মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ২৭, জানুয়ারী ২০২৪

গ্যাসসঙ্কট ও বিদ্যুৎখাত

Share on:

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই তীব্র গ্যাস সঙ্কট চলছে। মূলত, গ্যাস সেক্টরে লাগামহীন দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সঙ্গত কারণে জনজীবন যেমন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, একই সাথে কলকারখানায় উৎপাদনে নেমেছে বড় ধরনের ধস।


পুরো দেশই সঙ্কটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজনৈতিক সঙ্কটের পাশাপাশি দেশে অর্থনৈতিক সঙ্কটও তীব্রতা পেয়েছে। একই সাথে মূল্যস্ফীতি হয়েছে লাগামহীন। বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে পড়েছে ভাটির টান। অঞ্চলভেদে তীব্র গ্যাস সঙ্কটের কথাও কারো অজানা নয়। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কম থাকায় এই সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য ঋতু পরিবর্তন ও মৌসুমী বায়ুর প্রভাবকে তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। ফলে জনজীবনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ব্যাহত হচ্ছে দৈনন্দিন কাজকর্ম। একই সাথে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে কলকারখানার উৎপাদনেও। এমতাবস্থায় সঙ্কটের মুখে পড়তে যাচ্ছে জাতীয় অর্থনীতিও। বিষয়টি রীতিমত উদ্বেগের।

কোন নির্দিষ্ট এলাকা নয় বরং সারাদেশে গ্যাসের সঙ্কট ক্রমেই তীব্রতা পাচ্ছে। কোন কোন এলাকায় এই সঙ্কটটা রীতিমত অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, কনকনে ঠা-া ও কুয়াশার কারণে কুমিল্লা অঞ্চলে তীব্র গ্যাস-সঙ্কট দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন এলাকায় চুলায় গ্যাস জ¦লছে না। কোনো কোনো এলাকায় রাত আটটা পর্যন্ত গ্যাস থাকছে না বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এতে সমস্যা হচ্ছে গৃহস্থালিতে। এমনকি গ্যাস-সঙ্কটে শিল্পকারখানায়ও উৎপাদন মারাত্মকভাবে বিঘিœত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কোনো কোনো এলাকায় শীত এলেই মাসের পর মাস গ্যাস থাকে না। ফলে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এবারও সে ধারাবাহিকতাই অব্যাহত রয়েছে। 

এদিকে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (বিজিডিসিএল) সূত্র জানিয়েছেন, জাতীয় গ্রিডের পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় কুমিল্লা নগরে শীত মৌসুমে তীব্র গ্যাস-সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তার ওপর চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। তাপমাত্রা কমায় বাসাবাড়িতে পানি গরম করতে গ্যাসের ব্যবহার অনেকাংশে বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিজিডিসিএলের আওতাধীন কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এরমধ্যে পেট্রোবাংলা থেকে ২৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। ওই গ্যাসের মধ্যে ১৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বিদ্যুৎ খাতে ও ৯৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস শিল্পকারখানা ও গৃহস্থালি খাতে সরবরাহ করা হয়। তবে গত মঙ্গলবার গ্যাস পাওয়া গেছে ২৮৮ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ঘনফুট। বুধবার সকাল, দুপুর ও বিকেলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা নগরের অশোকতলা, কালিয়াজুরি, পশ্চিম বাগিচাগাঁও, রেইসকোর্স, ধর্মপুর, বিষ্ণুপুর, ছোটরা, দৌলতপুর, হীরাপুর, হজরতপাড়া ও শহরতলির জগন্নাথপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে চুলায় গ্যাস জ্বলেনি। বিকেলের দিকে চুলায় গ্যাস এলেও চাপ কম। মিটমিট করে জ্বলে। এতে কোনো কাজ হয় না। ফলে বিঘিœত হচ্ছে অত্র এলাকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বাখরাবাদ সূত্র জানাচ্ছে, কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার চাঁপাপুর এলাকায় ১৯৮০ সালের ৭ জুন বিজিডিসিএলের যাত্রা শুরু হয়। ২০০৮ সালের ১৭ নবেম্বর ওই কোম্পানিকে দ্বিখ-িত করে কুমিল্লায় বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ও চট্টগ্রামে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড নামকরণ করা হয়। ২০১১ সালের ৩০ জুন থেকে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড নামে যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠালগ্নে গ্রাহক কম থাকলেও এখন গ্রাহক বেড়েছে। বেড়েছে কলকারখানাও। ফ্ল্যাটবাড়ি বেড়েছে। কিন্তু গ্যাসের পাইপলাইন সেই অনুযায়ী বাড়েনি। কম ব্যাসের পাইপ দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। সঙ্গত কারণে সঙ্কট এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না বরং তা ক্রমেই তীব্রতা পাচ্ছে।

মূলত, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই তীব্র গ্যাস সঙ্কটের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেমন ব্যাহত হচ্ছে, ঠিক তেমনিভাবে উৎপাদনের ক্ষেত্রেও পড়ছে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব। এমনকি চলমান গ্যাস সঙ্কটের প্রভাব এবার বিদ্যুৎখাতেও পড়তে শুরু করেছে, যা রীতিমত উদ্বেগের। আসন্ন গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা যখন বাড়বে তখন এই সঙ্কট আরো তীব্র আকার নিতে পারে বলেও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিতে পারে বলে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে সতর্ক করে দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। ফলে জনমনে নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকার পরেও যেখানে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে আসন্ন গ্রীষ্মে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে রীতিমত উদ্বেগ-উৎকন্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরাও আশঙ্কা করছেন, গরমকাল শুরু হওয়ার আগেই বর্তমান গ্যাস সঙ্কটের সমাধান করতে না পারলে বিদ্যুতের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। ফলে সৃষ্ট বিদ্যুৎ বিভ্রাটে বাসা-বাড়ির ভোগান্তি ছাড়াও শিল্পকারখানার উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা। সরকারও বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছে। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে একাধিক ‘বিকল্প উপায় ভাবা হচ্ছে’ বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র। কিন্তু এসব দাবি সরকারের কথামালার ফুলঝুড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাস্তবসম্মত কোন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে চলমান সঙ্কটের কোন সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না।

অবশ্য বাসা-বাড়ি, কলকারখানার পর গ্যাস সঙ্কটে এবার বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, কারিগরি ত্রুটির কারণে কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে সরবরাহে বিঘœ ঘটছে। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। মন্ত্রণালয় বলছে, ‘এই পরিস্থিতিতে দেশের কিছু কিছু এলাকাতে খুবই স্বল্প সময়ের জন্য বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতে পারে। সম্মানিত গ্রাহকদের অনাকাক্সিক্ষত অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’

বস্তুত, বাংলাদেশের গ্যাসবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রায় ২০ শতাংশ জ্বালানিই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশনের পর পাইপলাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এই লক্ষ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীতে দু’টি ভাসমান টার্মিনাল রাখা হয়েছে। যেগুলো ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) নামেই বেশি পরিচিত। সংস্কারজনিত কারণে জাহাজ দু’টির একটি গত নবেম্বর থেকে সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। আর কারিগরি ত্রুটির কারণে সম্প্রতি অন্যটি থেকেও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে আকস্মিকভাবেই জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ কমে যায়। বিশেষ করে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে গ্যাসের সরবরাহ প্রায় পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি ওই এলাকার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতেও এর প্রভাব পড়ে। এমতাবস্থায় গ্রাহকদেরকে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক। তবে ২০ জানুয়ারি রাতেই কারিগরি ত্রুটির সমাধান করা হয়েছে। ফলে আপাতত বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আশঙ্কা নেই বলে জানানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘোষণা দেয়া হলেও তেমন কিছু আসলে ঘটেনি। তার আগেই সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। কিন্তু এমন দাবিকে শুধু ছেলে ভোলানো বলেই মনে করা হচ্ছে।

যদিও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত ২০ জানুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। পেট্রোবাংলাও নিশ্চিত করেছে, ফ্লোটিং স্টোরেজ ও রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট থেকে আবার জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। তবে পূর্ণ মাত্রায় গ্যাস সরবরাহ করতে আরো একটু সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলা সূত্র। ফলে আপাতত এই সঙ্কটের কোন সমাধান হচ্ছে না। জানা গেছে, শীতকালে বাংলাদেশে এমনিতেই বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে দৈনিক গড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন করা হচ্ছে প্রায় এগারো হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গরমকালে এই চাহিদা ব্যাপক পরিমাণে বেড়ে যাবে। এর আগে, গরমকালে সাধারণত ১৬ থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুতের চাহিদা দেখা গেলেও এবার সেটি সাড়ে ১৭ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে চলে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র। বিপুল পরিমাণ এই বিদ্যুতের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো থেকে।

পেট্রোবাংলার হিসাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের চাহিদাই হবে এবার দেড় হাজার মিলিয়ন ঘটফুটের মতো। তবে উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সার্বিক চাহিদা দুই হাজার ২৪০ এমএমসিএফডি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮০০ এমএমসিএফডি গ্যাস। অর্থাৎ গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের যে চাহিদা রয়েছে সেটির বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ৪০ শতাংশের মতো। কাজেই গ্যাসের বর্তমান সঙ্কট চলমান থাকলে আসছে গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ বিভ্রাট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘গরমকালে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যাবে। তখন যদি এই গ্যাসের সমস্যা থাকে, তাহলে গরমকালে বিদ্যুৎ বিভ্রাট প্রকট হবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডেফিনেটলি সেটার একটা নেতিবাচক ইফেক্ট পড়বে।’ এ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য সরকারের ভ্রান্ত নীতিকেই দায়ী করছেন আরেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, ‘আমদানি করব বলে আমরা নিজেদের গ্যাসক্ষেত্রগুলো অবহেলা করলাম। এখন শীতকালে চাহিদা কম থাকার পরেও আমরা গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি না।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, ভুল নীতির কারণে একদিকে যেমন গ্যাসের নিজস্ব (দেশের ভেতরে) উৎপাদন কমেছে, তেমনি অন্যদিকে আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে।

এখন ডলার সঙ্কটের কারণে অতিরিক্ত আমদানি করাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আগামীতে জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলা এবং আমদানি করে চাহিদা পূরণ করাই হবে দেশের বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমদানির ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা স্থবিরতা আছে। ফলে এই মুহূর্তে কোনো স্বল্পকালীন সমাধান নেই। এই জ্বালানি সঙ্কট যেটা, সেটা ডলারের সঙ্কট না কাটলে স্বল্পকালীন কোনো সমাধান নেই।’ এ অবস্থায় সরকারকে আগেভাগেই আসন্ন সঙ্কট মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশে সাধারণত গ্রীষ্মকালে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। এরই মধ্যে আবহাওয়াবিদরা পূর্বাভাস করেছেন, চলতি বছর গরমের মাত্রা আরো বাড়তে পারে। তাদের এই বক্তব্য সত্যি হলে গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা এবারে আরো বাড়বে। কিন্তু বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া দৈনিক উৎপাদন প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, গ্যাস সঙ্কটের কারণে এখনই অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন কম হচ্ছে, বেশ কয়েকটি বন্ধও রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আসছে গরমকালে সরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করবে কিভাবে? বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ‘বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে এবং আমরা সে অনুযায়ী পরিকল্পনাও করে রেখেছি।’

উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় এবার কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রতিটি সরকার বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। তার ভাষায়, ‘আমাদের বেজলোড কোল পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো চলে আসছে। আমরা নিজেরা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি, পাশাপাশি ভারত থেকেও বিদ্যুৎ নিচ্ছি। কাজেই সমস্যা হবে না।’

বাংলাদেশে বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করা হয়, যার একটি বড় অংশই আসে বিদেশ থেকে। ডলার সঙ্কটের কারণে কয়লা আমদানি করতে না পারায় গত বছর রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশ কিছু দিনের জন্য বন্ধও করে দেয়া হয়েছিল। তবে চলতি বছর এখন পর্যন্ত কয়লার সরবরাহ ঠিকই আছে বলে জানিয়েছে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু ডলার সঙ্কট বা অন্য কোনো কারণে সামনে যদি সরবরাহ ঠিক না থাকে, তখন কী হবে? এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য হচ্ছে, ‘এক্ষেত্রে আমাদের বিকল্প ভরসা হচ্ছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব যে গ্যাস আছে, সেখানে হয়তো কিছু রেশনিং করতে হবে।’ কিন্তু দেশে ইতোমধ্যেই যেখানে বাসা-বাড়ি ও শিল্পকারখানায় ভয়াবহ গ্যাস সঙ্কট চলছে, সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অতিরিক্ত গ্যাসের ব্যবহার কি সঙ্কটকে আরো তীব্রতর করবে না?

প্রতিমন্ত্রীর ভাষায়, ‘তখন আমাদের অন্য যে সোর্সগুলো আছে, যেমন সিএনজি পাম্প এবং শিল্পকারখানা-সেখানে হয়তো রেশনিং করব। জোন ভাগ করে সে অনুযায়ী আমরা দেবো, যদি পরিস্থিতি তেমন খারাপ হয়।’ এছাড়া জ্বালানি সঙ্কট সমাধানের জন্য সরকার বহুমুখী জ্বালানি ব্যবহার করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের মতো বিকল্প উৎস থেকে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে জোর তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই তীব্র গ্যাস সঙ্কট চলছে। মূলত, গ্যাস সেক্টরে লাগামহীন দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সঙ্গত কারণে জনজীবন যেমন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, একই সাথে কলকারখানায় উৎপাদনে নেমেছে বড় ধরনের ধস। যার প্রভাব আছড়ে পড়ছে বিদ্যুৎখাতের ওপর। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা গ্যাস সেক্টরে লাগামহীন দুর্নীতি বন্ধ, গ্যাস বিপণন-বিতরণ ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ এবং এতদবিয়ষক সরকারের নীতি পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। একই গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য নতুন নতুন গ্যাস কূপ অনুসন্ধান ও জরুরি ভিত্তিতে তা উত্তোলনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। অন্যথায় জনজীবনে নতুন করে বিপর্যয় নেমে আসবে; বিদ্যুতের অভাবে ব্যাহত হবে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড।

ইবনে নূরুল হুদা

সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম