আমি তখন ঘুমিয়ে ছিলাম
Share on:
রোম শহর পুড়ে যাওয়া আর নিরোর বাঁশি বাজানোর সাথে নির্বাচনে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং সিইসির ঘুমের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু এখানেই, রোম শহরটি পুড়ে ছাই হয়েছিল, আর সিইসির ঘুমের মধ্যে ১৭ কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে একটি একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী সরকার প্রতিষ্ঠার আয়োজন চলছিল।
মো: হারুন-অর-রশিদ
রোমান সাম্রাজ্যের অধিপতিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সম্রাট নিরো। রোম ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সময় বাঁশি বাজানোর জন্য তিনি কুখ্যাত হয়ে আছেন। প্রবাদটি এ রকম- ‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।’ সিইসি মহোদয়ের ভাতঘুমের মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নামের প্রহসনে। নির্বাচনটি ‘ডামি’ নির্বাচন হিসেবে ইতিহাসের কালো পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। আগে থেকেই ডামি ক্যান্ডিডেট দিয়ে সাজানো, পাতানো নির্বাচনটি এতটাই বিতর্কিত হয়েছে যে, শুধু বাংলাদেশের নয়; সারা দুনিয়ার গণতন্ত্রকামী সব দেশের মানুষের কাছে এই নির্বাচন স্বীকৃতি পায়নি। ডামি নির্বাচনের ফলাফল ও ভোটারের উপস্থিতির হার পূর্ব নির্ধারিত থাকলেও এটি ঘোষণা করতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন যে গোল বাধিয়ে ফেলেছে, সেটিই এখন দেশে-বিদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
নির্বাচনের দিন বিকেল ৪টায় ভোট শেষ হওয়ার পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সিইসি শুরুতে বলেন, ভোট পড়েছে ২৮ শতাংশ। পরে তাকে পাশ থেকে একজন সংশোধন করে বলেন, সংখ্যাটি ৪০ শতাংশ হবে। সিইসি তখন ভোটের হার ৪০ শতাংশ হতে পারে বলে জানান। ভোট পড়ার হার নিয়ে তার দেয়া ওই বক্তব্য নিয়ে মুহূর্তেই বিতর্ক শুরু হয়।
ডয়েচে ভেলের সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন সিইসিকে প্রশ্ন করেন, ‘নির্বাচনে ভোট দেয়ার হার নিয়ে একটি প্রশ্ন দেখা যাচ্ছে। আমরাও যখন বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরছিলাম, তখন কিন্তু দেখছিলাম বিশেষ করে ঢাকার কেন্দ্রগুলোতে...আমরা যে কয়টি কেন্দ্রে গিয়েছি- বনানী, মোহাম্মদপুর, শাহীনবাগ বা উত্তরার কিছু কেন্দ্রে খুব কম ভোট পড়েছিল ২-৩ শতাংশের মতো দুপুর ১২টা, সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। সেটি যে ৪০ শতাংশে এলো বা ৪০ শতাংশের কিছু বেশি এলো, এটি কি আপনার কাছে একটু বেশি মনে হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ঢাকার ১০টি, ২০টি বা ৫০টি সেন্টার ঘুরে আপনি সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবেন না। আরবান এলাকাতে এবং রুরাল এলাকাতে ভোটের চিত্রটা ভিন্ন। আর, এ বিষয়টি নিয়ে আমার মনে হয় বিতর্কের তেমন অবকাশ নেই। এখনো যদি কেউ মনে করেন যে, ভোটের হার আসলে অনেক কম, আমাদের ভোটের হার সর্বশেষে হয়েছে ৪১.৮ শতাংশ। আমি যখন ফোরটি পার্সেন্ট বলেছিলাম, প্রথম বলে ফেলেছিলাম ২৮ শতাংশ, সেটি হচ্ছে ২টা বা তার আগে, আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম (ইনকিলাব, ১১ জানুয়ারি-২০২৪)।’
আত্মপক্ষ সমর্থন করে ডয়েচে ভেলেতে দেয়া সিইসির এমন বক্তব্য শুনে বাউল শিল্পী কাঙালিনী সুফিয়ার সেই বিখ্যাত গানের কথা মনে পড়ে- ‘ঘুমাইয়া ছিলাম, ছিলাম ভালো জেগে দেখি বেলা নাই...। যার অধীনে ২৯৯টি আসনে নির্বাচন হচ্ছে অথচ তিনি দুপুরে আরামে ভাতঘুম দিচ্ছেন। একটি ডামি নির্বাচন আয়োজন এবং তার ফলাফল নিয়ে এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে, সুখনিদ্রায় তার একটুও ব্যাঘাত ঘটেনি। নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে। তখন তিনি নির্বাচন কেমন হয়েছে না হয়েছে সেটি না জেনেই তড়িঘড়ি করে বলে ফেলেছেন, ২৮ শতাংশের কথা। কিন্তু তার এই ঘুমের মধ্যে যে কত কিছু ঘটেছে সেটি তো তিনি জানেন না। তাই পাশ থেকে অন্য একজন সংশোধন করে দিলেন।
রোম শহর পুড়ে যাওয়া আর নিরোর বাঁশি বাজানোর সাথে নির্বাচনে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং সিইসির ঘুমের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু এখানেই, রোম শহরটি পুড়ে ছাই হয়েছিল, আর সিইসির ঘুমের মধ্যে ১৭ কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে একটি একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী সরকার প্রতিষ্ঠার আয়োজন চলছিল। ঘুম থেকে জেগে উঠে সিইসি তার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেন মাত্র। এই নিরেট সত্যটিও প্রকাশ পেল নির্বাচন কমিশন সচিবের মুখে। ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্রে, ইসি সচিব জাহাঙ্গীর জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ূন কবীরের সাথে আলাপের সময় বলেন, ‘যেয়ে ঘুমাইয়া যামুগা। এখানে বসে থেকে লাভ আছে? সবাই রেজাল্ট জানে। ৬৪ ডিসিদের মেসেজ আছে। ৬৪টি জেলার রেজাল্ট কী হবে সবাই জানে। পড়ে চলে যামুগা। ডিসিরা পাঠাইছে না। সব আছে। আমার কাছে আছে তো। এ সময় পাশে থাকা কর্মকর্তা ইসি সচিবের কানে কানে ফলাফল নিয়ে কিছু বলছিলেন। তখন ইসি সচিব বলেন, ‘বিতর্কিত বানাইয়া ফালাইছে।’
এই নির্বাচনের ফলাফল যে আগে থেকেই সাজানো তা প্রমাণ করার জন্য এর থেকে বেশি কিছু সাক্ষ্যের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
আমাদের সমাজের মুখোশ পরা ভণ্ড-চোর-বাটপাড়ের সংখ্যা এতটাই বেড়ে গেছে যে, তাদের দেখলে মনে হয় ভণ্ডরা ঘোরে সাধুবেশে। এই সাধুবেশী ভণ্ড-প্রতারকদের কথা শুনলে মনে হয় তাদের কথার পবিত্রতা ওলি-আউলিয়া পীর মাশায়েখদের কথার চেয়েও বেশি পবিত্র, বেশি নিষ্কলুষ। তাদের ভাবখানা এমন যে, চুরিবিদ্যা কোনোকালে তাদের স্পর্শ করতে পারেনি আর মিথ্যার সাথে কোনোকালে তো তাদের পরিচয়ই ঘটেনি। নিরেট ভণ্ডামির ছদ্মাবরণে ঢাকা এই মানুষগুলো ভুলেই যায় যে, তারা ১৭ কোটি মানুষের অধিকার রক্ষার পাহারাদার। কিন্তু তারা এমনই পাহারাদার যে, তাদের আরাম ঘুমের মধ্যেই মানুষের অধিকারগুলো লুণ্ঠন করা হয় আর তারা জেগে উঠে বলেন, সব ঠিক হ্যায়। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী যেমন রাষ্ট্রের চৌকিদার হিসেবে দাবি করা মোদি সরকারের দুর্নীতিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’। আমাদের দেশের সরকার, সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিচারালয়, নির্বাচন কমিশনসহ যেসব প্রতিষ্ঠান নাগরিক অধিকার রক্ষার কাজে জড়িত তারা সবাই মিলে যেভাবে নাগরিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত করছে, তাতে তাদের বেলাতেও বলতে হচ্ছে, ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’।
বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার বাসনা রাজনীতির ব্যাকরণকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। রাজনীতিবিদদের হাতে আর রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেই। রাজনীতি চলে গেছে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদের হাতে। একজন ব্যক্তির খায়েশ পূরণ করাই এখন গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্ব ও কর্তব্যে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনে কে জিতবে, কে হারবে, বিরোধী দলের কোন নেতাকে জেলে নিতে হবে, কার কত বছরের সাজা দিতে হবে সব কিছুই নির্ভর করে এক ব্যক্তির খেয়াল-খুশির ওপর। ওই এক ব্যক্তির খেয়াল-খুশি বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতনভোগী রাষ্ট্রযন্ত্রে নিয়োজিত হোমরা-চোমরা থেকে শুরু করে সবচেয়ে নিচু পর্যায়ের লোকরাও কম গলদঘর্ম হন না। এ কারণে অফিসের পাইক-পেয়াদা, থানার দারোগা-এসআই কেউ আর ওই এক ব্যক্তি ছাড়া বাকি এমপি-মন্ত্রীদের পাত্তা দিতে চান না।
রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তাব্যক্তিদের গলদঘর্ম হওয়ার বিনিময়ে রাষ্ট্র পাচ্ছে একটি একনায়কতান্ত্রিক সরকার। পারিশ্রমিক হিসেবে তাদের দেয়া হয় নানা রকম অবৈধ সুবিধা। একেকজন ক্ষমতার দম্ভে টইটুম্বুর। এমপি-মন্ত্রী তাদের কাছে হাতের মোয়া। এভাবে অফিস-আদালতেও একনায়কতান্ত্রিকতার বীজ ফুলে-ফলে প্রস্ফুটিত হচ্ছে। গোটা দেশের জনগণ তাদের হাতে জিম্মি।
রাষ্ট্র কি এভাবেই চলতে থাকবে? জনগণের প্রতিক্রিয়া কী? এবারের নির্বাচন নামের প্রহসনে জনগণ তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জনগণ ভোট প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের অধিকার চিরতরে বিলীন করার চেষ্টা চলছে। তাই তারা নীরব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, মাত্র ১৫-১৬ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। জনগণের এই নীরব প্রতিবাদ স্তব্ধ করার জন্য নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বাপের বেটার মতো কাজ করেছেন। তারা জনগণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভোটের হার দেখাতে পেরেছেন ৪১ শতাংশেরও বেশি। নির্বাচন কমিশনকে এই বীরত্বের জন্য জনতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। জনগণ তাদেরকে যে উপহার দেবে, তাই তাদের প্রাপ্য।
পরিশেষে বলতে চাই, এক ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠীর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য একটি সম্ভাবনাময় জাতিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি ফ্যাসিবাদের মোড়কে ঢেকে ফেলা হয়, তাহলে এই জাতির পরিণতি কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। দেশের জনগণ এখন আর দেশের সরকার, আইন-আদালত কারো ওপরই আস্থা রাখতে পারছে না। তবে, তারা মুক্তি চায়। কিন্তু তারা জানে না এই মুক্তির পথ কতদূর। কত কাঁটা বিছানো আছে এই পথে। তাদের মন-মগজে একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে, আর তা হলো- ‘চৌকিদার চোর হ্যায়!’
সূত্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত