আলোচিত তিশা-মুশতাক দম্পতি: গুড প্যারেন্টিং
Share on:
প্যারেন্টিংয়ের জনপ্রিয় আলোচনা হচ্ছে, বাচ্চাদের শুধু শেখাতে হবে। যা পাও সব মাথায় ঢেলে দাও। নিখিল বঙ্গের অধিবাসী জীবনের মূল্যবান সময়, অর্থ, শ্রম, শরীর, জান, প্রাণ, জ্ঞান, বিদ্যা, অভিজ্ঞতা দিয়ে শুধু ‘মানুষের মতো মানুষ’ বাচ্চাকাচ্চা তৈরির মাধ্যমে ‘সফল’ মা-বাবা হতে চাই। আর এতেই বাচ্চার সঙ্গে বাড়ে দূরত্ব। বেড়ে ওঠে তিশা বা সাবরিনার মতো সন্তান।
করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে কয়েক বছর আগে ডা. সাবরিনা চৌধুরী ও তাঁর স্বামী আরিফ চৌধুরী আলোচনায় এসেছিলেন। এক পর্যায়ে গ্রেপ্তার ও দণ্ডিত হয়ে কারাভোগও করেছেন। এর পর আরিফের ভাগ্যে কী ঘটেছে, জানি না। কিন্তু সাবরিনা জামিনে মুক্তি পেয়ে কারাজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লিখে, টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে আবার আলোচনায় এসেছেন।
বই লিখে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন খন্দকার মুশতাক আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী সিনথিয়া ইসলাম তিশা। মুশতাক মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির দাতা সদস্য থাকাবস্থায় কলেজটির একাদশ শ্রেণির ছাত্রী তিশার সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে নিয়ে গত বছর আলোচনায় আসেন। তিশার পরিবারের অভিযোগ, তাদের মেয়েকে ‘প্রেমের ফাঁদে ফেলে’ বিয়ে করেছেন মুশতাক। সাবরিনা ও তিশা-মুশতাক দম্পতি উভয়েই পৃথক ঘটনায় বইমেলায় গিয়ে হেনস্তার শিকার হওয়ার বিষয়টি এখন সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে আলোচিত বিষয়।
এই সাবরিনা ও তিশার আলাদা ভিডিও সাক্ষাৎকার দেখার সুযোগ হয়েছে সামাজিক মাধ্যমের সূত্রে। তাদের আলোচনায় প্যারেন্টিং নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। যেমন– সাবরিনা ও তিশা দু’জনেই মা-বাবার সঙ্গে তাদের মানসিক দূরত্বের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিশা মা-বাবার বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগও করেছেন। যে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে ষাটোর্ধ্ব মুশতাকের সঙ্গে প্রেম ও বিয়ের পরিণতিকে সম্পর্কিত করছেন। অপরদিকে, সাবরিনা মা-বাবাকে অভিযুক্ত না করলেও তাদের সঙ্গে নিজের বিযুক্তি, বন্ধুহীন থাকা, সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া এবং শুধু পড়াশোনার দিকে মনোযোগী করার চাপকে তুলে ধরেছেন। সাবরিনা ও তিশার অনলাইন সাক্ষাৎকারকে আমলে নিয়ে প্রশ্ন জাগে, প্যারেন্টিং মানে কী? শুধু সন্তানদের জন্ম দেওয়া, ভরণপোষণ, পড়াশোনা করানো আর সেই সুবাদে মা-বাবার ইচ্ছা সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া?
পৃথিবীতে যত রকম কাজ আছে প্যারেন্টিং; এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন। এক দিনও বন্ধ রাখা বা ছুটি নেওয়ার উপায় নেই। বাবা যদিও পারে, মায়ের ছুটি একেবারেই নেই। কাজটি প্রতিদিন যেমন আনন্দের মুখোমুখি দাঁড় করায়, তেমনই কখনও করে তোলে হতাশ, ক্লান্ত, বিরক্ত। তারপর হাজার হাজার গিল্ট ফিলিং তো আছেই। কারণ প্যারেন্টিং শুধু মা-বাবার একার বিষয় নয়। পরিবারের অন্যরাও জড়িত থাকে। জড়িত থাকে ছোট ছোট মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। জড়িত থাকে সমাজ ও রাষ্ট্র।
আপনি হয়তো হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছেন। বাচ্চার জন্য নানা সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করছেন। চেহারার দিকে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছেন না। দুপুরের ভাত হয়তো বিকেলে খাচ্ছেন কিংবা সকালে খাবারই খাচ্ছেন না। বাইরে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে বাচ্চার কাজেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন; তবুও কাছেপিঠের লোকজন সহমর্মী না হয়ে আপনার খুঁত বের করার চেষ্টা করতে ছাড়বে না। কেননা, অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় কোনো শখ আমাদের নেই। আর সন্তান-সন্ততি যদি সমাজ-সংসারে সমালোচনামূলক কাজ করে, তাহলে তো কথাই নেই।
আমাদের সমাজে প্যারেন্টিং সংক্রান্ত আলোচনায় যে কথাটি বেশি শোনা যায়, তা হলো বাচ্চারা ‘কাদামাটি’। যে আকার দিতে চাইবেন, সে আকারই ধারণ করবে। সুতরাং প্যারেন্টিং মানে এক অর্থে বাচ্চা ‘সাইজ’ করা। প্রচলিত অর্থে ‘মানুষ করা’ বা বাচ্চাদের নিজের মনের মতো তৈরি করতে চাওয়া। নিজের ইচ্ছা, পছন্দ, চিন্তা দিয়ে গড়ে তুলতে চাওয়া। আমরা প্রায়ই বলে থাকি, বাচ্চাকে ‘পারিবারিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।’ এই পারিবারিক শিক্ষাও এক অর্থে মা-বাবার চাওয়াকে মেনে নেওয়া। প্যারেন্টিং, পারিবারিক শিক্ষাবিষয়ক নানা তত্ত্ব সামাজিক মাধ্যমে ভেসে বেড়াতে দেখি। নিজে একজন মা হওয়া এবং প্যারেন্টিং নিয়ে গবেষণাকর্মে যুক্ত থাকার ফলে সেসব আগ্রহ নিয়ে পড়ি। বাস্তবে প্যারেন্টিংয়ের সোশ্যাল মিডিয়া থিওরি ও প্র্যাকটিসের মধ্যে রয়েছে মারাত্মক ফারাক। যেমন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বলা হয়, ‘ডিভাইস’ কত খারাপ। কিন্তু প্যারেন্টিং মানে শুধু ডিভাইস সরিয়ে বই হাতে তুলে দেওয়া নয়।
আপনি নিজে যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫ ঘণ্টা ডিভাইস নিয়ে পড়ে থাকেন, সেই ডিভাইস বাচ্চাদের হাতে থাকলেই তারা শেষ! ভেবে বলুন তো, একটা ৫ বছর বয়সী বাচ্চা এখন যা জানে, আপনি বইপত্র পড়ে ১৫ বছর বয়সেও কি তা জানতেন? বাচ্চারা স্কুলে বড় একটা সময় থাকে। সহপাঠী যখন নতুন গেমসের কথা বলে, তখন তার ইচ্ছা হয় ওই গেমস খেলতে। আমি-আপনি হয়তো লুডু খেলেছি, বউচি খেলেছি, গোল্লাছুট খেলেছি; বাচ্চাদের সোশ্যালাইজেশনের এই চাহিদাকে আপনি উপেক্ষা করবেন কেন?
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, প্যারেন্টিংয়ে বড় ফ্যাক্টর হলো বাচ্চার বয়স। বয়স আবার নানা ভাগে বিভক্ত। বাচ্চার শৈশবে আপনার প্যারেন্টিং যেমন হবে, কৈশোরে তা নয়। বাচ্চার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার প্যারেন্টিং বদলায়। গবেষণা আরও দেখায়, বয়ঃসন্ধিকালের বাচ্চা লালনপালন সবচেয়ে কঠিন। বাচ্চার স্কুল আরেকটা বড় ফ্যাক্টর। সেখানে বিভিন্ন পরিবার, শ্রেণি, ধর্মের বাচ্চার সম্মিলন ঘটে। তারা মেশে, অভিজ্ঞতা বিনিময় করে। সেই অভিজ্ঞতা পারিবারিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে নাও মিলতে পারে।
প্যারেন্টিংয়ের জনপ্রিয় আলোচনা হচ্ছে, বাচ্চাদের শুধু শেখাতে হবে। যা পাও সব মাথায় ঢেলে দাও। নিখিল বঙ্গের অধিবাসী জীবনের মূল্যবান সময়, অর্থ, শ্রম, শরীর, জান, প্রাণ, জ্ঞান, বিদ্যা, অভিজ্ঞতা দিয়ে শুধু ‘মানুষের মতো মানুষ’ বাচ্চাকাচ্চা তৈরির মাধ্যমে ‘সফল’ মা-বাবা হতে চাই। আর এতেই বাচ্চার সঙ্গে বাড়ে দূরত্ব। বেড়ে ওঠে তিশা বা সাবরিনার মতো সন্তান।
শুধু মা-বাবা-অভিভাবকরাই শেখাবে বাচ্চাদের? তাদের কাছ থেকে মা-বাবা-অভিভাবকদের কি কিছুই শেখার নেই? মা, শাশুড়ি, বাবা, শ্বশুর, ভাই, বোন, জা, বুয়া, পাশের বাসার ভাবি, অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সার, অপু-শাকিব, আ’লীগ-বিএনপি, হিরো আলমসহ সবাইকে একপাশে সরিয়ে প্যারেন্টিং বিষয়টা হাতে-কলমে, আনন্দ-বেদনায়, তর্ক করে, ঘুমের ভেতর মিষ্টি হাসি দিয়ে, ভালোবাসি মা বলে, ঘুম হারাম করে আমাদের শেখায় বাচ্চাকাচ্চাই।
আপনি সাবরিনা বা তিশার ঘটনাই যদি বলেন, মা-বাবার শ্রম ও অর্থের কী নিদারুণ অপচয়! তাহলে আমি পরামর্শ দেব– প্যারেন্টিং সংক্রান্ত ভাবনায় দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। কারণ সন্তান-সন্ততির কর্তাসত্তাকে অবজ্ঞা না করে বরং নিজেদের তাদের সময় ও ভুবনের উপযোগী করে তোলাও প্যারেন্টিংয়ের ক্ষেত্রে ভাবার বিষয়।
সাদিয়া আফরিন: নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক