ফাকা মাঠের ভোটে অস্বাভাবিকতা
Share on:
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একতরফা নির্বাচনের কারণেই কেন্দ্র ফাঁকা থাকছে। ইসির কর্তারা অবশ্য বলছেন, কেন্দ্রে ভোটার আনার দায়িত্ব তাদের নয়।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে ভোটার উপস্থিতির হার ৩৬ দশমিক ২৪ শতাংশ বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগের দুই ধাপে ইভিএমে উপস্থিতি কম থাকলেও, এবার বেড়েছে। চেয়ারম্যান পদে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান স্পষ্ট করেছে একতরফা নির্বাচন। আবার তিন পদেই কাস্ট ভোটে রয়েছে অস্বাভাবিক তারতম্য।
গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে সরবরাহ করা ফলাফল বিশ্লেষণে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। আগের দিন বুধবার ৮৭ উপজেলায় ভোট হয়। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একতরফা নির্বাচনের কারণেই কেন্দ্র ফাঁকা থাকছে। ইসির কর্তারা অবশ্য বলছেন, কেন্দ্রে ভোটার আনার দায়িত্ব তাদের নয়।
বুধবার ব্যালট পেপারে ৭১ উপজেলায় উপস্থিতির হার ৩৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। অন্যদিকে ইভিএমের ১৬ উপজেলায় ভোট পড়েছে ৩৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ইসির হিসাব অনুযায়ী, এবার নির্বাচনের প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় উপস্থিতির হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপে ১৫৬ উপজেলায় ভোট পড়ে প্রায় ৩৮ শতাংশ। উপজেলা ভোটে এবার কম ভোটার উপস্থিতির রেকর্ড হয়েছে।
গতকাল ইসি সচিবালয়ের প্রকাশিত তালিকায় দেখা যায়, তৃতীয় ধাপে সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে, ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এখানে জয়ী ও পরাজিত প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান অন্য সব উপজেলার তুলনায় কম। বিজয়ী আখতারুল ইসলাম পেয়েছেন ৬০ হাজার ৮০০; তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী রেজাউল হক বিপ্লব পেয়েছেন ৪৮ হাজার ৩১৫ ভোট। ২ লাখ ৬৬ হাজার ৬১ জনের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ১ লাখ ২১ হাজার ৫৮৬। কিন্তু ৮৭ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে লক্ষ্মীপুর সদরে। ৬ লাখ ১৯ হাজার ৬৪৫ জনের মধ্যে ভোট দিয়েছেন মাত্র ৮৪ হাজার ৫৪৭। ভোটের হার মাত্র ১৩ দশমিক ৬৪। এখানে ৬৯ হাজার ৭০৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত একেএম সালাউদ্দিনের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন মাত্র ৬ হাজার ৩৯৭ ভোট।
এ ধাপে অধিকাংশ উপজেলাতেই এমন একতরফা ফল দেখা গেছে। ফেনীর তিন উপজেলাতেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে বড় ব্যবধানে। সোনাগাজীতে ৮৬ হাজার ১৭১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন জহিরউদ্দিন মাহমুদ। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মজিবুল হক পেয়েছেন মাত্র ৭০৯ ভোট। ফেনী সদরে সোসেন চন্দ্র শীল ২ লাখ ১৩ হাজার ৮৯২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মঞ্জুরুল আলম পেয়েছেন মাত্র ৭ হাজার ৩০৯ ভোট। একইভাবে দাগনভূঞা উপজেলায় ১ লাখ ১৭ হাজার ১৫৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন দিদারুল কবির। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজন ভৌমিক পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ১৬৬ ভোট। তিন উপজেলাতেই প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন হয়েছে।
এ ছাড়া রাঙামাটির নানিয়ারচরে মাত্র ৬ হাজার ১৬৯ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলায় চেয়ারম্যান হয়েছেন ১৪ হাজার ৪৩৬ ভোটে। ২০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে পাঁচ উপজেলায়। আর ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ১৪ উপজেলায়।
তিন পদে অস্বাভাবিক তারতম্য
নাটোরের বড়াইগ্রামে চেয়ারম্যান পদে ভোট পড়েছে ৯২ হাজার ১৩৩। অথচ একই উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট পড়েছে ৯১ হাজার ৯০৪ ভোট। আর মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে পড়েছে ৯১ হাজার ৯৩৩। চেয়ারম্যান পদের সঙ্গে ভাইস চেয়ারম্যান পদের প্রদত্ত ভোটের ব্যবধান ২২৯ এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদের ব্যবধান ২০০। এ উপজেলায় ভোটার ২ লাখ ৪৪ হাজার ৬৩৮ জন।
চেয়ারম্যান পদে ৩৭ দশমিক ৫৭, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩৭ দশমিক ৬৬ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। একই চিত্র পাশের গুরুদাসপুর উপজেলায়। সেখানে চেয়ারম্যান পদে ৬১ হাজার ৩৫৮, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬১ হাজার ৩৬৫ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬১ হাজার ৩৩৯ ভোট পড়েছে। যদিও এ উপজেলার নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক প্রার্থী।
শুধু এই দুই উপজেলা নয়, তৃতীয় ধাপের ৭০ শতাংশের বেশি উপজেলায় তিন পদে ভিন্ন সংখ্যক ভোট পড়েছে। এভাবে একই নির্বাচনে তিন পদে ভিন্ন সংখ্যক ভোট পড়াকে অস্বাভাবিক মনে করছেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, তিন পদে একই সংখ্যক ভোট পড়ার কথা। কারণ একজন ভোটার কেন্দ্রে গেলে তিন পদের জন্য পৃথক তিনটি ব্যালট পেপার তাদের হাতে দেওয়া হয়। তারা ভোট দিয়ে তা ব্যালট বাক্সে রাখেন। ব্যালট বাক্সে জমা হলেও তা প্রদত্ত ভোট হিসেবে গণ্য হয়।
ওই কর্মকর্তাদের মতে, নানা কারণে বৈধ ও অবৈধ (বাতিল) ব্যালট পেপারের সংখ্যা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু প্রদত্ত ভোটের ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা হওয়ার কথা নয়। আর ভিন্ন সংখ্যা হলেও সেটার ব্যবধান বেশি থাকা অস্বাভাবিক।
চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভিন্ন ভিন্ন ভোট পড়ার অনেক উপজেলার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান। এ উপজেলায় ২ লাখ ৫৮ হাজার ৬৪৬ ভোটের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে পড়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৭১২ ভোট। ভাইস চেয়ারম্যান পদে পড়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৪০১ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে পড়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮৬ ভোট। একইভাবে প্রায় ৬৬টি উপজেলায় তিন পদে ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক ভোট পড়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কয়েক উপজেলায় ভোটের পার্থক্য খুবই কম। আবার কিছু কিছু উপজেলায় ভোটের পার্থক্য কয়েকশ।
এদিকে নির্বাচন ভবনে গতকাল যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন বিদায়ী ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম ও নবনিযুক্ত সচিব শফিউল আজিম। বিদায়ী ইসি সচিব জাহাংগীর আলম যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে। বিমানের এমডির পদ থেকে ইসিতে যোগ দিচ্ছেন শফিউল আজিম।
শফিউল আজিম জানান, তিনি সবসময় মুক্ত তথ্যপ্রবাহ এবং স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করেন। অবাধ তথ্যপ্রবাহে গণমাধ্যমকে বরাবরই সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে শফিউল বলেন, রাজনীতির ভেতরেই সবার বসবাস। গণতন্ত্র, সরকার, রাজনৈতিক দল ও জনগণ সবকিছু মিলিয়েই গণতন্ত্র। কাউকে আইনের বাইরে গিয়ে সেবা দেওয়া যাবে না।
সূত্র: সমকাল