দুর্নীতি বন্ধ ও আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হোক
Share on:
সঠিকভাবে দুর্নীতি দমন করতে না পারলে, দেশের টাকা বিদেশে পাচার রোধ করতে না পারলে, দেশে সঠিকভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশের মানুষকে সুশাসন উপহার দিতে না পারলে, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুফল জনসাধারণ ভোগ করতে পারবেন না
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
সারা দেশে নির্বাচনি ডামাডোল থেমে গিয়ে এখন যে যার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব নিয়ে ব্যস্ত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রাপ্তির ঝুলি কানায় কানায় ভরপুর হলেও এবারের নির্বাচনে অংশ নেওয়া অনেক দলকে একেবারে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। যার মধ্যে বিএনপি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন দল গঠন করা তৃণমূল বিএনপি, বিএনএমসহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি দল রয়েছে, যাদের প্রাপ্তির ঝুলি একদম খালি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়জয়কার। আওয়ামী লীগ থেকে নৌকা প্রতীক পেয়ে যারা নির্বাচন করেছেন, তারা ২২২টি আসন পেয়েছেন এবং আওয়ামী লীগ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে যারা নির্বাচন করেছেন, তারাও ৬২টি আসন পেয়েছেন। আর সে হিসাবে জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৪টি আসনই এখন আওয়ামী লীগের দখলে। এ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিরঙ্কুশ অপেক্ষাও অনেক বেশি; যাকে বলা যায় ব্রুট মেজরিটি। এ অবস্থায় যেসব আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন, জাতীয় সংসদের অধিবেশনে কোনো বিল বা অন্য কোনো বিষয়ে তারা সরকারের বিরোধিতা করবেন না। কারণ, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতারাই দুই ভাগে ভাগ হয়ে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন।
জাতীয় পার্টি মাত্র ১১টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলেছে। তবে ১১ জন সংসদ-সদস্য নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে তারা কতটা সফল হবেন, সে প্রশ্নটিও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ, অতীতে আরও বেশি সংখ্যক আসন নিয়ে বিরোধী দলে থেকেও সংসদে তারা যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেননি বা করেননি। সে অবস্থায় এবারের সংসদে আওয়ামী লীগ মহিলা আসনসহ ৩৫০ আসনের প্রায় সবক’টি নিয়ে জাতীয় সংসদ পরিচালনা করবেন বিধায়, সরকারি দলটিকে আরও সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ব্রুট মেজরিটি থাকায় সংসদে তাদের শক্ত বিরোধিতা মোকাবিলা করতে না হলেও, সংসদের বাইরে কিন্তু অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তাদের এগিয়ে যেতে হবে। যার অন্যতম হলো, বিএনপিসহ সমমনা বিরোধী জোটকে মোকাবিলা করা। তাছাড়া বহির্বিশ্বের কিছু দেশও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি বৈরী, এ কথাটি মাথায় রাখতে হবে। স্বার্থের দ্বন্দ্বে কিছু বিদেশি শক্তিও সরকারের বিরোধিতা করবে, দোষত্রুটি খুঁজে বের করবে। এসব মোকাবিলা করাও একটি শক্ত বিষয় বিবেচনা করতে হবে। উপরন্তু দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, ডলার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইত্যাদি বিষয়েও সরকারকে ভোগান্তির মুখে পড়তে হবে। আবার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বিষয়টিও বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই চীন, ভারত, রাশিয়া ইত্যাদি দেশের ঋণের কিস্তি পুরোদস্তুর পরিশোধ করতে হবে। যদিও ইতোমধ্যে এসব ঋণের কিছু কিছু কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে; কিন্তু পুরোদমে যখন এসব কিস্তি পরিশোধ করতে হবে, তখন সরকারকে অর্থ সংকটে পড়তে হতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলেও এক ধরনের আর্থিক বিপত্তি তৈরি হবে। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা মোকাবিলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বৈরিতা এড়িয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বিশেষভাবে কৌশলী হওয়ার পাশাপাশি যে বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন, সেসব নিয়ে দফাওয়ারি সংক্ষিপ্ত কিছু কথা উল্লেখ করে আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই।
১. দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেভাবে দুর্নীতি জেঁকে বসেছে, সে কথাটি অকপটে স্বীকার করে দুর্নীতি দমনে কথার পরিবর্তে কাজ করে দেখাতে হবে। প্রয়োজনে দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতির অর্থ জব্দ করে সরকারি কোষাগারে আনতে হবে। নির্বাচনি হলফনামায় যাদের অর্থবিত্ত পাঁচ-দশ বছরে দুইশ, তিনশ এমনকি পাঁচশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সেসব অর্থের বিপরীতে তারা যথাযথ আয়কর দিয়েছেন বা দিচ্ছেন কিনা, সে বিষয়টি তদন্ত করে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে এবং সেসব অর্থের বিপরীতে যথাযথ আয়কর প্রদান করা না হয়ে থাকলে, তা আদায় করতে হবে। বিদেশে অর্থ-সম্পদ পাচারকারীদের তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে।
২. রাজনৈতিক ক্ষেত্রের বিবাদ-বিসম্বাদ যথাসম্ভব মিটিয়ে ফেলতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোনো সরকারই শেষ সরকার নয়; পরপর চতুর্থ দফা নির্বাচিত হওয়ার পর পঞ্চম দফা নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চাইলে সে ক্ষেত্রে কাজটি যে অত্যন্ত দুরূহ, সে কথাটিও মাথায় রাখতে হবে; মাথায় রাখতে হবে পরপর পঞ্চম দফা বিজয় লাভ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে। সুতরাং, ভবিষ্যতে নিজেদের সততা, দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি রাজনৈতিক সহনশীলতাও বাড়াতে হবে; রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আস্থায় আনতে হবে।
৩. দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দিতে হবে। সঠিকভাবে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সবার জন্য সমানভাবে আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কথায় কথায় গ্রেফতার করার যে অভিযোগ উঠেছে, তা যাতে ভুল প্রমাণিত হয়, সে বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মোটকথা দেশটাকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করার যে অভিযোগ উঠেছে, তা ভুল প্রমাণিত করতে হবে।
৪. বর্তমান অবস্থায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পাশ কাটিয়ে পুলিশ এবং সিভিল প্রশাসন দিয়ে দেশ চালানো হচ্ছে বলে প্রচলিত কথাটি সত্যি হয়ে থাকলে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে হবে। অতীতের মতো কোনো এমপিকে যেন বলতে না হয়, ‘সচিবালয়ের একজন পিয়নও তাদের মূল্যায়ন করে না।’ উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। অন্যথায় সুবিধাবাদী আমলাতন্ত্র আরও বেশি করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তৃত্ব আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে।
সবশেষে বলতে চাই, সঠিকভাবে দুর্নীতি দমন করতে না পারলে, দেশের টাকা বিদেশে পাচার রোধ করতে না পারলে, দেশে সঠিকভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশের মানুষকে সুশাসন উপহার দিতে না পারলে, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুফল জনসাধারণ ভোগ করতে পারবেন না, বারবার লুটেরা চক্র তাদের ফায়দা হাসিল করবে; ফলে স্বাধীনতার সুফলও সঠিকভাবে জনসাধারণের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। রাজনীতি করে খাওয়া একশ্রেণির দুষ্টচক্রের হাতে জিম্মি অবস্থায় নিজ দেশে পরাধীন জাতির মতো দেশের মানুষকে জীবনযাপন করতে হবে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর