মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ২০, জানুয়ারী ২০২৪

সরকার নিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে নড়াচড়া

Share on:

পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া শুধু বিবৃতিতেই সীমিত থাকবে? এর তলে তলে অন্য কিছু থাকতে পারে, সেটা অপেক্ষার বিষয়। কিন্তু, আপাতদৃষ্টিতে সরকার নির্ভার। কোনো ঝুটঝামেলাই ধরা পড়ছে না সরকারের চশমায়।


রিন্টু আনোয়ার

গুণমান-প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্য বা ধরন সব মিলিয়ে বাংলাদেশের এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি একেবারেই আলাদা। দেশের ইতিহাসে গত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটির সঙ্গেও এবারেরটির তুলনা চলে না। বিশ্বব্যাপী কূটনীতি পাল্টে গেছে। দেশে দেশে রাজনীতিও বদলে গেছে। গণতন্ত্রের ধাঁচও একেক দেশে একক রকম। যে যার দেশে সুবিধা মতো গণতন্ত্র বানিয়ে নিয়েছে। তার ওপর স্নায়ুযুদ্ধ গোটা দুনিয়ার কূটনীতি-রাজনীতির খোলনলচে বদলে দিয়েছে। সকালের শত্রুই সন্ধ্যায় বন্ধু। কর্তৃত্ববাদের মুখেই গণতন্ত্রের ছবক।

বাংলাদেশে স্থানীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রতিপক্ষকে কাবু করে নিজেকে এমন এক মাত্রায় নিয়ে গেছেন, যেখানে কেবল সরকার নয়, তাকে বিরোধী দলও ঠিক করে দিতে হয়। রাজনৈতিকভাবে এ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ। এটিকে তার সক্ষমতা খাস বাংলায় হেডম হিসেবে দেখার মানুষ আছেন। আবার কর্তৃত্ববাদ-স্বৈরাচার হিসেবে মূল্যায়নও আছে। বাংলাদেশে উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, চীনের আদলে একক কর্তৃত্বের নির্বাচন ও শাসন কায়েম হয়ে যাচ্ছে বলে সমালোচনা তো আছেই। এর মাঝেই তিনি সামনে ধাবমান। পেছনে বা দেশে-বিদেশে কে কী বলল তা কেয়ার করতে নারাজ। বিশ্বশক্তিগুলোর মনমর্জিও সেই সমান্তরালে। তার পক্ষে ছোট বড় বহু দেশ। বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

নির্বাচনের আগে থেকেই ধারা দুটি স্পষ্ট। নির্বাচনের আগেই বাংলাদেশকে ঘিরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দুটি পক্ষ। পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, রাজনৈতিক দমনপীড়ন নিয়ে ছিল সোচ্চার, অন্য দিকে চীন-রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশের পক্ষ থেকে ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারো হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান। নির্বাচনের পরও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে, সেটা নানা বিবৃতিতেই স্পষ্ট। ভারত, চীন, রাশিয়াসহ কয়েক দেশ নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফলের পরপরই শেখ হাসিনার টানা চতুর্থবারের বিজয়ে সন্তুষ্ট, উল্লসিত। এসব দেশের ঢাকাস্থ কূটনীতিকরা কেবল সমর্থন-বিবৃতি নয়, গণভবনে সশরীরে ছুটে যেতেও দেরি করেননি। বেসরকারি ফল প্রকাশের পরই রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কিছু দেশের রাষ্ট্রদূত শেখ হাসিনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, রিপাবলিক অব কোরিয়া, ব্রুনেই দারুসসালাম, মালয়েশিয়া, মিসর, আলজেরিয়া, কুয়েত, লিবিয়া, ইরান, ইরাক, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূতেরাও বাদ যাননি।

ভোটগ্রহণের আগে থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়েছে বলে মন্তব্য পাওয়া গেছে রাশিয়ার পর্যবেক্ষকের কাছ থেকে। দেশটির কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার আন্দ্রে ওয়াই শুটব বলেছেন, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের আয়োজনও চমৎকার ছিল। এই ঘোর সমর্থনের বিপরীতে অবস্থান জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের। তারা মনে করে, বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ না করায় হতাশা ব্যক্ত করে বিবৃতি প্রকাশ করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এই নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি। সব রাজনৈতিক দলের প্রতি সহিংস আচরণ পরিহারের আহ্বানও জানানো হয়েছে বিবৃতিতে। বিভিন্ন সহিংসতার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার আহ্বানও জানানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে। আর যুক্তরাজ্য বলেছে, এ নির্বাচনে বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মান পূরণ হয়নি। যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস- এফসিডিওর মুখপাত্র বিবৃতিতে ভোটের আগে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেন। বলা হয়েছে, ‘মানবাধিকার, আইনের শাসন ও যথাযথ প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অপরিহার্য উপাদান। নির্বাচনের সময় এসব মানদণ্ড ধারাবাহিকভাবে মেনে চলা হয়নি।’ সব দল অংশ নেয়নি বলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভোট দেয়ার যথেষ্ট বিকল্প ছিল না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের বিবৃতিতে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন মর্মাহত হয়েছে এ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ না নেয়ায়। নির্বাচনকালীন সহিংসতায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ। তাদের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র ফ্লোরেন্সিয়া সোটো নিনো জানিয়েছেন, বাংলাদেশ পরিস্থিতি উদ্বেগের সাথে পর্যবেক্ষণ করছেন মহাসচিব। এ ছাড়া, জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ওএইচসিএইচআর সম্প্রতি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে।

বিবৃতিতে সংস্থাটির প্রধান ফলকার টুর্ক বলেছেন, ‘ভোট শুরুর আগের কয়েক মাস হাজার হাজার বিরোধী সমর্থককে নির্বিচারে আটক করা হয়েছে বা ভয় দেখানো হয়েছে। এ ধরনের কৌশল সত্যিকারের আন্তরিক প্রক্রিয়ার জন্য সহায়ক নয়। এমন প্রতিক্রিয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য বা ইইউ কি সম্পর্ক ছিন্ন করবে? বিবৃতিতে কিন্তু, তেমন আভাস-ইঙ্গিত নেই। বরং মানবাধিকার, বাণিজ্য ও উন্নয়ন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা আছে। এও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে তারা সব রাজনৈতিক দলকে তাদের মতপার্থক্য দূর করতে এবং একটি অভিন্ন উপায় খুঁজে বের করতে উৎসাহিত করবে। বাংলাদেশের নবনির্বাচিত সরকারকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি দেশের প্রতিশ্রুতি নবায়নের পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার তুর্ক।
পক্ষে-বিপক্ষের সব প্রতিক্রিয়াকেই সরকার তার জন্য শুভ মনে করে। দেশে তার প্রতিপক্ষ নেই। আন্তর্জাতিকভাবে বিপক্ষরা নির্বাচনের সমালোচনা করলেও সরকারকে সমর্থন না দেয়া বা সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার মতো কোনো বার্তা দেয়নি।

স্বাভাবিকভাবেই সরকার এতে নির্ভার। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের সাথে সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাবে বা আরো উন্নত হবে এমন আশা করে সরকার। সেই মসলা সরকারের কাছে রয়েছেও। সরকার এবং তার ঘরানার কূটনীতিকরা মনে করেন, ভয়ের কিছু নেই। তাদের হিসাব একদম সোজা। ভারতের সাথে জাপানও অভিনন্দন জানিয়েছে। জাপান-ভারতকে ছাড়া গণতান্ত্রিক বিশ্ব ভাবা যায় না। আর যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের বিবৃতিও অনেকটা ভারসাম্যমূলক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ভোটের ২৪ ঘণ্টা পর নির্বাচন ‘অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না’ বলে উল্লেখ করলেও এগুলো খুব জোরালো দাবি ছিল না। বরং তাদের বিবৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কিভাবে ভোটপূর্ববর্তী অবস্থান থেকে সরে আসা যায় তার একটা ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। বিবৃতিগুলোতে ভাষার ব্যবহার এমনভাবে করা হয়েছে তাতে সমন্বয় বা সমতা তৈরির দিকে জোর দেয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। তারা নির্বাচন সুষ্ঠু-ফ্রি-ফেয়ার হয়নি বলেছে। ভায়োলেন্সের ব্যাপারে সরকার যেন ইনভেস্টিগেশন করে সেই তাগিদও দিয়েছে। সরকারের সাথে তারা কতগুলো বিষয়ে আগামীতে কাজ করে যাবে বলেও জানিয়েছে। ভায়োলেন্সের ব্যাপারে সরকারকে ইনভেস্টিগেশনের তাগিদটি বেশ ইন্টারেস্টিং। এতে ভায়োলেন্সের অপরাধে নির্বাচন বয়কটকারী বিএনপিকে আরো শায়েস্তা করার অপশন পেয়ে গেল সরকার। সরকারি মহলের এমন সোজা-সরল সমীকরণের বিপরীত নানা উপাদানও আছে। বাংলাদেশকে বৈশ্বিক মেরুকরণের একটি পার্ট করে ফেলা হলো কিনা- সেটি গুরুতর প্রশ্ন।

এ প্রশ্ন ও শঙ্কা নির্বাচনের আগে থেকে থাকলেও এখন তা আরো জোরালো হয়েছে। বড়দের লড়াইয়ে বাংলাদেশ এক পক্ষ হয়ে গেছে তা আর বলার-বোঝার বাকি নেই। বাংলাদেশের স্বার্থ অন্য কেউ দেখতে থাকা মানে নিজেদের বিপদ নিজেই ডেকে আনা। বাংলাদেশ তা কিভাবে সামলাবে- সে প্রশ্নের কিছুটা জবাব স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। নির্বাচনে জয় উপলক্ষে গণভবনে অভিনন্দন জানাতে আসা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেছেন, বিদেশী প্রভুদের পরামর্শ মেনে চললে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেউ টিকে থাকতে পারবে না। আমাদের কোনো প্রভু নেই বলে দাবি করেন তিনি। তাহলে ভারত, চীন, রাশিয়া কী? কারা? বন্ধু?

প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় : ‘বাংলাদেশের জনগণই আমাদের প্রভু ও শক্তি।’

বাস্তবতা কি তাই! এ প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী কূটনীতিতেও একের পর এক মাত করে চলেছেন। এর প্রমাণ চতুর্থবারের মতো ক্ষমতা নবায়নের আগেই চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপানসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের অভিনন্দনের জোয়ার। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কূটনীতির আরো হটস্পটে পরিণত হয়েছে। এই হটস্পটের হটচেয়ারে এরই মধ্যে পঞ্চম মেয়াদের জয় উপভোগ করতে শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নতুন মেয়াদে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক আরো জোরদার হবে বলে ভারতীয় হাইকমিশনার আশা প্রকাশ করেছেন। চীনের রাষ্ট্রদূতের ভাষা আরো মায়াবী ও চিত্তাকর্ষক। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে তিনি কেবল অভিনন্দনই জানাননি। বন্ধুত্ব এগিয়ে নেয়া, পারস্পরিক আস্থা বাড়ানো এবং সহযোগিতা আরো গভীর করতে চীন শেখ হাসিনার সরকারের সাথে কাজ করবে বলে জানান রাষ্ট্রদূত। এও বলেছেন, বাংলাদেশে কোনো বিদেশী হস্তক্ষেপ রুখে দিতে পাশে থাকবে চীন। চীনের রাষ্ট্রদূতের পর ঢল নামে অন্যান্য দেশের কূটনীতিকদের। রীতিমতো এলাহিকাণ্ড। রাশিয়া জানিয়েছে মহাতৃপ্তির কথা। সেখানে পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া শুধু বিবৃতিতেই সীমিত থাকবে? এর তলে তলে অন্য কিছু থাকতে পারে, সেটা অপেক্ষার বিষয়। কিন্তু, আপাতদৃষ্টিতে সরকার নির্ভার। কোনো ঝুটঝামেলাই ধরা পড়ছে না সরকারের চশমায়।

সূত্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত