মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ২০, জানুয়ারী ২০২৪

ইরান পাকিস্তান সংকট কোন পথে?

Share on:

সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বলছে, মধ্যপ্রাচ্য একটি যুদ্ধের দ্বোরগোড়ায়, সব পক্ষই এরজন্য প্রস্তুত। এখন কারও একটা ভুল হিসাব প্রতিপক্ষের রেড লাইন অতিক্রম করলেই শুরু হবে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ।


ইরানে পাকিস্তানের হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ইরান ক্রমাগত বিভিন্ন দেশে হামলা চালালেও সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেশটিতে হামলা চালানোর সাহস কেউ করেনি। চার দশক আগে ইরাক-ইরান যুদ্ধের পর পাকিস্তানই প্রথম ইরানে হামলা করলো। ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ যখন গোটা মধ্যপ্রাচ্যকেই যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে আসছে, তখনই ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে এই পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটলো। 

সাম্প্রতিক এই উত্তেজনা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ম্যাট গের্টকেন বলেন, ভূ-রাজনীতি নিয়ে গবেষণার ১৭ বছরে আমি একটি বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি যে, এই দেশগুলোর উস্কানির মুখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অনেক কম। তাই কোনো দেশ শুধুমাত্র আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক থেকেই আরেক দেশে আক্রমণ চালাতে পারে। আর এই আক্রমণ শুধু সতর্কতামূলক না হয়ে, পূর্ণাঙ্গ মাত্রারও হতে পারে। 

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা বহুদিন ধরেই ছিল। গত ৭ই অক্টোবর হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এখন সেগুলো বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। হামাসকে নির্মূলের নামে গাজায় অকথ্য বর্বরতা চালাচ্ছে ইসরাইল। মুসলিম দেশগুলো সেখানে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কার্যত কিছুই করছে না। তবে এরইমধ্যে ইরান ও ইয়েমেন মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইসরাইল ও দেশটির পশ্চিমা মিত্রদের স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। 

ইয়েমেনের হুতি বাহিনী লোহিত সাগর দিয়ে চলাচল করা ইসরাইলি জাহাজগুলোকে টার্গেট করে আসছে।

বিজ্ঞাপনএরইমধ্যে ইসরাইলে যাওয়া-আসার পথে বহু জাহাজে হামলা চালিয়েছে তারা। এতে লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজ চলাচলে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ইসরাইলি জাহাজকে টার্গেট করার জবাব দিতে হুতির বিভিন্ন অবকাঠামোতে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি গত সপ্তাহ ধরেই এই হামলা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু তাতে হুতিরা থেমে নেই। তারা এখন অব্যাহতভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর জাহাজ টার্গেট করে চলেছে। 

তেলের বাজারে ঝড় উঠলে তাতে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে যুক্তরাষ্ট্র। সামনেই দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই নির্বাচনের আগে এই অস্থিরতা মেনে নেবেন না। তিনি তাই মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমাতে চাইছেন। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে গাজায় হামলা বন্ধে চাপ দিতে শুরু করেছে। বাইডেন ইসরাইলকে সতর্ক করে বলেছেন, হামাসের আক্রমণে ক্ষুব্ধ হয়ে ইসরাইল যে ভুল করছে যুক্তরাষ্ট্রও নাইন- ইলেভেনের পর ওই ভুল করেছিল। তিনি আল-কায়েদার টুইন টাওয়ারে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ও ইরাক অভিযানের কথা বুঝিয়েছেন। আজ যুক্তরাষ্ট্রের উভয় রাজনৈতিক দল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ একমত যে এসব যুদ্ধ বড় ভুল ছিল।

এখন মধ্যপ্রাচ্য আবারও অস্থির হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র এই আঞ্চলিক যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ইসরাইলকে থামানো সহজ নয়। কয়েক সপ্তাহের চেষ্টার পরেও ইসরাইল গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে। এখনও শত শত নিরীহ মানুষ মারা পড়ছে। গাজায় নিহতের সংখ্যা ২৫ হাজার ছুঁয়েছে। এরমধ্যে শিশুই ১০ হাজারের বেশি। এমন অবস্থায় আরব দেশগুলো চুপ করে আছে। 

যদিও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে হামাস, ইসলামিক জিহাদ ও হিজবুল্লাহ। এই তিনটি বাহিনীই আবার ইরানপন্থি। এদিকে ইয়েমেনে যে হুতিরা ইসরাইলি জাহাজকে টার্গেট করে হামলা চালাচ্ছে, তাদের পেছনেও আছে ইরান। দেশটি নিজে যুদ্ধে যোগ না দিয়ে আঞ্চলিক বাহিনীগুলোকে দিয়ে ইসরাইলকে প্রতিরোধের চেষ্টা করছে। এর পেছনে আছে ইরানের আঞ্চলিক উচ্চাকাক্সক্ষাও। তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব দূর করতে চায়। পাশাপাশি দেশটি ইসরাইলকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে মরিয়া। 

ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের একমাত্র শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে ইরান। আজকের দিনে মধ্যপ্রাচ্য যেভাবে টগবগ করে ফুটছে তার জন্যে ইরানকেই দায়ী করছেন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা। ২০১৫ সালে নিজের পরমাণু বোমা তৈরির আকাক্সক্ষা পরিত্যাগ করেছিল ইরান, চুক্তি করেছিল পশ্চিমাদের সঙ্গে। কিন্তু সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে থাকা পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে আসেন। এরপর থেকে দ্রুত পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে মন দিয়েছে দেশটি।

ম্যাট বলেন, ইরানের কাছে এরইমধ্যে অন্তত ছয়টি পরমাণু অস্ত্র তৈরির মতো ‘এনরিচড’ ইউরেনিয়াম আছে। তারা চাইলে দুই-এক সপ্তাহের মধ্যেই এই বোমা তৈরি করতে পারে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সরকার চাইলেও ইরান আর চুক্তিতে ফিরতে রাজি নয়। দুই দেশের মধ্যে থাকা সামান্য বিশ্বাসও শেষ হয়ে গেছে। ফলে যে কোনো উস্কানি থেকেই মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ শুরু হতে পারে। 

ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের কারণে ইরানের চারদিক থেকে মার্কিন ঘাঁটির সংখ্যা কমে গেছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র ফিরেও আসে, তাদের আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ইরানকে মোকাবিলা করতে হবে।
ইরান হামাস ও হিজবুল্লাহকে বছরের পর বছর ধরে অর্থায়ন করেছে। হুতিকে সাধারণ অস্ত্র থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক মিসাইল ও ড্রোন সরবরাহ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকা ইরানপন্থি বাহিনীগুলো ইরাক ও সিরিয়ায় একাধিক মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। ইরানের নিজের বাহিনীই ইরাক, সিরিয়া ও পাকিস্তানে হামলা চালিয়েছে। ইরানি হামলায় ইরাকে তিন মোসাদ এজেন্ট নিহত হয়েছে। সিরিয়ায় দেশটি যে মিসাইল হামলা চালিয়েছে সেখানে ১২০০ কিলোমিটার দূর থেকে নিখুঁতভাবে একটি বাড়িকে টার্গেট করা হয়েছিল। এরপর পাকিস্তানেও ইরানের মিসাইল হামলা প্রমাণ করে তারা কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে।

ইসরাইল ইরানের এই সক্ষমতা সম্পর্কে অবগত। তারাও তার আশপাশে থাকা ইরানপন্থি বাহিনীগুলোকে হটিয়ে দিতে মরিয়া। গাজায় ইসরাইলি বর্বরতা প্রমাণ করে তারা কতটা আতঙ্কিত। গাজার পাশাপাশি ইসরাইল লেবাননে আক্রমণ চালাবে- সেই ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ যুদ্ধের উস্কানি দিয়ে চলেছে গত অক্টোবর থেকেই। লেবাননে যুদ্ধ আঞ্চলিক সংঘাতের তীব্রতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে এমন মরিয়া অবস্থা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বলছে, মধ্যপ্রাচ্য একটি যুদ্ধের দ্বোরগোড়ায়, সব পক্ষই এরজন্য প্রস্তুত। এখন কারও একটা ভুল হিসাব প্রতিপক্ষের রেড লাইন অতিক্রম করলেই শুরু হবে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ।