মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শুক্রবার ৩, মে ২০২৪

মে দিবসের পাঁচালি

Share on:

ঘটনাটি প্রায় চার দশক আগের। সালটি মনে করতে পারছি না। তবে তারিখটি ছিল ১ মে। এরশাদ জমানার প্রথম দিক। মানুষ তখনো সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেনি। বরং এরশাদের সাইকেল চালিয়ে অফিস যাওয়া-হেলিকপ্টারে করে আটরশি যাওয়া এবং সামরিক পোশাক পরে সকাল-বিকাল তার মুখে নানারকম অরাজনৈতিক চটুল কথাবার্তা শুনে দেশবাসী এক অদ্ভুত সময় পার করছিল। তখন সংবাদপত্রের বেশ দাপট ছিল।


কবি-সাহিত্যিক, গায়ক-নায়কদের যথেষ্ট কদর ছিল। রাজনীতি থমকে ছিল- আর রাজনীতিবিদরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় নিদারুণ এক অবসর সময় কাটাচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ের ১ মে তারিখে আমি আমার এক বন্ধুকে নিয়ে রাজপথে বের হলাম। আমার বন্ধুটি আজ উঁচু সরকারি পদে রয়েছেন। সুতরাং তার নামটি সরাসরি উচ্চারণ না করে আজকের নিবন্ধে তাকে আমি আমিত সাহা বলে সম্বোধন করব।

যে সময়ের কথা বলছি তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম এবং স্যার এ এফ রহমান হলে থাকতাম। আর আমিত সাহা থাকত সূর্যসেন হলে। আমাদের দু’জনের মাসিক খরচ আসত পিতৃভাণ্ডার থেকে এবং মাসের শেষ সপ্তাহে তীব্র আর্থিক টানাটানির মধ্যে থাকতাম। টাকা পাঠাতে ২-১ দিন দেরি হলে কি যে বিচ্ছিরি একটা অবস্থা হতো তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। পকেট খালি থাকত। হলের দোকানে বাকি খাওয়ার জন্য অনেকে লাইন দিত। যাদের নাক উঁচু তারা শূন্য পকেটে অভুক্ত অবস্থায় হেসে খেলে ২-১ দিন কাটিয়ে দিত। অবস্থা বেশি খারাপ হলে কেউ কেউ বহু দূর হেঁটে কোনো আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে দুমুঠো অন্নের সংস্থান করে হিমালয় জয়ের /আবিষ্কারের আনন্দ নিয়ে হলে ফিরতেন।

ঘটনার দিন আমরা সকাল ১০টায় হল থেকে বের হয়ে কলাভবনের সামনে মিলিত হলাম। একটি কানাকড়িও ছিল না। কিন্তু মনের মধ্যে কেন জানি খুব ফুর্তি ফুর্তি ভাব ছিল। কলাভবন থেকে হেঁটে টিএসসি-শাহবাগ-জাতীয় শহীদ মিনার এবং প্রেস ক্লাব হয়ে যখন পুনরায় টিএসসিতে এলাম তখন পিপাসা-ক্ষুধা-ক্লান্তিতে দুনিয়াটিকে গদ্যময় মনে হতে থাকল। মে মাসের প্রচণ্ড রৌদ্রতাপ-রাস্তাজুড়ে অসংখ্য রঙ-বেরঙের মিছিল। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর গণসঙ্গীত, সেøাগান এবং নিজেদের শরীরের তারুণ্য মিলে এমন এক রসায়ন সৃষ্টি করেছিল যার কারণে মাথার ওপর ৪২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা, ফাঁকা পকেট, শূন্য পাকস্থলী ইত্যাদি কোনো কিছুই আমাদের দুই বন্ধুর চারটি ঠ্যাংকে দাবায়ে রাখতে পারেনি। কিন্তু টানা ৪ ঘণ্টা রোদের মধ্যে হাঁটাহাঁটির পর আমরা প্রায় জ্ঞান হারানোর পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম।

আমরা উভয়েই বুঝলাম আমাদের জন্য কিছু খাদ্য এবং পানীয় দরকার। উদাস দৃষ্টিতে চার দিকে তাকালাম। হঠাৎ একটি দৃশ্য দেখে খুশিতে আমার চোখ টগবগ শুরু করে দিলো। আমি দেখলাম অদূরে একদল স্বেচ্ছাসেবক রক্ত সংগ্রহ করছে। রক্তাদাতারা রক্তদান করছেন এবং তার পর দুটো সিঙ্গারা এবং এক বোতল কোকাকোলা দ্বারা আপ্যায়িত হচ্ছেন। আমি আমিত সাহাকে বললাম, চলো, রক্ত দিয়ে অন্যের প্রাণ বাঁচাই আর নিজেরাও বাঁচি। আমার কথা শুনে আমিতের মুখ কালো হয়ে গেল। চোখে মুখে রাজ্যের হতাশা-ভয় এবং আতঙ্ক ভর করল। বেচারা বিরস বদনে বলল- দোস্ত! ইনজেকশনকে আমি ভীষণ ভয় পাই। তা ছাড়া এখন আমার শরীরের যে অবস্থা, রক্ত দিলে তো মরেই যাবো। আমি তার পিঠ চাপড়িয়ে সাহস দিয়ে বললাম, আমি আগে দেবো। তুমি দেখবে। যদি বেশি ভয় পাও তবে দরকার নেই। আমরা সিঙ্গারা আর কোক ভাগ করে খাবো। আমিত রাজি হলো- আর আমি রক্ত দেয়ার জন্য শুয়ে পড়লাম।

ইনজেকশনে আমারও প্রবল ভয় ছিল, আর রক্তও আমি জীবনে দেইনি। দ্বিতীয়ত, রক্ত দেখলে আমার মাথা ঘোরে। এ কারণে জীবনে কোনো মুরগি জবাই তো দূরের কথা, জবাইয়ের দৃশ্যও দেখিনি। পশুপাখি জবাই আমার কাছে বীভৎস মনে হতো। এ জন্য বহুকাল পর্যন্ত আমি গোশত খাইনি। সুতরাং আমিতকে অভয় দিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম বটে কিন্তু আমার বুকের ধুকধুকানি এবং দাঁতের পাটির ঠকঠকানি তবলার মতো এক সঙ্গে বাজতে লাগল। পরিস্থিতি সামলে নেয়ার জন্য আমি চোখ বুঝলাম। কিন্তু স্থির থাকতে পারলাম না। আড়চোখে ইনজেকশনের সুইয়ের আকার আকৃতি দেখলাম। বেশ বড় সুই- সাধারণত গরুকে ইনজেকশন দেয়ার জন্য এই মানের সুই ব্যবহার করা হয়। সুতরাং আমার স্নায়বিক দুর্বলতা বাড়ল। কিন্তু এত লোকের সামনে তা প্রকাশ হোক সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না। সুতরাং দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সমর্পণ করে দিলাম।

আমার পালা শেষ হওয়ার পর আমিতকে রক্তদানের জন্য ডাকা হলো। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে রীতিমতো কাঁপছে। আমি তার হাত ধরে নির্দিষ্ট স্থানে নেয়ার সময় অনুভব করলাম যে, সতীদাহ প্রথা চালুকালীন সময়ে সহমরণযাত্রীর মধ্যে যে ধরনের ভাবাবেগ কাজ করত ঠিক তেমন অবস্থা সৃষ্টি হলো আমিত সাহের ক্ষেত্রে। সে ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল এবং তার চিন্তাশক্তি স্থবির হয়ে পড়েছিল। তার মুখমণ্ডল ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চোখ দুটো গোল হয়ে খাকিটা অশ্রুসিক্ত হলো এবং ফিসফিসিয়ে শুধু এতটুকু বলল- মরে যাবো না তো।

রক্তদান শেষে আমরা সিঙ্গারা ও কোকাকোলা পেলাম। ওগুলো খেতে গিয়ে নিজেদের বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার বলে মনে হতে থাকল। সিঙ্গারা যে এত সুস্বাদু হতে পারে এবং কোকাকোলা যে এত সুমধুর পানীয় হতে পারে তা সে দিনের তপ্ত দুপুরে আমরা যেভাবে অনুভব করেছিলাম তা বাকি জীবনে দ্বিতীয়বার ঘটেনি।

রক্তদান শেষে যে অনাবিল প্রশান্তি অনুভব করেছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না এবং সেই ঘটনা আমাদের একজন উত্তম এবং নিয়মিত রক্তদাতাতে পরিণত করেছিল। ফলে আজও রক্তদানের কোনো সুযোগ পেলে ছাতছাড়া করি না।

আজ চার দশক পর উল্লিখিত ঘটনা মনে পড়ল, ২০২৪ সালের ১ মের ঘটনার বাস্তব রূপ দেখার পর। সকালে উঠে পত্রিকার প্রথম পাতায় মহান মে দিবস নিয়ে তেমন কোনো খবর দেখিনি। কোনো কোনো পত্রিকার ভেতরের পাতায় খুবই গুরুত্বহীনভাবে সংক্ষিপ্ত আকারে মে দিবসের নামকাওয়াস্তে একটি প্রতিবেদন ছাপিয়েছে এবং মে দিবস উপলক্ষে পত্রিকা অফিস বন্ধ থাকবে এবং ২ মে পত্রিকা প্রকাশিত হবে না- এমন বিজ্ঞাপন বা ছুটির ঘোষণা ছাপানো হয়েছে। সকালে রাস্তায় বের হলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে আগের সেই ভিড় তো দূরের কথা সামান্য হইচইও নজরে এলো না। মিছিল মিটিং গণসঙ্গীতের পরিবর্তে পুরো এলাকায় বিরাজ করছে সীমাহীন নির্জনতা। আমার গাড়ি যখন টিএসসির গোল চক্কর অতিক্রম করছে তখন দেখলাম রাজু চত্বরে ৮-১০ জন তরুণ-তরুণী জটলা করে ছবি তোলার চেষ্টা করছে। তারপর দোয়েল চত্বর পেরিয়ে যখন প্রেস ক্লাব অতিক্রম করলাম তখন বেশ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনকে দেখলাম মেট্রোরেলের স্টেশনের ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে গতানুগতিক বক্তব্য দিচ্ছে।

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক দুরবস্থা এবং বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ দেশকাল সমাজের সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে। এবারের যে গরমের কথা বলা হচ্ছে যা কমবেশি আদিকালেও ছিল। কিন্তু অতীতে যত গরমই পড়–ক না কেনো তা মানুষের চামড়ায় তাপদাহ সৃষ্টি করত কিন্তু মন ও মস্তিষ্কে দহন সৃষ্টি করতে পারত না। কিন্তু বর্তমানকালে কেবল মানুষ নয়- প্রকৃতির সব প্রাণীর মনের পর্দা ছিঁড়ে গেছে। প্রাণীগুলোর মস্তিষ্কের যে রক্ষা দেয়াল তাও নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে প্রকৃতির চাপ তাপ দুর্গন্ধ কোলাহল হট্টগোল ইত্যাদি একই সাথে শরীর মন মস্তিষ্কে আঘাত হানে। এই অবস্থায় ২০২৪ সালের ১ মে তারিখের ৪২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা তিনগুণ হয়ে মানুষের ইহজগতের সব অনুভূতিকে তছনছ করে দিচ্ছে।

উল্লিখিত অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় আছে কিন্তু ছাত্ররা মে দিবসের অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের জন্য ৪০ বছর আগের মতো খালি পকেটে বের হচ্ছে না। কেউ আর্তদের জন্য যেমন রক্ত সংগ্রহ করছেন না, আর রক্ত দেয়ার জন্য যেকোনো ওসিলায় সেখানে রক্তদাতাদের পাওয়া যাচ্ছে না। গণসঙ্গীত তো দূরের কথা, পাখ-পাখালির কণ্ঠের ওপর কে বা কারা যেন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ফলে গত এক মাসের অধিক সময় ধরে কোনো কাকের কা কা শব্দ আমি শুনিনি। কুকুরের ঘেউ ঘেউ বন্ধ। বিড়ালের মিউমিউ গরুর হাম্বা ছাগলের ভ্যা ভ্যা ইত্যাদি এখন মানুষের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। মানুষের দৃষ্টিশক্তি যেসব নান্দনিকতা দেখে উজ্জীবিত হতে পারে এসবের পরিবর্তে যা দৃশ্যমান হয় তা মন-মস্তিষ্কে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাজারে গিয়ে মধ্যবিত্তের আহাজারি, দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর কান্না, পারিবারিক বন্ধন, পারস্পরিক মায়াদয়া বিলীন হয়ে উল্টো নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার নিত্যনতুন দৃশ্য যেভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোতে আঘাত হানছে, তার ফলে চলমান তাপদাহের যন্ত্রণা বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে।

উল্লিখিত অবস্থায় মানুষ ক্রমেই নিয়তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। আল্লাহর নারাজি এবং মানুষের কুকর্মের কারণে গজব আকারে জমিনে মারাত্মক গরম বৃদ্ধি পেয়েছে এসব কথা বলে প্রকৃত অপরাধ ধামাচাপা দিয়ে বেশির ভাগ মানুষ কোনো মতে হইলীলা সাঙ্গ করতে চাচ্ছে। গরমের পর ঝড় হবে, আবার ঝড়ের পর বৃষ্টি বন্যা হবে এবং সবশেষে তুষারপাতসহ প্রবল শীত আমাদেরকে আক্রমণ করে চিরহরিৎ নাতিশীতোষ্ণ মাতৃভূমিকে চরমভাবাপন্ন বানিয়ে ফেলবে- এসব কথা হরহামেশা আলোচিত হলেও কেন আমরা অনুভূতিহীন জাতিতে পরিণত হলাম এবং কেন আমাদের দৈনন্দিন জীবন ক্রমে দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে আর আমরা কেন বোবা প্রাণীর মতো আচরণ করছি তা অনুধাবন করার মতো শক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত চলমান পরিস্থিতি দিনকে দিন আরো খারাপ হতে বাধ্য।

  • গোলাম মাওলা রনি

সূত্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত