, আমি যে খাবারগুলো ছোট বেলায় অপছন্দ করতাম, ঠিক সেই সব খাবার এখন হয়েছে অমৃত। যাই হোক, খাবার দেখে মনে কষ্ট পাচ্ছি, তবুও খেতে হবে তাই খাচ্ছি। দামের কথা নাইবা কই।
রাত ১০টা বেজেছে, সবাই ঘরে ঢুকেছি, কিছুক্ষণ পর দরজায় নক করার শব্দ শুনতে পেরেছি। দরজা খুলতেই দেখি ছেলে জনাথান। কী ব্যাপার বাবা, তুমি হঠাৎ? কোনো কিছু না জানিয়ে সরাসরি সাত সাগর আর তের নদী পার করে সরাসরি মিয়ামি? এ এক বিশাল সারপ্রাইজ বাবার আগমন। জনাথানকে আমি বাবা বলে ডাকি। মারিয়া, জেসিকা, জলি ও ভেন্ডেলা সবাই এক এক করে ড্রয়িং রুমে এসে হাজির, শুধু খুশি নয়, মহাখুশির বন্যা বয়ে চলেছে। হাজারও প্রশ্ন হঠাৎ জনাথানের আকস্মিক আগমনের কারণে।
জনাথান আমাদের ছেলে, সে এটিপি টেনিস খেলোয়াড়, হঠাৎ ইনজুরির কারণে খেলাধুলা বন্ধ বিধায় বাড়ি ছেড়ে ছুটিতে সময় কাটাতে হঠাৎ এসে হাজির মা–বাবা, ছোট বোনসহ তার প্রাণপ্রিয় ফুফু জলিকে সারপ্রাইজ দিতে এবং একসঙ্গে সময় কাটাবে বলে। জনাথনের আগমনে আমরা সবাই আপ্লুত।
পুরো পরিবার একত্রে এক মধুময় মুহূর্ত, যা শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করার মতো। ছুটির মধ্যে একদিন জেসিকা এবং ভেন্ডেলা জগদ্বিখ্যাত বাস্কেটবল ক্লাব মিয়ামি হিটসে বাস্কেটবল দেখেছে, আর জনাথান তার এক আমেরিকান বন্ধুর সঙ্গে লিওনেল মেসির ফুলবল খেলা দেখেছে ইন্টার মায়ামির আমেরিকান ক্লাবে।
এ ছাড়াও ছুটির পুরো একটা দিন বোকা রেতন শহর এবং শহরের সাগর সৈকতে অমীয় দাশ এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েছি। অমীয় এবং তার সহধর্মীনির আথিতিয়তা মুগ্ধ করেছে। বিদায় বেলায় মনে হয়েছে, ‘আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো।’
এবারের ভ্রমণ পারিবারিক ভ্রমণ হলেও কিছু কিছু বিষয় ছিল পুরনো এবং নতুন বন্ধুদের নিয়ে। হাভানার আলেক্স সেই নাছোড় বান্দা, আবার ধরেছে তাঁর সেই পুরনো দিনের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিতে। অতঃপর পরিকল্পনা করলাম সবাই মিলে একসঙ্গে গাড়িতে করে বেড়াতে যাব কি-ওয়েস্টে। পথে স্মৃতিচারণা করতে করতে এবং পুরানো সেই দিনের কথা শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম সেই প্যারাডাইস দ্বীপ কি-ওয়েস্টে। বইতে পড়েছি, আজ ইতিহাসের সামনে দাঁড়ানোর উপলব্ধি সে এক বিশাল ব্যপার। কি-ওয়েস্ট, আমেরিকার সর্বশেষ দক্ষিণের এলাকা। ছোট্ট একটি ভূখণ্ড, ফ্লোরিডার মূল ভূখণ্ড থেকে ১২৯ মাইল দূরে সাগরের মধ্যে। অসম্ভব সুন্দর একটি ড্রাইভওয়ে দিয়ে কানেক্ট করা হয়েছে কি-ওয়েস্টকে।
বামে আটলান্টিক, ডানে গালফ অব মেক্সিকো। একদম সামনের দূরে ক্যারিবিয়ান সি। ক্ষণিকের তরে স্বপ্নের রাজ্যে নীল জলের মধ্য দিয়ে পুলসিরাতের মতো একখান রাস্তা দিয়ে এ যেন হ্যাভেনের দিকে ছুটে চলা!
মজার ব্যাপার হলো কি-ওয়েস্ট পৌঁছনোর পর কিউবার হাভানা ছিল নিকটস্থ ভূখণ্ড। তবে খালি চোখে দেখা সম্ভব না। এই লম্বা স্থলভাগ একটি চিকন শলার মতো সাগরের ভেতর চলে গেছে। বিশাল দুই সাগরের মাঝ দিয়ে চলে গেছে ওভারসি হাইওয়ে। এই হাইওয়ে দিয়ে যেতে দুই সাগরের অগাধ নীল জলরাশির যে মোহনীয় রূপ দেখেছি, তা অতুলনীয়। মেঘের ওপরে সোনালি আকাশ, সূর্যের কিরণ পড়েছে সাগরে সেদিনের বিকেলে, সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য।
কি-ওয়েস্টের আরেকটি পরিচয় রয়েছে, সেটা হলো আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। এখানে রয়েছে তার সামার হাউস, যা এখন মিউজিয়াম এবং এক অপূর্ব আকর্ষণ বিশ্বজাতির জন্য। হেমিংওয়ের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর স্থানটির নাম আরও পরিচিত হয়ে উঠেছে। আলেক্স ও আনালোইয়ের প্রেমের নাম হতে পারত বেদনা কিন্তু অঢেল ত্যাগ, পরস্পরের ওপর বিশ্বাস আর আশ্বাসের সমন্বয়ে বেঁধেছে তারা ভালোবাসার সুখের ঘর। তাই কি-ওয়েস্টের প্রতি এত আকৃষ্ট হয়েছিলাম সেদিন। মায়াভরা মিয়ামি আর সাগর পথে আলেক্সের কি-ওয়েস্টের নৌকাভ্রমণ কেড়ে নিয়েছে মন।
স্মৃতির পাতা থেকে কিছু পুরোনো কথা লিখতে মনে পড়ে গেল আজ থেকে ২৮ বছর আগের কথা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, জীবনযুদ্ধের সংগ্রামে বেঁচে থাকার তাগিদে, ভালোবাসার টানে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বোন, মা-বাবা সবাইকে ছেড়ে কিউবার হাভানা থেকে ছোট্ট নৌকায় করে হাঙ্গরে ভরা সাগর দিয়ে প্রথমে কি-ওয়েস্ট, পরে মিয়ামি, ফ্লোরিডাতে এসেছিল এক প্রেমিক আটলান্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে। সেদিনের সেই পুনর্মিলন ভেঙেছিল সীমান্ত, দিগন্ত ও প্রশান্ত।
পরে গড়েছে ভালোবাসার বসতবাড়ি কি-ওয়েস্টের অদূরে আটলান্টিক মহাসাগরের পারে, মিয়ামিতে। বেঁধেছে প্রেমের ঘর ভালোবাসা আর বিশ্বাসের পর, এক সুখি পরিবার। আমাদের ছুটির দিনগুলো চলছে ভালোই যদিও রয়েছে ভ্রমণে আনন্দ ভ্রমণে বিষাদ, মত-দ্বীমত। সেক্ষেত্রে মানিয়ে চলতে এবং ছাড় দেওয়া শেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যা সবাই সুন্দর ভাবে ম্যানেজ করে চলছে। নানা জনের নানা সখ, নানা মত, সে বিষয়গুলো মাথায় রেখে ছুটির প্লান করা খুবই জরুরি যা আমার মেয়ে জেসিকা সুন্দর ভাবে ম্যানেজ করে চলছে। গতকাল গিয়েছিলাম ওয়েস্ট পাম বিচে। জনাথানের এক টেনিস বন্ধু থাকে সেখানে। দিনটির পুরো সময় কাটিয়েছি ‘দ্যা ব্রেকারস রিসোর্টে’। রিসোর্টের ভেতর এবং বাইরের সব কিছু দেখে মনে হয়েছিল সে এক অন্য জগৎ। আমাদের ছুটি শেষের পথে, সত্তর ফিরতে হবে ভাইকিং জাতির দেশে। যদিও যেতে মন নাহি চায়, তবুও যেতে হবে কোনো উপায় নাই। সূত্র: ঢাকামেইল।